ডাউন টাউন ম্যানহাটন

ছোটবেলা থেকে বইয়ে পড়েছি ইরানের মেয়েরা পারস্যের গোলাপের মতো সুন্দর! কিন্তু কিসের কী! নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তা মিলল কই।
নতুন চাকরির একদিনের প্রশিক্ষণ ছিল ডাউন টাউন ম্যানহাটনের মেইডেন লেনের এক সুউচ্চ ভবনের তেরো তলায়। প্রশিক্ষণের আগের রাতে আমার সে কী টেনশন! ঠিকঠাকভাবে যেতে পারব তো? ইন্টারভিউয়ের দিনে গিয়েছিলাম আমার স্বামীর সঙ্গে। দেরি হবে বলে সে আমাকে রেখে চলে এসেছিল সেদিন। আমি চিনে চিনে পরে এসেছি। মেইডেন লেনে কোনো ট্রেন থামে না। নামতে হয় ফুলটন স্ট্রিটে। তারপর পাঁচ মিনিট হাঁটলেই আমার স্কুলের মেইন অফিস।
মেইডেন লেনের গলি ধরে যাওয়ার পর কেমন যেন স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত হলাম। কত দিনের চেনা জায়গায় যেন বহুকাল পরে ফিরে এসেছি। বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমার মনে হচ্ছিল পুরোনো ঢাকার শাঁখারীবাজারে আছি। সেই জড়াজড়ি করে থাকা ভবন। বাড়ির সামনে নানা ধরনের তার প্যাঁচানো থাকে। সরু গলি; আর সেখানে জ্যাম সারাক্ষণ লেগে থাকে। মেইডেন লেনের ভবনগুলোর স্থাপত্যরীতি মুগ্ধ করে দেয়; প্যাঁচানো তারও নেই। তবে রাস্তাগুলো বেশ সরু। ওপরের দিকে তাকালে ভবনের আড়ালে চোখ আটকে যায়। পথচারীরা যে যার মতো রাস্তা পার হয়। গাড়ি-টাড়ি খেয়াল করে না; যে কারণে ডাউন টাউনে গাড়ি চালকদের সাবধানে চলতে হয়।
ভালো লাগার আবেশে বিভোর হয়ে আমি গন্তব্যে পৌঁছালাম ৯টা বাজার ১০ মিনিট আগেই। নাম লেখা কাগজে স্বাক্ষর করে আবার ক্লক ইন করলাম। এক বিশাল বলরুমে আমাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেক, চকলেট কুকিজ, আপেল, কমলাসহ নানা ধরনের খাবারের ব্যবস্থা আছে ব্রেকফাস্টের জন্য। যে যার পরিচয় দিলাম ভূমিকা পর্বে। তখনই জানলাম ওর নাম ফাতিমা। কালো রঙের বোরকা পরে এসেছে ও। শুধু মুখ ছাড়া শরীরের সবকিছু ঢাকা। এক টেবিলে বসার কারণে আমি জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, ‘তুমি কোথা থেকে এসেছ?’
ফাতিমা খুব নিচু স্বরে বলল, ‘ইরান’। আমি হা হা করে হেসে বলি, ‘ও ইরান? ইরান আমার প্রিয় দেশ।’ র‌্যাচেলের উচ্চ হাসিতে আমার কথা চাপা পড়ে যায়। লম্বা ও দীর্ঘদেহী এক নারী। গায়ের রং শাদাটে। তবে সে কোন রেসের, তা আমি ঠাহর করতে পারি না। মিশ্রণ হতে পারে। আমার মতো একটা প্রি স্কুলে চাকরি করে ও। এবিএ টিচার। আমাদের টেবিলের মধ্যমণি সে। যেকোনো আড্ডায় ওকে নিয়ে গেলে কেউ একঘেয়েমি বোধ করবে না। র‌্যাচেলের মোবাইলে ফোন এসেছে। ও জানাল, ফোন করেছে ওর দাদি। সবাই বলে উঠল, ‘দাদি?’ র‌্যাচেল বলল, ‘হ্যাঁ। জান, আমার দাদির বয়স কত?’ আমরা জিজ্ঞাসা করি, ‘কত?’ ও বলে, ‘৯৪ বছর! আমি দাদির সবচেয়ে প্রিয় মানুষ এই পৃথিবীতে।’ আমরা সমস্বরে বলি, ‘তোমার কত ভাগ্য!’
বিশাল হলরুম বলে আমাদের হালকা ফিসফিসানিতে তেমন সমস্যা হয় না। তবে আমাদের সৌভাগ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এই প্রশিক্ষণে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগ থেকে লোক এসেছে। পাঁচ হাজারের বেশি কর্মী প্রতিষ্ঠানটিতে। সারা নিউইয়র্ক শহরে তারা ছড়িয়ে আছে। শিক্ষা বিভাগের হয়ে আমরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আমাদের আলাদা করে দিয়ে আরেকটা ছোট রুমে পাঠানো হয়। র‌্যাচেল তো মহা খ্যাপা। কেন এত ছোট রুম দেওয়া হলো আমাদের? ওর সঙ্গে গলা মেলায় ব্রুক। র‌্যাচেল খুব ভ্রমণপ্রিয়। পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে বেড়ায় ও। ব্রুক মাঝেমধ্যে ওর সঙ্গী হয়। ব্রুক কৃষ্ণাঙ্গ। খুব চমৎকার করে কথা বলে।
ছোট রুমে নতুন প্রশিক্ষককে দেখে তো চোখ ছানাবড়া আমাদের! টম ক্রুজের চেয়ে সুদর্শন এক ভদ্রলোক এসেছেন আমাদের ক্লাস নিতে। এই কোম্পানির সহকারী পরিচালকও নাকি উনি! পরিচালক হওয়ার চেষ্টা না করে হলিউডে নায়ক হওয়ার জন্য কেন চেষ্টা করেননি তিনি, আমার মাথায় এল না। র‌্যাচেল কনুই দিয়ে এক খোঁচা মারে ব্রুককে। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে। আমি খুব কষ্ট করে হাসি চাপি।
শিক্ষা বিভাগের আমরা মোট নয়জন এক রুমে। সবাই নারী। ফাতিমাও আছে আমাদের দলে। ও আমার মতো একটা স্কুলের সহকারী শিক্ষক। ওর স্কুল ব্রুকলিনে। আমার স্কুল কুইন্সে। আমাদের মধ্যে ফাতিমা একমাত্র চুপচাপ। বাকিরা সবাই সরব। র‌্যাচেল তো রীতিমতো বাচাল। একটু পরপর হাত উঠিয়ে রাজনীতিবিদদের মতো বক্তৃতা দেয়। সুদর্শন প্রশিক্ষককে দেখে ওর বক্তৃতা দেওয়ার উৎসাহ আরও বেড়ে গেছে। ভদ্রলোক অবশ্য খুব সাবলীল। এত নারীর মধ্যে ক্লাস নিতে গিয়ে এতটুকু অস্বস্তি দেখি না। কথা বলার সময় হাতগুলো নাড়ান খুব। দেখলাম অনামিকায় আংটি পরে আছেন। তার মানে বিবাহিত।
ক্লাস ছিল নয় তলায়। লাঞ্চ করতে গেলাম তেরো তলায়। ক্যাফেটেরিয়াটি সেখানেই। অন্যদিনের চেয়ে আজ বেশি গমগমে চারদিক। বসার জায়গার অভাব। জানালার পাশে ছোট টেবিলে একজনকে দেখলাম বসে খাচ্ছে। আমি উল্টো দিকের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। তেরো তলার জানালার দিয়ে বাইরের ডাউন টাউন ম্যানহাটনের ব্যস্ততা দেখছিলাম। সরু গলি, চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে। ঘিঞ্জি ঘনবসতি এলাকা আমার প্রিয় পুরান ঢাকাকে মনে করিয়ে দিল।
‘তুমি বাঙালি?’, একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। প্রশ্নকর্তা আবার জিজ্ঞাসা করল। আমার টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে বসা থাকা শ্যামলা চেহারার মিষ্টি মেয়েটা প্রশ্ন করছে। আমি তো রীতিমতো অবাক। আজ সকালে পাশের টেবিলে মেয়েটাকে দেখেছিলাম। নামটা এখন মনে নেই। তবে নাম শুনে ভেবেছিলাম গায়ানিজ কিংবা ডমিনিকান কেউ হবে। এখন দেখছি বাঙালি।
ওর নাম মারিয়া গোমেজ। দুজন বাঙালি এক হয়ে রীতিমতো কথার তুফান ছুটল। আমার মতো সেও ঢাকার মেয়ে। ফার্মগেটে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। মারিয়াকে বললাম, ‘দেখ ডাউন টাউন এলাকাটা খুব সুন্দর না? একদম আমাদের পুরান ঢাকার মতো।’ ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সঙ্গে সঙ্গে জানাল, ‘জান, আমি আগে এক ভারতীয় স্বর্ণের দোকানে কাজ করতাম এখানে। তখন থেকেই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়।’
আমার চেয়ে অনেক বছর আগে মারিয়া এখানে এসেছে। ইতিমধ্যে উডসাইডে বাড়িও কিনে ফেলেছে ও। মাসে মাসে মর্টগেজের টাকা দিতে হয় প্রচুর। চাকরি না করলে চলে না। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কমপ্লায়েন্স বিভাগে কাজ করে ও। পাঁচ বছরের মেয়েকে শ্বশুরের ভরসায় রেখে এসেছে। উনি স্কুল থেকে আনা-নেওয়া করেন। তবে শ্বশুরকে অনেক সময় ভরসা করা যায় না। মাঝেমধ্যে গির্জায় গিয়ে এমন আড্ডায় বসেন যে, বাসায় ফেরার কথা মনে থাকে না। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পরে এই সমস্যায় পড়তে হয়েছে। শাশুড়ির কথা বলতে বলতে ওর চোখ ছলছল করে।
মারিয়াকে স্বাভাবিক করার জন্য আমি ফাতিমাকে দেখাই। বলি, ‘ইরানি মেয়েটাকে দেখ! কেমন যেন তাই না?’ ও আমার কথায় সায় দিয়ে বলে, ‘একটা কেমন যেন ব্যাপার আছে মেয়েটার মধ্যে। আমরা সবাই মহিলাদের বাথরুমে যাই। পুরুষেরা যায় তাদের বাথরুমে। ও যায় আলাদা বাথরুমে। অফিসের লোকজনের কাছ থেকে চাবি নিতে হয় ওর এ জন্য।’
লাঞ্চ শেষের আগে আমি আর মারিয়া ফোন নম্বর বিনিময় করি। ফেসবুকেও বন্ধু হই। আমরা দুজনেই কুইন্সে থাকি। ট্রেনিং শেষ করে এক সঙ্গে বাড়ি যাব বলে জানিয়ে আমাদের নির্ধারিত রুমে চলে যাই।
বিকেলের সেশনে আরও মজা হয়। আমাদের সুদর্শন প্রশিক্ষক একটা কাজ দেন প্রত্যেককে। ক্লাসে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করে এমন কোনো ছাত্রকে বেছে নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আমি একজনকে বেছে নিয়ে গ্রেড করতে থাকি। তারপর নম্বর মিলিয়ে দেখি আসলে ও যেমন তেমনটাই উত্তর এসেছে। র‌্যাচেল হাসতে হাসতে বলে, ‘আমার বয়ফ্রেন্ডের ওপর এটা করতে হবে। আমরা সবাই হেসে উঠি।’
সুদর্শন প্রশিক্ষক শিক্ষা বিভাগ থেকে আসা আমাদের সাড়ে ৩টার মধ্যেই ছেড়ে দেন। আমাদের স্কুল ছুটির সময়ের সঙ্গে মিল রেখে হয়তো এই সিদ্ধান্ত। মারিয়াদের ছুটি হবে ৫টায়। ও আমাকে চলে যেতে বলে। ‘পরে দেখা হবে’, বলে আমি রওনা হই।
ডাউন টাউন ম্যানহাটনের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ট্রেন স্টেশনের দিকে হাঁটি। আশপাশে প্রচুর ভারতীয় রেস্টুরেন্ট। জায়রো গাড়িগুলোতেও একই অবস্থা। কিন্তু এসব আসলে চালায় বাঙালিরা। ম্যানহাটনে ভারতীয় খাবারকে জনপ্রিয় করার পেছনে তাদের তো দেখি বিরাট অবদান! আমি একটা জায়রো গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এক বোতল ঠান্ডা পানি কিনি। বাক্সের মতো গাড়িতে বসে থাকা রাঁধুনি আমাকে দেখে বলে, ‘আপা, ভালো আছেন?’ বাঙালি দেখি বাঙালিকে প্রথম দেখাতেই চিনে ফেলে।
আমিই শুধু কিছু চিনি না। আজ যেমন মারিয়াকে ভুল করলাম। ফাতিমার ব্যাপারেও কোনো ভুল হচ্ছে না তো! চমকে উঠে দেখি সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফাতিমা। রাস্তায় রাখা ফোন বুথ দিয়ে কাউকে ফোন করার চেষ্টা করছে। মুখটা কেমন এবড়োখেবড়ো। হাতার ভিতর দিয়ে লম্বা লোম দেখা যাচ্ছে। অন্তর্ভেদী চোখে দেখছে আমাকে। হঠাৎ আমি বুঝতে পারি, ফাতিমা আসলে হিজড়া। নামটা মেয়েদের নিলেও আসলে ও মেয়ে নয়। যে কারণে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত বাথরুমে যায় না। আমি ওর দিকে সমীহের চোখে তাকাই। ইরানের রক্ষণশীল সমাজে হিজড়া হওয়ার কারণেই ওকে কতটা লড়াই করতে হচ্ছে, তা আমার জানা নেই।
ফাতিমার প্রখর চোখের দৃষ্টিকে পেছনে ফেলে আমি এগিয়ে যাই। পেছনে ফেলে যাই ডাউন টাউন ম্যানহাটনকে। একদিন যেখানে গোড়াপত্তন হয়েছিল পৃথিবীর রাজধানী বলে খ্যাত নিউইয়র্ক সিটির। কয়েক শ বছরের পুরোনো ভবন, সরু গলি, ফুটপাতে মানুষের ভিড়, কোথাও সম্প্রসারণ নেই। শুধু টিকিয়ে রাখা। কেন যেন ডাউন টাউনকেও আমার ফাতিমার মতো বৃহন্নলা মনে হয়।