শহীদ ড. শামসুজ্জোহা একটি নাম; একটি ইতিহাস, যে ইতিহাসটি হওয়ার কথা ছিল সমগ্র বাংলাদেশের। অথচ ইতিহাসটি হয়ে রইল শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইতিহাসটি শুধু জানল ও পালন করল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা। দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সে গৌরবজনক ইতিহাস জানল না বাংলার আপামর জনতা।
শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচানোর জন্য এই যুবক-শিক্ষকের রক্তে রক্তিম হয়েছিল মতিহারের সবুজ ঘাস। সেই মহান শিক্ষকের কথা জানল না আমার প্রজন্ম। এই মহান শিক্ষক বলেছিলেন, ‘ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে সেই গুলি আমার বুকে লাগবে।’ এমন কথা পৃথিবীর বুকে কে শুনেছে কবে? সেই শিক্ষকের কথা জানবে না আগামী প্রজন্ম-এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের ইতিহাস আর কী হতে পারে!
আজকের যে শিশু বেড়ে উঠছে স্বাধীন দেশের হাওয়া আর জলে, সেই শিশু কোনো দিন জানতেও পারবে না কেমন উত্তাল ছিল ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে বাংলার জনতা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেই অগ্নিঝরা সময়ে ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে হত্যা করা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হককে। এ দুই হত্যায় দেশের মানুষের মধ্যে আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। হত্যার প্রতিবাদে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে শহরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কাজলা গেটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সে মিছিলে গুলি চালানোর প্রস্তুতি নেয়। এই সময় ড. জোহা নিজের প্রক্টর পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সেখান থেকে সরে যেতে বলেন।
পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা তাঁর দাবি অস্বীকার করলে তাদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন ড. জোহা। এরই একপর্যায়ে বর্বররা তাঁকে গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর বর্বররা এই প্রথম কোনো বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করল। ইতিহাস ড. শামসুজ্জোহাকে বরণ করে নিল দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে। তাঁর হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনের আগুন দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি শহর, বন্দর, গ্রামে-গঞ্জে ও প্রান্তিক জনপদে।
জোহার সেই সবুজ চেতনায় কি সজীব হতে পারবে না আমাদের সন্তানেরা? না। কারণ, রাষ্ট্র এ জাতিকে জোহার চেতনা এবং ইতিহাস জানানোর কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। এ কেমন দেশ যারা বীরের সম্মান দেয় না? এ কেমন সরকার যারা জোহার রক্তের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না! যে রাষ্ট্র জোহার মতো বীরের স্বীকৃতি জানাতে কুণ্ঠাবোধ করে, সেই দেশের জন্য কে আর প্রাণ বিলিয়ে দিতে আগুয়ান হবে? না হওয়াটাই স্বাভাবিক। ফলে দেশের জন্য কেউ আর জীবন দিতে চায় না এখন। সবাই দেশ থেকে নিতে চায়। এ রাষ্ট্র এখন আমাদের লুটেরা হতে শেখায়। চাটুকার হতে শেখায়। দালাল হতে শেখায়। দেশে আজ লুটেরা, চাটুকার আর দালালের জয়জয়কার।
রাষ্ট্র ড. জোহার মৃত্যুর ৩৯ বছর পর ২০০৮ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার এবং তাঁকে নিয়ে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেই দায় সেরেছে। একুশে পদক পর্যন্ত দেওয়া হয়নি জোহাকে। এ জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আবেদন জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। পৃথিবীর ইতিহাসে ছাত্রদের জন্য শিক্ষকের জীবন দেওয়ার ঘটনা বিরল। ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. জোহার শহীদ হওয়ার দিনটিকে শিক্ষক দিবস ঘোষণার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন করছে। প্রত্যেক সরকারের কাছে এই দাবি জানানো হলেও আজ পর্যন্ত কেউ কর্ণপাত করেনি। বর্তমান সরকার নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার বলে দাবি করে। অথচ এ বিষয়ে তাদেরও কোনো পদক্ষেপ নেই।
ইউনেসকো ১৯৯৪ সালে প্রতি বছরের ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ ঘোষণা করে। বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশ স্বতন্ত্র শিক্ষক দিবস পালন করে। এর বাইরে বাংলাদেশ প্রতি বছর ১৯ জানুয়ারি পালন করে জাতীয় শিক্ষক দিবস। কিন্তু শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে ড. শামসুজ্জোহার অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে, তাঁর ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ১৮ ফেব্রুয়ারিকে শিক্ষক দিবস পালন করা যেতে পারত। অনেকেই দীর্ঘ দিন ধরে এ দাবি জানিয়ে আসছে। আমাদের পাশের দেশ ভারত তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ও স্বনামধন্য শিক্ষক ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণানের জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বরকে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে। অনুরূপভাবেই শহীদ জোহার মৃত্যুদিনটিকে শিক্ষক দিবস পালন করা যেত। কারণ বিশ্বের প্রতিটি দেশের শিক্ষক দিবসের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, তার মধ্যে বাংলাদেশের একজন শিক্ষকের আত্মদানের ইতিহাসই মহত্বম।
১৯৬৯ সালের স্বাধীনতার পূর্বক্ষণে ঘটা এই আত্মদানের ঘটনাটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের চাকায় গতির সঞ্চার করেছিল। অথচ ১৮ ফেব্রুয়ারিকে শিক্ষক দিবস করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে কোনো আলোচনাই নেই। জোহার অপরাধ হতে পারে, তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অফার পাওয়ার পরও মফস্বলের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করাকে শ্রেয়জ্ঞান করেছিলেন। রাজশাহীকে ভালোবেসেছিলেন। বাংলাদেশকে ভালোবেসেছিলেন। সম্ভবত এটাই তাঁর অপরাধ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ড. শামসুজ্জোহার ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস। সে বাস্তবতা মেনেই সরকারের উচিত হবে নিজ দায়িত্বে ১৮ ফেব্রুয়ারিকে শিক্ষক দিবস ঘোষণা করা। আশা করি সরকার দ্রুতই এ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে।