ট্রাম্পের কর কেলেঙ্কারির ফায়দা নিতে পারবেন বাইডেন?

দুই পক্ষেরই চেষ্টা হচ্ছে বিজয়ের জন্য এক নতুন মানচিত্র তৈরি করা। হোয়াইট হাউসে যাওয়ার জন্য জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন পথের সন্ধানে নেমেছেন
ছবি: এএফপি

মার্কিন রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবির্ভাব হয়েছিল একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে। অর্থনীতি ঠিক পথে ফেরাতে নিজেকেই সবচেয়ে যোগ্য লোক হিসেবে প্রচার করেন তিনি। গেল নির্বাচনে তিনি যে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ স্লোগান সামনে আনেন, তা এখনো বেশ জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। মার্কিন অর্থনীতির ক্ষত সারাতে তিনি যেসব রক্ষণশীল পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার কেন্দ্রে বরাবরই ছিল এবং আছে ‘করদাতাদের অর্থের সফল ব্যবহারের’ বিষয়টি। কিন্তু এখন নিউইয়র্ক টাইমসের ফাঁস করা তথ্যে দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতি পুনর্গঠন ও ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ের স্বঘোষিত সেনাপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই কর ফাঁকি দিচ্ছেন।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে বা রাজনীতির ময়দানে ঢোকার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় পরিচয়টি ছিল রিয়্যালিটি শো ‘দ্য অ্যাপ্রেনটিসের’ কল্যাণে, যেখানে তিনি বসতেন বিচারকের আসনে; আর পান থেকে চুন খসলেই বলে উঠতেন ‘ইউ আর ফায়ারড’। সেই অনুষ্ঠান নিঃসন্দেহে কঠোর প্রশাসক হিসেবে ট্রাম্পের একটি ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল। সমর্থকদের কাছে নিজেকে একজন ‘লৌহমানব’ হিসেবেই তুলে ধরতে এখনো তৎপর তিনি। যে কারণে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শহরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে ট্রাম্প অনায়াসে বলতে পারেন, সেনা মোতায়েনের কথা।

কর ফাঁকি দিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে রাস্তায় হেঁটেছেন, তা চিরপরিচিত। নিজের ব্যবসায়িক ক্ষতি দেখিয়ে তিনি কর পরিশোধের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন বরাবর। এই অজুহাতটিকে সত্য মানলে বলতে হয়, সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের যে ভাবমূর্তি তিনি তৈরি করেছেন, তা এক বড় ভাঁওতা

সে যা-ই হোক, এসব ভাবমূর্তিই এখন ক্ষয়ে গেছে বলা যায়। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তাতে কঠোর প্রশাসকের মুখোশটি এখন ট্রাম্পের মুখ থেকে খসে পড়েছে। দিনের পর দিন ‘করদাতাদের অর্থের অপব্যয়’ বন্ধের দোহাই দিয়ে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প বা ওবামাকেয়ার ও তরুণ অভিবাসীদের জন্য থাকা ‘ড্রিমারস’ খ্যাত প্রকল্প বন্ধের কথা বলেছেন তিনি। অভিবাসনবিরোধী যাবতীয় পদক্ষেপের পেছনে অকাট্য যুক্তি হিসেবে বরাবরই এই একই কারণকে হাজির করেছেন। কিন্তু এখন তিনি নিজেই কর এড়িয়ে চলা মানুষ হিসেবে সামনে এসেছেন। রাষ্ট্রের শীর্ষ পদধারী ব্যক্তি হিসেবে এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?

কর ফাঁকি দিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে রাস্তায় হেঁটেছেন, তা চিরপরিচিত। নিজের ব্যবসায়িক ক্ষতি দেখিয়ে তিনি কর পরিশোধের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন বরাবর। এই অজুহাতটিকে সত্য মানলে বলতে হয়, সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের যে ভাবমূর্তি তিনি তৈরি করেছেন, তা এক বড় ভাঁওতা। আর যদি তাঁর এই সফল ভাবমূর্তি সত্য হয়, তবে তিনি কর ফাঁকি দিয়েছেন নিশ্চিতভাবেই। যেটাই সত্য হোক না কেন, তিনি যে বিষয়টি ঠিকঠাক ‘ম্যানেজ’ করতে পারেননি, তা তো নিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে আবার তাঁর নিজেকে ‘গ্রেট ম্যানেজার’ দাবি করাটা ঠিক ধোপে টেকে না।

নিউইয়র্ক টাইমস যে তথ্য সবার সামনে হাজির করেছে, তাতে চোখ কপালে ওঠা ছাড়া কোনো গতি নেই। গত রোববার প্রকাশিত প্রতিবেদনটির কল্যাণে এখন সবাই জেনে গেছে, গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছর ও প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প মাত্র ৭৫০ ডলার করে আয়কর পরিশোধ করেছেন। পরের দুবছরে তিনি কোনো করই পরিশোধ করেননি। আইনের মারপ্যাঁচে এই কর পরিশোধ না করার দায়টা হয়তো শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প এড়াতে পারবেন। কিন্তু এর মাধ্যমে সেই বড় প্রশ্নটি সামনে চলে এল, যার কথা ভারমন্ট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও তাঁর তারকা অনুসারী এলিজাবেথ ওয়ারেন বহুদিন ধরে বলে আসছেন। তাঁরা বলে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কর কাঠামোয় ধনীদের জন্য বড় সুবিধা রাখা হয়েছে। আর কাটা হচ্ছে পরিশ্রমী আমেরিকানদের পকেট। এই ব্যবস্থা উল্টে দেওয়ার কথা বলছেন তাঁরা।

মজার ব্যাপার হলো ব্যবস্থাটি পাল্টানোর কথা ডোনাল্ড ট্রাম্পও বলছেন। এই বদলের কথা বলেই তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোটারদের নিজের দলে টেনেছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ধনী লোকেদের জন্য বিদ্যমান সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কর এড়িয়ে যাওয়ার কাজটি ঠিকই করেছেন। রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে বসেও তিনি এ চর্চা থেকে সরে আসেননি। আর এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে সেই সব খেটে খাওয়া মানুষের পকেট কেটেছেন, যাদের ভোটে হোয়াইট হাউসে আজ তিনি।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে করের তথ্য, যা নিউইয়র্ক টাইমস ফাঁস করল, তার কারণে আসন্ন নির্বাচনে কতটা প্রভাব পড়বে? চলমান আলোচনায় মনে হচ্ছে বড় প্রভাব পড়বে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এর আগেও তো কম কেলেঙ্কারির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম যুক্ত হয়নি। এ ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন, পর্নো তারকার সঙ্গে সম্পর্ক, গত নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচার দলের সঙ্গে রুশ সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি বহু অভিযোগের কথা উল্লেখ করা যায়। এসবের কারণে গত চার বছরে কম জলঘোলা হয়নি। কখনো কখনো তো এমনও মনে হচ্ছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প এই অভিশংসিত হলেন বলে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এখনো তিনি বহাল তবিয়তেই আছেন।

কর এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে অনেক বড় অপরাধ। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকেরা ‘গোঁড়া সমর্থক’ হিসেবেই পরিচিত। যা কিছুই হোক, তাঁরা ট্রাম্পের পেছনেই আছেন। বিভিন্ন জনমত জরিপেও ট্রাম্প সমর্থকদের এমন প্রবণতাই উঠে আসছে। সঙ্গে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের নিজের সঙ্গে লেপ্টে রাখতে এবং বিভিন্নভাবে তাদের উসকে দিতে, যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত ট্রাম্প। এরই মধ্যে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকারীদের ওপর তাঁর সমর্থকদের চড়াও হওয়া এবং সে ক্ষেত্রে সমর্থকদের পক্ষ নিয়ে তিনি সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এর আগেও এমন অবস্থান তিনি স্পষ্ট করেছেন বিভিন্ন ঘটনায়। ট্রাম্প এই চেনা পথেই হাঁটবেন সন্দেহ নেই।

ভোটের আগে নিউইয়র্ক টাইমস নিঃসন্দেহে একটি বড় অস্ত্র তুলে দিয়েছে ডেমোক্র্যাটদের হাতে। এই অস্ত্র বেশ ধারালো ও বিধ্বংসীও। কিন্তু এর কার্যকারিতা পুরোপুরি নির্ভর করছে এর ব্যবহারকারীর ওপর। স্পষ্ট করে বললে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই কর কেলেঙ্কারি তাঁর জন্য কতটা বিনাশী হবে, তা নির্ভর করছে জো বাইডেন ও তাঁর প্রচার দলের ওপর। আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে প্রথম প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্ক। সেখানে ট্রাম্পকে ধরাশায়ী করার বড় অস্ত্রটি এখন বাইডেনের হাতে। বাকিটা নির্ভর করছে বাইডেনের বাগ্‌চাতুর্যের ওপর।