টুকরো স্মৃতির সিম্ফনি

প্রতীকি ছবি৷ সংগৃহীত
প্রতীকি ছবি৷ সংগৃহীত

ছুটির দিন, তার পরও ঘুম ভেঙে গেল ভোরবেলায়। ডান দিকে দেয়ালে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ভোর ৫টা ৩৫ মিনিট। ইচ্ছে ছিল বেশ সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে পুরো সপ্তাহের স্বল্প ঘুমের শান্তিটা পুরো করে নেব, কিন্তু হলো না। হালকা বিরক্তির উদ্রেক হলো তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গিয়েছে বলে। ভোরের হালকা শীতের আমেজে বিছানা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হলো না। অগত্যা কী আর করা, মাথার পেছনে আরেকটি বালিশ জুড়ে দিয়ে উঁচু হয়ে শুয়ে তারবিহীন দূর-শ্রবণযন্ত্রটি কানে লাগিয়ে টিভি ‘অন’ দিলাম...অনেক দিন আগের রেকর্ডকৃত রবীন্দ্রসংগীতের একটি অনুষ্ঠান, চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত হয়েছিল ‘গানে গানে সকাল শুরু’ অনুষ্ঠানে, ভেসে এল সেই চমৎকার স্মৃতিজাগানিয়া গানটি—
দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
কান্না-হাসির বাঁধন তারা সইল না-
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।।
ভোরের অবিচ্ছিন্ন নীরবতায় গানটি শুনতে শুনতে কখন যে চোখ দুটো বন্ধ করে হারিয়ে গিয়েছিলাম অতীতের সেই দিনগুলোতে, বুঝতে পারিনি! সেই দিনগুলোতে, যে দিনগুলো হৃদয়ের গভীরে ঘুমিয়ে আছে বহুকাল, চলার পথের অনেক স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে আজও অমলিন হয়ে আছে আমার সেই সব নানা রঙের দিনগুলি...। শ্রান্তপথের ক্লান্ত পথিকের মতো পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, গত হয়ে গিয়েছে অনেকটা সময়—বুঝতে কষ্ট হলো না। সময়ের অবিশ্রান্ত ধারায় চলমান সময়ের মাঝে বিলীন হয়ে যায় জীবনের মুহূর্তগুলো প্রতিনিয়ত। আমরা হেঁটে যাই জীবনের একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্তের দিকে ক্রমশ, ক্রমাগতভাবে অনন্তের দিকে।
অনাদিকাল থেকে জীবন চলমান, এই বহমান ধারা কখনো থেমে নেই। চলার পথে ভিন্ন বাঁকে জীবন নিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মোড়, বদলে গিয়েছে জীবনকে যাপন করার উপলব্ধি, অনুভব। বর্তমান সময়চক্রে আমাদের জীবনে চলার বেগ বেড়ে গিয়েছে, সন্দেহ নেই, কিন্তু সময় কখনো দ্রুত বেগে বয়ে চলে না- সৃষ্টির বাহক হয়ে একই ধারায় চিরকাল আপন গতিতে চলছে এর স্রোত, এর পথচলা। মূলত বেগ আর আবেগের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আমাদের আবেগগুলো পেছনে পড়ে যাচ্ছে, বর্তমান জটিল ও যান্ত্রিক জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মব্যস্ততায় আমরা ঠিক পেরে উঠছি না সময়ের সঙ্গে, তাই তো শুধু মনের ভ্রান্ত অনুভব, ‘সময় দ্রুত বয়ে যায়।’
আসলে সব সময় সব সত্যিকে আমরা আমাদের উপলব্ধিতে স্পর্শ করার অধিকার দিতে বড় কুণ্ঠিত হই। আমাদের মনের গহিনে আমাদের আরও একটা ভিন্ন সত্তা আছে, যার আধিপত্য আমাদের চেতনায় অত্যন্ত ভাস্বর এবং যথাসময়ে, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সেই সত্তাই আমাদের চিন্তা-চেতনায়, চলায়-বলায় আমাদের সম্বোহিত করে, উচ্চকিত হয় নীরব উচ্চারণে- নিঃস্তব্ধতার মাঝেও ইথার বিস্তারের মতো আমাদের মনে ভেসে বেড়ায় তার মৌন কম্পন।
জীবনে চলার পথে বাঁকে বাঁকে, ক্ষণে এমন কিছু উপলব্ধি, এমন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের চেতনায় গাঢ় ছাপ রেখে যায়, যা বিস্মৃত হতে চাইলেও হওয়া যায় না, বার বার ফিরে আসে সেই চেনা পথ ধরে- টেনে নিয়ে যায় পেছনে, দূর... বহু দূরে স্মৃতির মেঠোপথ ধরে যাপিত জীবনের সেই ধূসর মায়াজালে। কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া পথে চলতে গিয়ে যেমন অস্পষ্ট পথের সঠিক রেখা কাছাকাছি এলে আপনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে আসে চোখের সামনে, তেমনি অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে ঝাপসা হয়ে যাওয়া অনেক অস্পষ্ট স্মৃতিও চলে চলে আসে বর্তমানের দোরগোড়ায়, আমাদের খুব কাছে, আপন রেখায় ভর করে। কখনো কখনো ফেলে আসা দিনগুলোর আলো-ছায়ায় হাতড়ে খুঁজে ফিরি কিছু প্রিয় সময়, কিছু অনন্য মুহূর্ত, কিছু প্রিয় মুখ, কিছু প্রিয় উপলব্ধি, কিছু ভালো-লাগার স্পর্শ-আমেজ, অন্তরের গভীরে লুকিয়ে থাকা কিছু চিরচেনা ঘটনার স্থিরচিত্র- নিজের অজান্তেই স্মৃতির পথ ধরে হারিয়ে যাই এক অন্য সময়ের সীমানায়, খুঁজে পাই এক অন্য ‘আমি’কে বিলীন হয়ে যাওয়া অতীতের বিলাস-ভ্রমণে। যখন প্রত্যক্ষ করি কীভাবে মুহূর্তের চোরাবালিতে হারিয়ে যায় মুহূর্ত, বর্তমানের কাছে পরাজিত ক্ষণপূর্বের বর্তমান হয়ে যায় লীন, ফিরে আসি আবার সেই সময়ের সীমারেখায়, দাঁড়িয়ে থাকি বর্তমানের দেয়াল ঘেঁষে, যেখানে জীবন সত্য, যেখানে বাস্তবতার স্পর্শে চেতনা সত্য। এই আসা-যাওয়ার লুকোচুরিই আমাদের বেঁচে থাকার পাথেয়, আমাদের প্রাণসঞ্চারী জীবনবোধের অলৌকিক সারথী। বারংবার এই ফিরে যাওয়ার পথ ধরেই আমরা বুকের গভীরে ধারণ করে আছি আমাদের সেই পুরোনো পৃথিবীর বেঁচে থাকা। পূর্ণিমা রাতের স্নিগ্ধ আলোয় আকাশে জেগে থাকা অসংখ্য তারার মতো কত শত স্মৃতি আধো আলোতে ঘুরে বেড়ায় আমাদের মনের আকাশে, যেন অদৃশ্য গ্রন্থিতে বেঁধে দিয়েছে সেকালকে একালের সঙ্গে এক মায়ার মিতালীতে। দ্বিচারিণী মন ঘুরে বেড়ায় সেইখানে, এইখানে!
শৈশব, কৈশোর, যৌবন পার হয়ে আজ প্রায় বার্ধক্যের হাতছানি... পেছন ফিরে দেখি ধু ধু সেই দিনগুলো, মনেও পড়ে না কীভাবে শুরু হয়েছিল সেই চেতনার যাত্রা। ছেলেবেলার সেই দুরন্ত সময়, যৌবনের সেই বলিষ্ঠ পথচলা কখন যে দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে গেছে, বুঝতে পারিনি। এতটা পথ পরিক্রমার পর, এতটা সময় পার হয়ে এসে যখন আজ ভাবি, কেমন সময়ের সীমান্তে হয়েছিল আমাদের জন্ম, কেমন ছিল আমাদের ছেলেবেলা, কেমন ছিল সেই জীবনের স্পর্শ-আবেগ, কেমন ছিল জীবনের উচ্ছলতা আর অননুমেয় উচ্ছ্বাস- মনে হয় রংধনুর সাত রঙের আবির মাখা ছিল আমাদের সেইসব সোনালি সময়, হঠাৎ গত হয়ে যাওয়া সময়ের কালো মেঘের আড়ালে যেন চলে গেছে, সেই না-ফেরা রংধনুকাল কখনো আসবে না ফিরে আর।
তবুও আয়োজন বার বার ফিরে যাওয়ার স্মৃতির পথ ধরে- অস্তিত্বের ভালোবাসায়! অতীতকে ভুলে গিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকব? নিজের ফেলে আসা অস্তিত্বকে ভুলে গিয়ে, অস্বীকার করে কীভাবে বেঁচে থাকা যায়?!

প্রতীকি ছবি৷ সংগৃহীত
প্রতীকি ছবি৷ সংগৃহীত


স্মৃতির বাতায়নে বসে মুহূর্তে ফিরে যাই গ্রামের সেই চিরচেনা পথে... হেঁটে বেড়াই আমার সেই ছেলেবালার খেলার মাঠের সবুজ চত্বরে, গ্রামের পথে গাছের শীতল ছায়ায়, চৈত্র দুপুরের তীব্র রোদে মাঠের কোণে বটবৃক্ষের বৃহৎ শাখায় বসে থাকি বন্ধুদের নিয়ে মৃদুমন্দ বাতাসে- পাশ থেকে ভেসে আসে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউগাছের সুরেলা শব্দ; চেয়ে থাকি নদীর পাড় ঘেঁষা শিমুলগাছের দিকে যেখানে কেটেছে তপ্ত দুপুরের কত অলস প্রহর, এখনো যেন শুনতে পাই কৃষ্ণচূড়ার ডালে বসে ডেকে ওঠা শালিকের শব্দ, বাঁশ ঝাড়ে ঘুঘুর ডাক কিংবা পাশের বাড়ির গিরিবাজ কবুতরের প্রণয়ী গুঞ্জরনের মধুর আওয়াজ। এখনো পূর্ণিমা রাতের চাঁদের আলোয় ফিরে যাই আমাদের সেই খেলার মাঠে ঝির ঝির হাওয়ায় কাটিয়ে দেওয়া শান্ত সৌম্য সান্ধ্য বিহারে!
ঋতু বৈচিত্র্যের ভিন্ন ভিন্ন আবেশে আবর্তিত হতো আমাদের জীবনের নানা রং। বসন্তের দক্ষিণা বাতাস, মৃদু বাতাসে হালকা শিমুল তুলোর উড়ে যাওয়া, কৃষ্ণচূড়ার আগুন ঝড়া লাল রং, নীল আকাশে ভেসে ওঠা সাদা মেঘের নকশি কাঁথা, সূর্যাস্তের দিগন্তরেখায় মায়াবী প্রকৃতির লাল আঁচল- যেন প্রকৃতির পাতায় পাতায় ফুটে উঠেছে জীবনের জয়গান, জীবনের সমস্ত উচ্ছ্বাস আর আবেগ যেন আলিঙ্গন করছে প্রকৃতিকে সমস্ত রং দিয়ে।
বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব নৃত্যে দামামা বেঝে উঠতো পড়ন্ত বিকেলে, কালো মেঘে আবৃত হয়ে যেত সারা আকাশ আর বিদ্যুৎস্ফুরণের পাশাপাশি বজ্রপাতের প্রচণ্ড গর্জনে কেঁপে উঠতো চারিদিক- ঝড়ের প্রাক্কালে প্রকৃতির সেকি রুদ্ররূপ, সেকি মহা স্থিরতা! মাঠ ছেড়ে দৌড়ে চলে যেতাম বাড়ির পরম নিরাপদ আশ্রয়ে। আর ঝড়ের শেষে আধো-আলোতে আম কুড়ানোর সুখ এখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে। চৈত্রের তপ্ত দুপুরে একটুখানি হাওয়ার জন্য হিজলগাছের নিচে মাদুর বিছিয়ে ঘুমিয়ে যেতাম প্রকৃতির কোলে। প্রকৃতির প্রাণজুড়ানো মৃদু-মন্দ বাতাস যেন অগোচরে এসে ঘুম পাড়িয়ে যেত পরম প্রশান্তিতে।
বর্ষার প্রারম্ভে নদীর বুকে ছিল নতুন পানির দর্পিত পদধ্বনি, অনিমেষ চোখে চেয়ে থাকতাম নদীর পাড়বিস্তৃত কচুরিপানার সবুজ চত্বরে ফুটে থাকা হালকা বেগুনি রঙের কস্তুরি-ফুলসম্ভারে অবর্ণনীয় সৌন্দর্যরাশির দিকে। পদ্মার কোল থেকে জন্ম নিয়ে দুর্বার গতিতে যে জলরাশি এসে মিশে গিয়েছে ইছামতির কোলে, সেই ইছামতীর বুকে উত্তাল সাঁতার কেটে নদী পাড়ি দিয়েছি কতনা আনন্দে, বন্ধুদের সঙ্গে পানির উপড় টুপ-টুপ শব্দ তরঙ্গের খেলায় মেতে উঠেছি কত দিন। স্নান সেরে সময়ে উঠতে পারিনি কখনো, পাড়ে উঠতেই এক মুঠো কাদা এসে ছুঁয়ে যেতো পৃষ্ঠদেশে- বন্ধুদের আবদার, আর একটুক্ষণ...। ভোরের সুখনিদ্রা, রৌদ্রের খরতাপ অথবা বৃষ্টির অবিরল ধারা উপেক্ষা করে সাথিদের নিয়ে খেলার মাঠের সেই দুরন্ত চঞ্চলতা ফিরে আসবে না আর কোনো দিন। সেই খেলার সাথিরা আজ কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে জীবনের টানে, কে জানে। বাস্তবতার প্রহসনে কত যুগ দেখিনি ওদের, বহুদিন মনেও পড়েনি ওদের... অথচ কি প্রিয় ছিল সেইসব খেলার সাথি, সেইসব বন্ধুদের সাহচর্য, সেই দিনগুলি। নির্মল আনন্দে আপ্লুত হয়েছি প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত।
শরতের স্নিগ্ধ বাতাসে অবগাহন, যেন জুড়িয়ে যেত সমস্ত শরীর। নদীর ওপাড়ে পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা কাশফুলে বাতাস এসে দোল দিয়ে যেত, যেন আনন্দে হেলেদুলে নেচে উঠত একদল এলোচুল চঞ্চলা কিশোরীর মতো। কি চমৎকার ছিল প্রকৃতির সে শুভ্র কোমল স্পর্শ!
শীতের রাত জাগানিয়া শেষ প্রহরে, প্রাগুষায় ঘরের চালে টুপ-টাপ শব্দে ঝরে পড়ত শিশিরবিন্দু, যেন ছন্দোবদ্ধ এক মূর্ছনায় ঘুম পাড়িয়ে দিতে এসেছে শান্তিলোকের শান্তিদূত- আবেশে জড়িয়ে যেত সমস্ত উপলব্ধি! ভোরের শিশিরভেজা ঘাসের বুকে যখন এক ফালি সোনালি সূর্যের স্নিগ্ধ রশ্মি এসে মায়াবী স্পর্শে জাগিয়ে দিত ঘুম ঘুম পৃথিবীকে... এক মোহময়, অনির্বচনীয়, স্বর্গীয় দিপ্তীতে উদ্ভাসিত হয়ে যেত চারিদিক। যেন ঘাসের সবুজ চত্বরে মুঠো মুঠো মুক্তো ছড়িয়ে দিয়েছে কোনো রাজকুমারী। এখনো যেন অনুভব করি সেই শিশিরভেজা ঘাসের ওপর নগ্ন পায়ের শীতল স্পর্শ!
নানা রঙের সেই দিনগুলোতে ছিল নানা খেলার আয়োজন... রোদেলা দুপুরে আকাশের বুকে ছোট-বড় রঙিন ঘুড়িগুলো যেন আজও উড়ে বেড়াচ্ছে লাল, সাদা, হলুদ, বেগুনি নানা রঙের ঘুড়ি, লাটাই আর সুতোর টানে। পকেটে রঙিন মার্বেলের ঝন-ঝন শব্দ যেন আজও শুনতে পাই। ছোট্ট বেলায় খেজুরগাছের ডাল কেটে নেমে যেতাম ঘোড়া বানিয়ে গ্রামের পথ ধরে, কাঁচা আমের হলুদাভ বীজ দিয়ে বাজিয়েছি বাঁশি। মাঠে চুপিসারে পা টিপে সন্তর্পণে ধরেছি ছোট-বড় নানা রঙের ফড়িং, বাঁশের সরু শাখা (কঞ্চি) দিয়ে বানিয়েছি খেলার বন্দুক, গুলি ছিল প্রকৃতির লাহল গোটা। আজও সেই বাঁশের বন্দুকের আওয়াজ যেন কানে বেজে ওঠে। এত দিনে ভুলেই গিয়েছি নারকেলের পাতা দিয়ে হাতচড়কি অথবা কাগজ দিয়ে নৌকো বা উড়োজাহাজ বানানোর কৌশল। এ ছাড়াও আরও কত খেলায় কেটে গিয়েছে আমাদের ছোটবেলার সেই সুন্দর সময়, কিন্তু আজ সবই বিলীন হয়ে গিয়েছে সময়ের প্রবাহে। আজকের আধুনিক যুগের পরিবর্তনের ধারায় প্রযুক্তির প্রভাবে বদলে গেছে আমাদের জীবনযাপন, আনন্দের ধরন—ভিন্ন সংস্কৃতির খড়স্রোতে হারিয়ে গেছে সেই সব নির্মল আনন্দের সরল আয়োজন।
আজ আর আমাদের গ্রামে খোলা আকাশ নেই, খেলার মাঠে যুবকদের তারুণ্যভরা উপস্থিতি নেই, নিয়মিত খেলার আয়োজন নেই, মাঠের পাশে সড়কের পাড়ে শান্ত বিকেলে বসে থাকা সেই সব চেনামুখ অগ্রজরাও আর নেই। চলে গেছেন পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে চিরতরে।

প্রতীকি ছবি৷ সংগৃহীত
প্রতীকি ছবি৷ সংগৃহীত

এই তো দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির উঠোনে, তাকিয়ে আছি বাঁশঝাড়ের দিকে... একটা বুলবুলি পাখি গাছের এ-শাখা থেকে অন্য শাখায় উড়ে বেড়াচ্ছে। কয়েকটি শালিক বসে আছে পাশের বেলগাছের ডালে- দুটো শালিক একসঙ্গে দেখলে এখন আর মানুষ চিঠির আশায় থাকে না, চিঠি আর কেউ লিখে না এখন। ছেলেবালার সেই সরগরম বাড়িটা আজ কেমন নিঃস্তব্ধ! কী প্রাণ ছিল এই বাড়িতে, জীবনের কী উচ্ছ্বাস ছিল, প্রাণের কী প্রাচুর্য ছিল সর্বত্র। এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছুটিতে বাড়িতে এসে উঠোনে মোড়ায় বসে থাকা বাবার সেই বলিষ্ঠ, শান্ত-সৌম্য চেহারা, রান্নাঘরে আগুনের তাপে মায়ের ঘর্মাক্ত শরীর, স্নেহভরা সেই হাসিমাখা মুখ। পুরো পৃথিবীর ভালোবাসা যেন উপচে পড়ত ওই চির প্রিয় মুখটাতে। শুধু আবাস নয়, বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা এই ঘরটিই ছিল আমাদের স্বর্গের ঠিকানা! পরিবারে সবাই ভালোবাসার ছোঁয়ায় স্নাত হয়েছি প্রতিদিন, প্রতি মূহূর্ত। কোমল স্নেহ, স্নিগ্ধ ভালোবাসা আর পরম মমতায় ঘেরা ছিল আমাদের সেই পারিবারিক স্নেহনীড়। আজ ইতিহাস হয়ে, স্মৃতিকাতরতায় ন্যুব্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়জন হারানোর সমস্ত ব্যথা বুকে নিয়ে।
জীবনের নির্মল আনন্দ-উল্লাস, বন্ধুবাৎসল্য, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, সম্প্রীতি, প্রতিবেশী প্রেম, আত্মীয়দের স্নেহ-মমতা, গুরুজনদের আশীর্বাদ—সবই এসেছে জীবনের অংশ হয়ে, অথচ সময়ের আবর্তনে হারিয়ে গেছে সেই অমূল্য সময়, ছেলেবেলার সেই সুন্দর জীবন। সুস্থ জীবনধারার বিশুদ্ধ বাতাস বইতো আমাদের সেই সময়ের পারিবারিক ও সামাজিক বলয়ে, কী গভীর ছিল আত্মার বন্ধন! ভাবতেই সমস্ত অনুভূতির সীমান্তে অনুভব করি এক অনির্বচনীয় শিহরণ—প্রশান্তির ছায়ায় পরিপ্লুত ছিল সেসব দিন, সেসব ক্ষণ। আজ মনে হয় সেদিন যদিও আজকের মতো করে উপলব্ধি করার বোধ ছিল না, কিন্তু স্মৃতির দিগন্তে সেই দিনগুলো এখনো জীবন্ত, অনুভবে আজও সেই স্পর্শ! আমি হারিয়ে গিয়েছি সেই স্বর্গলোকে, যেখানে আমার জীবনের সমস্ত সুখ, শান্তি, আনন্দ ভালোবাসা, স্নেহ, অনুভব... আমার অস্তিত্ব, আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা।
হঠাৎ করে থেমে গেল সুরেলা কণ্ঠে কবিগুরুর হৃদয়স্পর্শী গান। সংবিৎ​ ফিরে পেয়ে চোখ খুলে তাকালাম, দেখি টিভির পর্দায় নির্বাক হয়ে আটকে আছে শিল্পীর স্থিরচিত্র...রেকর্ড করা অনুষ্ঠানটি শেষ হয়ে স্থিরচিত্রটি আটকে আছে, যেমন করে আমি এই মুহূর্তে আটকে আছি স্মৃতির ক্যানভাসে অদৃশ্য ছায়াচিত্রে। টিভির পর্দায় আটকে থাকা চিত্রটি এক মুহূর্তে দূর-নিয়ন্ত্রকে বোতাম টিপে মুছে ফেলা যায়, কিন্তু স্মৃতিকে মুছে ফেলা কিছুতেই সম্ভব নয়, চাইলেও নয়, স্মৃতির মধ্যেই আমাদের অস্তিত্বের ফেলে আসা সময়ের ছায়াচিত্র। মাথার পেছন থেকে অতিরিক্ত বালিশটা সরিয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছি, পাশে ওরা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। প্রবাসে থেকেও এ মুহূর্তে আমি আর প্রবাসে নেই- ফিরে গিয়েছি আমার প্রাণপ্রিয় সেই গ্রামে, এই সময়ে বর্তমান থেকেও আমি আর এই সময়ে নেই। ফিরে গেছি আমার সেই প্রিয় ছেলেবেলায়। আমার মনের গভীরে মৃদুস্বরে বেজে চলেছে... আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার টুকরো স্মৃতির সিম্ফনি!
পিউস গমেজ
উডব্রিজ, ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র