টিট ফর ট্যাট
গত দুই বছর গোটা বিশ্ব কমবেশি করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে হারিয়েছে প্রিয়জনকে। বিশ্ব যখন কিছুটা হতাশা কাটিয়ে আশার দিশা দেখতে শুরু করেছে, ঠিক তেমন একটি সময় ইউরোপ শত বছর আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। জার্মানের হিটলার ইতিহাসের পাতায় শত বছর বিরাজ করবেন, তা কি হয়? প্রযুক্তির যুগের ভয়ংকর চরিত্র পুতিন, যাঁকে একদিন বিশ্ব বরণ করেছিল ফুলের মালা দিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে চুরমার করেছিল যে দেশগুলো আজ, সেসব দেশ কিছুটা হতভম্ব হয়ে দেখছে পুতিনের খেলা। আমেরিকা পৃথিবীর জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ, তা আর বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। তবে পুতিনের কুরুক্ষেত্র বিশ্বকে বড় আকারে নাড়া দিয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয় এখন।
আমি সুইডেনে সুইডিশদের মনমানসিকতা লক্ষ করছি। স্বাভাবিকভাবেই কেউই কোনোভাবে ইউক্রেনে হামলাকে সমর্থন দিচ্ছে না। পুরো বিষয়ের নিন্দা করছে সবাই। ছোট–বড় সবাই বেশ চিন্তিত। কারণ, ঘটনা ঘটে চলেছে বাড়ির পাশে। করোনায় ইউরোপের অনেক ক্ষতি হয়েছে, অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় শত বছর আগের হিটলারের চরিত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটবে, এটা কেউ ভাবতে পারেনি। তবে ইউরোপ–আমেরিকার কূটনৈতিক কাজকর্ম গোটা বিশ্বকে দৌড়ের ওপর রেখেছে এত বছর ধরে।এবার তাদের নিজেদের দৌড়ানোর পালা, যা আমি দেখতে পাচ্ছি। আমার এ কথায় অনেকে প্রথমে একটু হোঁচট খাবে, পরে পুরো লেখা পড়ার পর মত-দ্বিমত হবে। হলেই ভালো, তা না হলে ধরে নেব আমরা ভাবতেও ভুলে গেছি।
যা হোক, ইউরোপে যুদ্ধ শীতের সময় যখন তেল, গ্যাস ও জ্বালানির দাম বাজারে চড়া। জার্মান তার প্রয়োজনের অর্ধেকের বেশি গ্যাস কিনে থাকে রাশিয়ার থেকে। আমেরিকা ও ইউরোপ নানাভাবে জব্দ করতে চেষ্টা করছে রাশিয়াকে, কিন্তু রাশিয়াও জানে গ্যাস বন্ধ হলে জার্মানসহ পুরো ইউরোপের অর্থনৈতিক বিশাল ক্ষতি হবে ইত্যাদি। এ যুদ্ধে চীন হয়তো জয়ী হবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যেমনটি হয়েছে করোনার সময়।
আমি বেশ ভাবতে শুরু করেছি! বিশ্বের অনেক দেশেই কিন্তু যুদ্ধ বিরাজমান অথচ টিভির পর্দায় সেসব আলোচনা হয়ই না বললে চলে। যুগে যুগে এই ইউরোপ, আমেরিকাই কিন্তু অস্ত্র বিক্রি করে আসছে বিশ্বের মানুষের কাছে। সেই অস্ত্রে পৃথিবীর মানুষ একে অপরকে ধ্বংস করছে!
পুতিনের ইউক্রেন হামলার আগে যেভাবে সবাই কথা বলেছিল বা ওয়াদা করেছিল, সেটা এখন পুরোপুরি কার্যকর হবে বলে মনে হচ্ছে না। ইউক্রেনকে নিজেই সামলাতে হবে এই ঠেলা। সবাই এখন বুঝতে শুরু করেছে পুতিন যে কোনো অঘটন ঘটাতে দ্বিধাবোধ করবে না, অতএব অন্য কেউ নাক গলাতে এলে খবর আছে।
আমি যে জিনিস বেশি লক্ষ করছি, সেটা হলো সুইডেনের ভূমিকা কী? সুইডেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেনি। আলফ্রেড নোবেলের ডিনামাইট ব্যবহার করা হয়েছে তৎকালীন বিশ্বযুদ্ধে। সুইডিশ জাতি তার ট্রেডিশন ভঙ্গ করবে না। তবে ইউক্রেনকে মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করবে। গতকাল থেকেই সুইডিশ রাজনৈতিকদের চিন্তা এক হয়ে গেছে। সরাসরি যুদ্ধের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে সঠিক উত্তর নেই, তবে সাহায্য করতে হবে, এ বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই।
গত দুই বছর করোনা মহামারির কারণে বিশ্ব বেশ পিছিয়ে পড়েছে এবং এই ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই নতুন ধাক্কা, যা গোটা বিশ্বের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে আমি মনে করছি।
এবারের যুদ্ধে জয়–পরাজয় বড় কথা নয়, এ যুদ্ধে মানুষে মানুষে ঘৃণা বেড়ে যাবে অতীতের চেয়ে বেশি। যে সোভিয়েতকে ভেঙে চুরমার করেছিল সেই সোভিয়েত কি আবার পুনরুজ্জীবিত হতে চলছে? পুতিনের কথায় সে রকমই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, পুতিন ন্যাটো জোট একেবারেই পছন্দ করছে না, এ বিষয় নিশ্চিত।
অন্যদিকে গোটা বিশ্বের সর্বত্রই আমেরিকার বাহাদুরি, এটাও তো ভালো কথা নয়। চীন ইদানীং বিশ্বায়নে ভালোমতো প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে, আমেরিকার আর আগের মতো একচেটে বাহাদুরির দিন নেই, সব মিলে পৃথিবীর অবস্থা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করছে। অনেকের প্রশ্ন ভারত, পাকিস্তান–চীন কি পুতিনকে ইন্ধন দিচ্ছে? জানি না বাংলাদেশ কোনো পথে, তবে সুইডেনের মতো ভূমিকা পালন করা কিন্তু খারাপ নয়।
সবশেষে বলতে চাই, স্বৈরশাসক পুতিন ইউরোপের শান্তি ধ্বংস করতে শুরু করেছে। অতীতে অনেক দেশ, যেমন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা বিশ্বের অনেক দেশকে টুকরা টুকরা করে তিলে তিলে ধ্বংস করেছে।
বাস্তবে প্রায় সর্বত্রই অধিকাংশ শাসক নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক। প্রতিদিন সেই শাসকেরা তাঁদের নিজ দেশে, তাঁদের নিজস্ব নাগরিকদের পুতিনের মতো টুকরা টুকরা করে শান্তি ধ্বংস করে চলেছেন! অতএব বর্তমানের প্রতিদিনই একটি দুঃখের দিন মানবজাতির জন্য এবং এর জন্য দায়ী বিশ্বের নেতারাসহ জাতিসংঘ।
লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন