টরন্টোয় বেঙ্গলি পারফর্মিং আর্টসের বর্ণিল উৎসব
‘রাখো তারে আলোকে/ রাখো তারে অমৃতে’
সব ভালো যার, শেষ ভালো তার। উচ্ছল ও যথাসময়ে প্রাণবন্ত যবনিকা ছিল এ বছরের টরন্টো সংস্কৃতি সংস্থা (টিএসএস) আয়োজিত ১৪তম বেঙ্গলি পারফর্মিং আর্টসের। জনপ্রিয় শিল্পী রূপঙ্কর বাগচির গান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে অত্যন্ত সফলভাবে শেষ হলো এ বছরের দুই দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসব। এ তো সত্যি, কোনো অনুষ্ঠান ও উৎসবের দর্শক-শ্রোতাই শিল্পীদের চালিকা শক্তি ও অনুষ্ঠানের প্রাণ। আর টিএসএসের প্রধানতম শক্তি তাদের দর্শক-শ্রোতা। মন উজাড় করে প্রণোদনা দিয়ে আসছেন টরন্টোর বাঙালি সংস্কৃতিমান ও শিকড়সন্ধানী বিদগ্ধজনেরা ফিবছর।
প্রতিবারের মতো এবারও অনুষ্ঠানে আয়োজনে ছিল মনকাড়া ও হৃদয়ছোঁয়া নৃত্য, গান, নাটক, ছোটদের উপস্থাপনা ও সেতার বাজনা। সময় ধরে ধরে, যার যার অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে। কোনো ব্যত্যয় নেই। নেই কোনো এলোমেলো ভাব। সব পেশাজীবী দৃষ্টিভঙ্গিতে করা। গোছানো পরিপাটি।
ভালোবাসা কারে কয়
ধারাবাহিক উৎসবের কী হয়? প্রথম বছর যেভাবে শুরুটা হয় দেখা যায় পরের বছর হয় সেটা আকারে–প্রকারে আড়ম্বরে বড় হয়, আর নয় তো আয়োজকদের উদ্দীপনায় ভাটা কিংবা নানাবিধ দলাদলির জটিলতায় উৎসবের রং ফিকে হয়ে আসে। টরন্টো সংস্কৃতি সংস্থার এই বার্ষিক পারফর্মিং আর্ট উৎসব দিনে দিনে ফিকে না হয়ে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। এবারকার চেয়ারপারসন শান্তনু চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি চৌকস, দক্ষ অভিজ্ঞ দলের নিরলস পরিশ্রমের কারণে এমন একটি উৎসব আয়োজন করা সম্ভব হয় বলে দর্শক-শ্রোতা-শুভানুধ্যায়ীদের অভিমত।
কেমন করে শুরুটা
২০০৪ সালে কয়েকজন আড্ডাবাজ বাঙালির চিন্তার ফসল টরন্টো সংস্কৃতি সংস্থার এই বার্ষিক পারফর্মিং আর্ট উৎসব। কফির আড্ডায় নস্টালজিক মনের গান-কবিতা-নৃত্যকে তুলে এনে এই প্রবাসে উপস্থাপন করা আর প্রজন্মকে বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করাই লক্ষ্য তাঁদের। তাই তো এখন বৃহত্তর টরন্টোর বাঙালিদের একটি অন্যতম সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে টরন্টো সংস্কৃতি সংস্থার এই বার্ষিক পারফর্মিং আর্ট উৎসব। ২০০৪ সালে দীপক অধিকারী, ২০০৬ সালে কবি ব্যানার্জি আর ২০১১ অরুণ চক্রবর্তীর হাত ধরে ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬–তে অরুণ বিশ্বাস (রাজকুমার) এবং ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে শান্তনু চৌধুরীর নেতৃত্বে দক্ষ–অভিজ্ঞ দলের নিরলস পরিশ্রমের কারণে এমন একটি উৎসব হচ্ছে ফিবছর।
প্রজন্মের প্রাধান্য
টিএসএসের লক্ষ্য এখানে বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে সুকুমারবৃত্তির চর্চায় উৎসাহ প্রদান ও প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে বাঙালিত্বের, মূল চেতনার এবং ঐতিহ্যের অধিকার সবার ভেতর ধারণ ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনের চেষ্টা। সে লক্ষ্যে প্রথম থেকেই একের পর এক শিশু-কিশোরদের প্রযোজনা আনছে মঞ্চে তারা।
উৎসবের প্রথম দিন
শনিবার (১৮ মে) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিশু–কিশোরদের ‘ইমাজিন’ অনুষ্ঠিত হয়। পরে টরন্টো সংস্কৃতি সংস্থার প্রযোজনা সৃজন চ্যাটার্জির গ্রন্থনা, নির্দেশনা ও এনাক্ষী সিনহার কোরিওগ্রাফি ও নির্দেশনায় হয় ‘কালারস অব উইন্টার’। এরপরে মঞ্চে আসেন নাট্য অভিনেতা গৌতম হালদার তাঁর গান ও আবৃত্তি সমন্বয়ে কবি জসীমউদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ নিয়ে। এরপরই আসে অর্পিতা দের নির্দেশনায় নাটক ‘আমব্রেলা’।
ঘণ্টাখানেক বিরতির পর মঞ্চে আসেন প্রথম দিনের আকর্ষণ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কণ্ঠশিল্পী ইমন চক্রবর্তী। তিনি রবীন্দ্রসংগীত, লোকগীতি, অহমীয়া, হিন্দি, আধুনিক গান গেয়ে দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিলেন গভীর রাত পর্যন্ত।
দ্বিতীয় দিন
রোববারের (১৯ মে) অনুষ্ঠান শুরু হয় নৃত্যের থিমেটিক প্রেজেন্টেশন ‘ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড’। এরপর ছিল হিন্দোল চ্যাটার্জির সেতারবাদন। পারমিতা রায়ের নির্দেশনায় ‘শেডস অব ইন্ডিয়া’ মঞ্চায়নের পর গানের দলের সঙ্গে মিউজিক্যাল ভয়েজারস উপস্থাপন করেন।
উৎসবের প্রধান আকর্ষণ রূপঙ্কর বাগচি। তিনি মঞ্চে ওঠেন বিরতির পরপর। একটানা প্রায় দুই ঘণ্টা দর্শক মাতিয়ে রেখেছিলেন রূপঙ্কর। রবীন্দ্রসংগীত ও আধুনিক গান পরিবেশন করেন রূপঙ্কর।
প্রকাশনা
প্রতিবছরের মতো এবারও দৃষ্টিনন্দন স্মারক বের করে টরন্টো সংস্কৃতি সংস্থা।
লক্ষ্মী যারা
টরন্টো সংস্কৃতি সংস্থার দুই দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে দর্শক-শ্রোতারা যেমন টিকিট কেটে সাহায্য করেছেন, ঠিক তেমনি বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপন দিয়ে, শুভানুধ্যায়ীরা-পৃষ্ঠপোষকেরা অর্থ অনুদান দিয়ে আর শিল্পী কলাকুশলীরা শ্রম-সময়-মেধা দিয়ে উৎসবকে করেছেন সার্থক-প্রাণবন্ত-উচ্ছল-রঙিন।
জয়তু টরন্টো সংস্কৃতি সংস্থা, জয়তু বাঙালি কৃষ্টি আর মেধা।
ছবি: বিদ্যুৎ সরকার