টরন্টোয় কবি আসাদ চৌধুরীকে নাগরিক সংবর্ধনা

টরন্টোয় নাগরিক সংবর্ধনায় কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে ভক্তরা। ছবি: নাদিম ইকবাল
টরন্টোয় নাগরিক সংবর্ধনায় কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে ভক্তরা। ছবি: নাদিম ইকবাল

১৬ তারিখ দিনটি ছিল টিমওয়ার্কের। প্রতিটি পদক্ষেপ অনুশীলনের।

সময়ের কোনো বারণ ছিল না কবি দেলওয়ার এলাহীর কাছে। হাতের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে কখনো সুমন রহমান তো কখনো সালমা বাণী। আবার কখনো দিলারা হাফিজ তো কখনো নুসরাত জাহান কবি আসাদ চৌধুরীর তথ্যগুলো দিয়ে সমন্বয় করেছেন। আবার সময় সময় তা জানাতে হচ্ছে সংবর্ধনা সভার আহ্বায়ক কবি ইকবাল হাসানকে।

ইথার তরঙ্গে বাক্যকে তাড়া করে দুপুর সন্ধ্যা গড়িয়েছে। তখনো তিনি প্রেসে বসা। কারণ আহমেদ হোসেনের আইডিয়ায় কবি আসাদ চৌধুরীর পঙ্‌ক্তি দিয়ে বুক মার্ক ছাপতে। যাতে কবির ভক্তকুল তাঁর কলমের আশীর্বাদ নিতে পারেন।

মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রকর তাজুল ইমামের করা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ব্যানার হাতে পেয়েই ফোন। একান্তই আমাদের নিজেদের মাটির সংলাপ, ‘হিমাদ্রী কই তুমি? সব পাইলাইছি হাতে।’

টরন্টোয় নাগরিক সংবর্ধনায় কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে ভক্তরা। ছবি: নাদিম ইকবাল
টরন্টোয় নাগরিক সংবর্ধনায় কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে ভক্তরা। ছবি: নাদিম ইকবাল

আ, কী শান্তি! গাড়ির দরজা ঠেলে বসতে বসতে দেলওয়ার এলাহীর হাসির ফোয়ারা, নিয়নের আবছা আলো উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। ভালোবাসার ডুবসাগরের কাঁচা সোনা বুঝি এমনই হয়।

কত কথা আছে আমাদের। কত গান আছে। কবিতা আছে। প্রীতির অঞ্জলি আছে অপেক্ষায়। এল ১৭ নভেম্বর রোববার। ছাড়পত্র হাতে নতুন ভোর। কবি আজাদ চৌধুরীর নাগরিক সংবর্ধনা। আমাদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশ করা হবে তাঁর কাছে।

অনুষ্ঠান ঘিরে বিগত দিনগুলোর শ্রম, মেধায়, মননে, আবেগে, আদরে প্রতিটি সমন্বয়, প্রতিটি অনুশীলন, দর্শকহৃদয়ের আগাম ছানবিন করে তাদের চাহিদা ও আয়োজকদের সাধ্যমতো আয়োজন তখনই অন্য মাত্রা পায়; যখন দর্শকের সময়সচেতন উপস্থিতি থাকে। যা কবি ও কবিতা অনুরাগী দর্শকেরা সেদিন চিনিয়েছেন আমাদের।

ঠিক চারটায় সুন্দরকে বরণ করেছি, যা সুন্দর তাই দিয়ে। ফুলের পাপড়ি বর্ষণের মধ্য দিয়ে। ‘কবি চায় না দান, কবি চায় প্রীতি কবি চায় অঞ্জলি’। পাকা চুল মাথায়, অপরাজেয় গোঁফ, জাম আর জামরুলের পাতার ফাঁকে লেগে থাকা লাজুক রোদ্দুরের মতো স্মিত হাসি মুখে, রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে প্রবেশ করেন কবি।

মঞ্চের ওপর পাশে বরাদ্দ টেবিলে বসে বুক মার্কে অটোগ্রাফ দেন ভক্তদের মাঝে। ‘মিট অ্যান্ড গ্রিট’ যা ছিল মঞ্চের নিচে অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব। এরপর কবিকে সামনে রেখে সবাই যার যার আসন গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সংগীতানুষ্ঠান। এ পর্যন্ত সঞ্চালনায় ছিলেন আহমেদ হোসেন।

টরন্টোয় নাগরিক সংবর্ধনায় কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে ভক্তরা। ছবি: নাদিম ইকবাল
টরন্টোয় নাগরিক সংবর্ধনায় কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে ভক্তরা। ছবি: নাদিম ইকবাল

প্রথম শিল্পী ছিলেন মুক্তি প্রসাদ। ঘরোয়ার চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কবি বলেছিলেন একদিন, ‘মুক্তি যাই গাক, যে রকম গাক, ও মন থেকে গায়’। গণমানুষের গান করেছেন সুমন সায়ীদ। যথারীতি গুরুদেবের গানে শান্তার শুরু। শান্তা কতটা ভালো গায়, তা মাপার যোগ্যতা আমার নেই। তবে সে গুরুদেবকে ভালোবেসে গায়, যা কবি প্রায়শই বলে থাকেন। গলা বসে গেলেও শুধু কবিকে ভালোবেসে গান গেয়েছেন নার্গিস চৌধুরী। সারাহ বিল্লাহর লালনের গান ভাবনালোকে ভাব জমিয়েছে। আর শাহজাহান কামাল ‘শুনি কেবল অবাক হয়ে শুনি, তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’।

মূলপর্ব কবিকে নিয়ে কথা, কবির কবিতা, কবির কথা। সঞ্চালক সুমন রহমান কবি ইকবাল হাসানকে সভাপতিত্ব করতে অনুরোধ করলে তিনি কবি আসাদ চৌধুরীকে পাশে বসিয়ে আসন অলংকৃত করেন। কবি দেলওয়ার এলাহীর শুভেচ্ছা বক্তব্যের পর সুমন রহমান সঞ্চালনার দায়িত্ব দেন দেলওয়ার এলাহীর ওপর।

এরপর একে একে কবিকে নিয়ে কথা, স্মৃতিচারণা আর মাঝে ছিল বাচিকশিল্পীদের পরিবেশনা।

নাগরিক সংবর্ধনায় উপস্থিতির একাংশ
নাগরিক সংবর্ধনায় উপস্থিতির একাংশ

শুভেচ্ছা বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে দিলারা নাহার, আসমা হক, আফিয়া বেগম, হোসনে আরা, ফারহানা আহমেদ, মেহরাব রহমান, আহমেদ হোসেন ও হিমাদ্রী রয় কবি আসাদ চৌধুরীর কবিতা আবৃত্তি করেন।

কবিপুত্র আসিফের গান আর কবিকন্যা নুসরাত জাহানের বাবাকে উৎসর্গ করা কবিতা শ্রোতাদর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। অনেকেরই চোখের কোণে দেখা যায় আবেগের অশ্রুবিন্দু।

কবিকে নিয়ে কথা বলেন শিল্পী তপন সাইয়েদ, কবি অশোক চক্রবর্তী, নৃত্যশিল্পী মুন্নি সোবহানী, কবি ড. দিলারা হাফিজ, বঙ্গবন্ধু পরিষদের, কানাডা শাখার সভাপতি আমিন মিয়া, কথাশিল্পী সালমা বাণী, কবি ফেরদৌস নাহার, কথাশিল্পী ফরিদা রহমান, সাংবাদিক শেখ শাহনেওয়াজ, লেখক সুব্রত কুমার দাস, নাট্যশিল্পী মাহমুদুল ইসলাম, এম এ মোমেন, দেশে বিদেশে টেলিভিশনের সিইও নজরুল মিন্টো।

নাগরিক সংবর্ধনায় উপস্থিতির একাংশ
নাগরিক সংবর্ধনায় উপস্থিতির একাংশ

সবার কথা শুনে অবশেষে মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং কবি। খুব সম্ভবত ২১ মিনিট স্বপ্নেরা মিছিল করে গেল। গালাগালিকে গলাগলি করার স্বপ্ন। ৩০ লাখ শহীদের উত্তরসূরিদের মর্যাদার জীবনের স্বপ্ন, ধর্ম ও বর্ণের পরিচয়ে যেন কারও মর্যাদা হানি না হয়। অসুস্থ পৃথিবী একদিন নিরাময় হয়ে উঠবে, দুষ্টচক্র দলিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা ঘরে ফিরে যাবে। আশাবাদ ব্যক্ত করেন, বঙ্গবন্ধুতনয়ার হাত ধরে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে। তারুণ্যের প্রতি অগাধ আস্থায় কবি বলেন, সব সময় সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে কালো চুলের মাথারা। তারাই ইতিহাস তৈরি করে। তরুণেরাই একদিন অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হবে, সংগঠিত হবে। মানবতা প্রতিষ্ঠা পাবে।

মুগ্ধতার এই আয়োজন সার্থক হয়েছিল তাদেরই জন্য যারা দীর্ঘ সময় বসে বসে ভাবনালোকের স্নিগ্ধতা ছড়িয়েছেন। উদ্‌যাপন কমিটির প্রতিটি মানুষের অভিজ্ঞতা ও উপদেশ ছুঁয়ে ছিল অনুষ্ঠানের পরতে পরতে। কবি ইকবাল হাসান সভাপতি ও সমাপনী বক্তব্যে এ কথাই তুলে ধরেন অনুষ্ঠানের শেষ কথায়।