১৯৭২ সাল। সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সিলেট শহরের শেখ ঘাট এলাকায় এক অবাঙালির পরিত্যক্ত বাসায় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সিলেট জেলা শাখার অফিস করা হলো। এটি ছিল মুজিব বাহিনীর সিলেট জেলার আঞ্চলিক প্রধান ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধানের অফিস। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আখতার আহমেদের অফিস। বৃহত্তর সিলেট জেলার মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠল এই অফিস। আখতার আহমেদ এই বাসার এক কক্ষে থাকতেন। অফিসের দায়িত্বে ছিলেন ছাতকের আবদুর রশীদ। তিনিও মুক্তিযোদ্ধা। ছাত্রলীগ নেতা, পরে জাসদের সিলেট জেলা শাখার কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। পরে এক সময় আমেরিকাপ্রবাসী হয়েছিলেন। সম্প্রতি মারা গেছেন। আর আখতার আহমেদ ১৯৮৫ সালে লন্ডনে মারা যান। মৃত্যুর আগে তাঁর আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। শুভাকাঙ্ক্ষীদের চেষ্টায় চিকিৎসার জন্য তাঁকে লন্ডন পাঠানো হয়েছিল। অল্প কিছুদিন বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ সিলেট নিয়ে যাওয়া হয়।
স্ত্রী ও এক ছেলে রেখে আখতার আহমেদ কপর্দকহীন অবস্থায় পরপারে পাড়ি জমান। সম্প্রতি জেনেছি, এই মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র নেই। আখতার আহমেদের মতো রাজনৈতিক নেতারা বৈষয়িক ছিলেন না। তাঁরা সনদপত্র বা খেতাবের জন্য যুদ্ধ করেননি। তাঁদের রাজনীতি ছিল জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য। আজ যেখানে সরকারি দলে যাওয়ার ও সরকারি দলের সুবিধা ভোগের মহাসমারোহ, সেখানে মরহুম আখতার আহমেদরা দেশ স্বাধীন করে প্রথমেই সরকারবিরোধী রাজনীতির সূচনা করেন। বাংলাদেশের অস্থির সময়ে তাঁদের দলের উত্থানের রাজনীতি ভুল না শুদ্ধ—ভবিষ্যতের ইতিহাসে তা নিয়ে চর্চা হবে। কিন্তু সেদিন তাঁরা যে স্বপ্ন বাস্তবায়নে ত্যাগ-তিতিক্ষা দেখিয়েছিলেন—তা ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ও মুজিববাদী ছাত্রলীগ—এই আদর্শ নিয়ে অন্যান্য জেলার মতো সিলেটেও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভাগ হয়ে যায়। ছাত্রলীগের লালা, তোফা, বাবুল মুজিববাদের ঝান্ডা তুলে ধরলেন। আর জেলা সভাপতি সদর উদ্দিন, লামা এবং আখতার আহমেদের নেতৃত্বে অন্য পক্ষ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের হাল ধরলেন। আর এই পক্ষে তরুণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন মুক্তিযোদ্ধা ম আ মুকতাদির। ম আ মুকতাদির চার নম্বর সেক্টরে সি আর দত্তের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে শহরের আশপাশে যুদ্ধ করেছেন। শহরে ঢুকেছেন বিজয়ীর বেশে। ম আ মুকতাদির ছাত্রজীবনের শুরুতেই সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি কোন সময় আপস করেননি। বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা আওয়ামী লীগেও তিনি যোগ দিতে পারতেন। সুযোগ-সুবিধার রাজনীতি যদি করতেন, ম আ মুকতাদির ভোগ-বিলাসে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারতেন। তাঁকে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়ে কষ্টের জীবন পার করতে হতো না। সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করতে গিয়ে আমৃত্যু বাসদের রাজনীতি ও লন্ডনে লেবার পার্টি করে গেছেন।
আমরা যখন স্কুলে পড়ি, তখন ‘এতটুকু আশা’ নামের একটি বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় গান ছিল, ‘তুমি কি দেখেছ কভু, জীবনের পরাজয়?’ মুকতাদিরকে নিয়ে লিখতে গিয়ে এই গানটির কথা মনে পড়ে গেল। কারণ আমিও তো দেখেছি, কত স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে গেছে। মুকতাদির ভাই ছিলেন, মুকুল বিকশিত হওয়ার আগেই ঝরে যাওয়া এক লড়াকু। এই প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাকে প্রথম দেখি শ্মশ্রুমণ্ডিত এক ক্ষুব্ধ তরুণ হিসেবে। পকেটে রিভলবার, আর হাতে উইলিস জিপের স্টিয়ারিং। রিলিফ নিয়ে ছুটছেন শহরের যতরপুর, টিলাগড়সহ এখানে-সেখানে। শহরের যেসব এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল, সে সব এলাকায় ত্রাণের গুঁড়ো দুধ, আটা, কম্বল ইত্যাদি দেওয়া হতো। সিলেট শহরের যতরপুর, ইন্দ্রানী পার, লালাদিঘির পাড়, টিলাগড় এলাকায় বড়দের সঙ্গে ত্রাণ নিয়ে গেছি। এত বছর পর সব আর মনে নেই। তবে মুকতাদির ভাইকে দেখেছি, অসম্ভব পরিশ্রমী এক মানুষ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে সহায় সম্বলহীন মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
আমরা তখনো স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। ১৯৭২ সালে ঢাকার পল্টন ও রেসকোর্সে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পরস্পর বিরোধী মতাদর্শ নিয়ে বাংলাদেশে সরকারি ও বিরোধী ধারার সূত্রপাত ঘটে। সিলেটে অন্যান্যের সঙ্গে সরকারবিরোধী ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্বে ছিলেন ম আ মুকতাদির। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠিত হলো সদ্য স্বাধীন দেশে যুব, তারুণ্যের রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। রাজৈনিতকভাবে প্রগতিশীল এবং কিছুটা কট্টরপন্থী ফোর্স ঝাঁকে ঝাঁকে নতুন দলে যোগ দিতে লাগল।
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল। বাংলাদেশের রাজনীতির এক অস্থির সময়। এ সময় ম আ মুকতাদির সিলেট অঞ্চলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করার পর জাসদের প্রকাশ্য রাজনীতি কঠিন হয়ে উঠে। জেলা পর্যায়ের নেতারা আটক হয়ে গেলেন। এ সময় অন্যদের নিয়ে জাসদ ও ছাত্রলীগের হাল ধরলেন ম আ মুকতাদির। কঠিন সময় ছিল তখন। এ সময় তিনি যুব-তরুণদের দলে আনতে সক্ষম হন। এরাই পরে ছাত্রলীগ, জাসদ, বাসদে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত জাসদ ও ছাত্রলীগের ওপর স্টিম রোলার চললেও সিলেটে জাসদ ছাত্রলীগ শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ঢাকসুতে মান্না-আখতার প্যানেলের বিজয়ে জাসদ ছাত্রলীগ আরও উজ্জীবিত হয়ে উঠে। ডাকসুর ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না এক সময় জাসদ ছেড়ে বাসদ গঠন করলে মা আ মুকতাদির বাসদের হাল ধরলেন। বিরাট তাঁর কর্মী বাহিনী। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করলেন। স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ম আ মুকতাদিরকে কারাগারে যেতে হয়। জীবনসংগ্রামের একপর্যায়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। কোন আশার আলো দেখছিলেন না। এ সময় তিনি বিয়ে করলেন। সংসার শুরুর আগেই এরশাদের পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। মুক্তি পেয়ে লন্ডন চলে যান। তাঁর নতুন সংসারে আসে সন্তান রাহাত। লন্ডনে এক ভঙ্গুর পথে তাঁর যাত্রা শুরু হলো। মুক্তাদির ভাইকে আমি তখন কাছ থেকে দেখেছি। ব্যক্তিগত জীবনের সব দুঃখকে আড়াল করে কমিউনিটির কাজ করতেন। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর শিশু রাহাতকে লালন-পালনে একইসঙ্গে মা ও বাবার দায়িত্ব পালন করতে হতো তাঁকে। একটি বয়স্ক কেন্দ্রে কাজ করতেন তিনি। সংসার চালাতে তাঁর এ কাজ যথেষ্ট ছিল না। তবু পরম মমতায় তিনি বয়স্কদের সেবা দিতেন। তাঁর হাতের রান্না আমরা অনেকবার খেয়েছি। সুস্বাদু এই খাওয়ার ভাগ আমার মতো অনেকেই পেয়েছেন।
ফুটবল অন্তঃ প্রাণ মুক্তাদির ভাই যুক্তরাজ্যে আর্সেনাল ফুটবল দলের কড়া সমর্থক ছিলেন। যেদিন মারা যান তার আগের দিনও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আর্সেনালের খেলার ধারাবিবরণী শুনেছিলেন। টাওয়ার হ্যামলেটসে লেবার পার্টির রাজনীতি করতেন। নিজে কাউন্সিলর না হয়েও অনেককেই কাউন্সিলর নির্বাচনে সাহায্য করেছেন। বাসদ যুক্তরাজ্য শাখার দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। বাংলাদেশের বাইরে যুক্তরাজ্যে বাসদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
১৯৯৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর লন্ডন বাংলা টাউন নামকরণের আগের কয়েক দিন বেশ পরিশ্রম করেন ম আ মুকতাদির। বুকের ব্যথা নিয়ে উদয়-অস্ত কাজ করেছেন। নামকরণের অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন সব কাজের অগ্রভাগে। এটাই তাঁর জীবনের শেষ অনুষ্ঠান, কমিউনিটির জন্য তাঁর শেষ কাজ।
১৪ সেপ্টেম্বর ম আ মুকতাদির হাসপাতালেই মারা যান। তাঁর মরদেহ লন্ডন থেকে সিলেটে পাঠানো হয়। তাঁকে সুরমা পাড়ে নিজ বাড়ির কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্মৃতি রক্ষায় ট্রাস্ট গঠন করেছেন অনুরাগীরা। সম্প্রতি তাঁর একমাত্র ছেলে রাহাত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে।
স্বপ্নবিলাসী এক তরুণ দেশের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধরেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নামেন। অসম এই লড়াইয়ের স্বপ্নচারী ম আ মুকতাদির চলে গেছেন, যেমন করে ফোটার আগেই মুকুলে ঝরে যায় ফুল। বিত্ত, বৈভব আর ব্যক্তিগত স্বার্থের চোরাবালিতে নিজেকে না হারিয়ে নিজে স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন অগুনতি যুব-তরুণকে। স্বপ্ন ঝরা এসব তারুণ্যের কাছে ম আ মুকতাদির ছিলেন বিপ্লবী এক লড়াকুর প্রতিচ্ছবি। দেশের মতো, প্রবাসেও নিজের জন্য কিছুই করেননি তিনি। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে। অসাম্য আর অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। রাজপথের এই স্বপ্নচারীর মৃত্যুবার্ষিকী আসলেই প্রতি বছর সতীর্থরা তাঁকে স্মরণ করেন নিজেদের মতো করে। তাঁর নামে গঠিত ট্রাস্ট সিলেটে চক্ষু শিবির থেকে শুরু করে নানা জনহিতকর কাজের মাধ্যমে তাঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আজকের প্রজন্ম একাত্তরের তরুণ এক যোদ্ধার কথা, সমাজে সাম্যের প্রতিষ্ঠায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া বীরকে সুযোগ পায়। ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মুকতাদির বেঁচে থাকুক তাঁর কাজের মধ্যে।
নজরুল ইসলাম, লন্ডনপ্রবাসী সাবেক ছাত্রনেতা ও সাংবাদিক।