ঝরা পাতার কাব্য

ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য
ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য

অস্ট্রেলিয়ার বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী এখন চলছে শরৎকাল। মার্চ, এপ্রিল ও মে—এই তিন মাস নিয়ে শরৎকাল। এর পরই শীতকাল। তাই প্রকৃতি তৈরি হচ্ছে শীতকে স্বাগত জানানোর জন্য। গাছে গাছে পাতার রং বদল শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে অনেক গাছ পাতা ঝরিয়ে নিচ্ছে নতুন পাতার আশায়। বাচ্চাদের স্কুল হলিডে চলছিল। সেই সঙ্গে অফিসের পঞ্জিকা অনুযায়ী গুড ফ্রাইডে ও এনজ্যাক ডের ছুটি মিলিয়ে আমিও টানা ১০ দিনের ছুটি পেয়ে গেলাম। তাই আর ঘোরাঘুরির জন্য আলাদাভাবে কোনো পরিকল্পনা করলাম না। ইচ্ছে ছিল একেক দিন একেক দিকে বেরিয়ে পড়ার।

২৫ এপ্রিল এনজ্যাক ডের ছুটি পড়ায় আমার মেয়ের বান্ধবী জেইনার মা বললেন, চলেন ওই দিন দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি। জেইনার বাবাও তাহলে সেদিন এনজ্যাক ডের অছিলায় ছুটি নিতে পারবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আমাদের সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যেহেতু স্কুল হলিডে চলছে, তাই ঘুম থেকে উঠতে বাচ্চাদের দেরি হয়ে গেল। তাই আমরা ঠিক করলাম কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যাওয়ার। জেইনার মা খুঁজে বললেন, আমরা ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসে যেতে পারি। আমরাও রাজি হয়ে গেলাম।

ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য
ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য

মিন্টো থেকে ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের দূরত্ব প্রায় দুই ঘণ্টার ড্রাইভ। মোটরওয়ে পার হয়ে আমরা যখন ভাবলাম হয়তোবা কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, তখনই গুগল ম্যাপ বলল, এই রাস্তায় আরও ৫৩ কিলোমিটার যেতে হবে। শুনে আমার মেয়ে হতাশ হয়ে পড়ল। আমি বললাম, তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো, কাছাকাছি এলে আমি তোমাদের ডেকে দেব। সত্যি কথা বলতে, এই দীর্ঘ রাস্তায় ড্রাইভ করাটা বাচ্চারা অনেক উপভোগই করল। দুই পাশে খোলা মাঠ। মাঠের মধ্যে কোথাও গরু, কোথাও ঘোড়া, কোথাও ভেড়া আবার কোথাও ছাগল চড়ে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ হঠাৎ মাঠের মাঝখানে পুকুরের মতো জলাশয়ও চোখে পড়ছিল। আর অনেক দূরে পাহাড়ের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল। এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর দুপাশে আপেলের খেতের সাইনবোর্ড চোখে পড়ছিল। সেখানে অনেক পরিবার এসেছে আপেল তুলতে। রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে সস্তায় আপেল পারসিমন পাওয়া যাচ্ছে, সেই মর্মে আরও কিছু সাইনবোর্ড আমাদের চোখে পড়ল। কিন্তু আমরা আর সময় নষ্ট না করে এগিয়ে গেলাম।

ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য
ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য

শেষের রাস্তাটুকু ছিল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কখনো উঁচুতে আবার কখনো নিচুতে যাওয়ার। এইভাবে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের রাস্তায় মোড় নিতেই রাস্তার দুই পাশের গাছে বিভিন্ন বর্ণের পাতার দেখা পেলাম। ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের ঠিক পাশের রাস্তার গাছগুলোতে মনে হচ্ছে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সব পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে আর গাছের তলায় যে পাতাগুলো পড়েছে, সেগুলো শুকিয়ে বাদামি বর্ণের মখমলের বিছানা মনে হচ্ছিল। এখন ছুটির মৌসুম হওয়াতে ভ্রমণপিপাসু মানুষের চাপ বেশি। তাই গার্ডেনে প্রবেশের রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা দূরে আমাদের গাড়ি পার্ক করতে হলো।

গাড়ি থেকে নামার পর বেশ কিছু দূর হেঁটে যেতে হয়। গার্ডেনের গেটেই টিকিটের ব্যবস্থা আছে। ১২ বছরের ওপরের বড়দের জন্য সাড়ে বারো ডলার করে টিকিটের দাম। তার নিচের বয়সের বাচ্চাদের প্রবেশ বিনা মূল্যে। আমরা দুটো টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। বাগানের ভেতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই শীতল বাতাসে গা-টা জুড়িয়ে গেল। গেটের ঢোকার মুখেই সারি করে দুই সারিতে ঝাউগাছ লাগানো। ঝাউগাছগুলোর গায়ে শেওলা জমে গেছে আর চূড়া একেবারে আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। চূড়ার দিকে তাকাতে চাইলে ঘাড়টাকে পুরোপুরি নব্বই ডিগ্রি বাকিয়ে ওপরে দেখতে হয়।

ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য
ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য

প্রবেশের সময় আমাদের হাতে একটা মানচিত্র দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা সেটা ধরেই এগিয়ে চললাম। বাগানের বধ্যে বর্ষীয়ান সব গাছপালা লতাপাতা ছাড়াও আছে কিছু সিঁড়ি, একটা কূপ, একটা বড় শাপলার টব, যেখানে পানি দিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আছে দুটো ইটের তৈরি দেয়াল। একটা ঘেরা জায়গার মধ্যে আছে ল্যাভেন্ডারের ছোট্ট একটা বাগান, সেখানে অনেক মৌমাছি ব্যস্ত মধু সংগ্রহ করতে। একটু চুপচাপ থাকলেই তাদের গুঞ্জন কানে আসে। আর ঝাউগাছের তৈরি একটা সবুজ দেয়ালও আছে। আসলে এখানে এসে পরিকল্পনা করে ঘোরার দরকার নেই। এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালেই মনটা আপনা-আপনি শান্তি হয়ে আসে। জেইনারা রাস্তায় এক জায়গায় থামার কারণে আমাদের আগে রওনা দিয়েও তখনো এসে পৌঁছায়নি। তাই আমরা একা একা ঘোরাঘুরি করছিলাম।

ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য
ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য

এখানে এসে সবচেয়ে বেশি খুশি হলো রায়ান। সে মাটি, ঘাস, লতাপাতা নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। তাই এখানে খোলা জায়গা পেয়ে আমার কাঁধ থেকে নেমে গিয়ে গাছের তলার পাতার বিছানায় খেলা শুরু করল। আমি একেবারে সটান হয়ে পাতার মধ্যে শুয়ে পড়েছি দেখে সে এসে আমার পেটের ওপর বসে পড়ল। আমি বিভিন্ন রকমের গাছের পাতার ছবি তুলতে শুরু করলাম। এখানে এসে কত রকমের যে সবুজ আর কত রকমের হলুদ বা লাল বা খয়েরি রং দেখলাম, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আমি গাছের তলায় শুয়ে পড়ে ক্যামেরা ওপরের দিকে তাক করে ছবি তুলতে গিয়ে বুঝতে পারলাম আসল সৌন্দর্য দেখতে হলে আপনাকে আসলেই গাছের তলায় শুয়ে পড়তে হবে। নিচ থেকে ওপরে তাকালে মনে হবে আপনি একটা রঙিন ছাতার তলায় শুয়ে আছেন। সেই ছাতার ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছে। এই অনুভূতি প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই। কবি জীবনানন্দ হলে এই পাতা ঝরা নিয়ে নিশ্চিত কয়েক শ কবিতা রচনা করে ফেলতেন।

ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য
ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য

জেইনারা এসে আমাদের কল দিচ্ছিল কিন্তু বাগানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক খুবই দুর্বল তাই কথা শোনা যাচ্ছিল না। অবশেষে আমরা খুদে বার্তা দিয়ে জানিয়ে দিলাম বাগানের কোন জায়গায় আছি। ওরা আসার পর একটা আলো ঝলমলে খোলা জায়গায় বসে আমরা খেয়ে নিলাম, তারপর আবারও হাঁটা শুরু করলাম। ঝাউয়ের একটা দেয়ালের পাশ দিয়ে যাওয়ার পর একটা জায়গায় মানচিত্রে লেখা গ্রেট ওয়াল অব চায়না। সেখানে যাওয়ার পর আমাদের দৃষ্টি জুড়িয়ে গেল। লাল ইটের উঁচু দেয়ালের সঙ্গে এক ধরনের লতানো গাছ লাগানো, যেটা প্রায় পুরো দেয়ালকে ঢেকে ফেলেছে। সেই লতানো গাছের পাতাগুলোর গায়ে একেবারে রংধনুর রং লেগে আছে। কোনো পাতা সবুজ, কোনো পাতা লাল আবার কোনো পাতা বাদামি আবার অনেক পাতা এর মাঝামাঝি কোনো রঙের। সেই দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে সবাই পরিবার ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে ছবি তুলছিল। আমারও ছবি তুলে নিলাম।

ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য
ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য

গাড়ি চলাচলের রাস্তার দুপাশে বাগান। আমরা এই অংশটা শেষ করে মূল প্রবেশ পথ দিয়ে বের হয়ে অন্য পাশে চলে এলাম। সেখানেও অনেক মানুষ তাঁদের পরিবার পরিজন নিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। একটা ঝাউগাছের নিচের দিকে ডাল পেয়ে আমি জেইনা, তাহিয়া আর রায়ানকে গাছে চড়িয়ে দিলাম। জেইনার ছোট বোন জাহিয়াকেও উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে ভয় পেয়ে যাওয়াতে আর সেটা সম্ভব হলো না। গাছে ওঠার পর আর তারা কেউই নামতে চাইছিল না সহজে। পরে অনেক বুঝিয়ে তাদের গাছ থেকে নামানো হলো।

অবশেষে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। আপনিও আপনার পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে সারা দিনের জন্য যেতে পারেন ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসে। তবে খাবার আগে থেকেই কিনে বা রান্না নিয়ে যাওয়ায় ভালো। কারণ ওখানে আশপাশে কোনো রেস্তোরাঁ নেই। তবে পর্যাপ্ত টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। ফেরার পথে আমরা রাস্তার পাশের একটা দোকানে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। সেই সঙ্গে কিনলাম কফি আর পারসিমন। দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তি দূর করতে রাস্তার পাশে কিছুদূর পরপর এমন রেস্তোরাঁর দেখা মিলবে। আপনি চাইলেই সেখানে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করতে পারেন।

ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য
ব্রিনহোল্ড গার্ডেনসের সৌন্দর্য

নাগরিক ব্যস্ততায় আমাদের নিশ্বাস ফেলার ফুরসত মেলে না। তাই ছুটিগুলো আসে আশীর্বাদ হয়ে। আর ছুটি কাটানোর জন্য এমন জায়গা বেছে নেওয়া উচিত, যেখানে নাগরিক কোলাহল নেই। স্মার্টফোনটাও তেমন একটা কাজ করবে না নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে। আমরা দিনে দিনে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে এত বেশি অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি যে, কবে কখন প্রকৃতিতে ঋতু পরিবর্তন হয়েছে সেদিকে আমাদের খেয়াল থাকে না। স্মার্টফোনের রঙের মধ্যেই আমরা মনের রং খুঁজি কিন্তু প্রকৃতি যে হাজারো জীবন্ত রঙের ডালি সাজিয়ে রেখেছে, সেদিকে আমাদের খেয়াল নেই।