ঝরনা, নদী ও সবুজ পার্কে
যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে পার্ক। পার্ক এখানে বেড়ানোর ও খেলাধুলার জায়গা। কখনো পার্টিও করা হয়। অধিকাংশ আমেরিকান বিকেল থেকে রাতে ঘুমের আগ পর্যন্ত একটা বিশাল সময় পার্কে কাটান। বেড়াতে গেলেও পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে পার্ক।
ঘড়ির কাঁটা ধরে চলা প্রবাস জীবন। যান্ত্রিক জীবনে নিশ্বাস ভারী হয়ে এলে ছুটে যাই প্রকৃতির কাছে। কখনো পার্কে, কখনো পাহাড় ঘেঁষা সবুজ অরণ্যে কিংবা সমুদ্র তীরে। আমরা গিয়েছিলাম পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গে। নিউজার্সি থেকে পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গ প্রায় ৬০০ মাইলের ড্রাইভ। পথের দুপাশে প্রাচীর ঘেরা পাহাড়। পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজের সমারোহ। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝিকিমিকি সূর্যের আলো খেলা করছিল।
পিটসবার্গে পৌঁছাই দুপুরের শেষ ভাগে। অনেকটা উঁচু এলাকায় আটতলা ভবনের ছয়তলায় থাকে আমার ভাগনে রিয়াদ ও তাঁর স্ত্রী জিনিয়া। ছোট্ট সংসারে তাঁদের ফুটফুটে সন্তান আরাফ। ক্লান্ত ছিলাম দীর্ঘ জার্নিতে। কিন্তু যখন ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম, দেখলাম প্রকৃতির এ এক অন্য রূপ, সৌন্দর্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। এলাকাটা অনেকটা পাহাড়ি। পাহাড়ের ওপর সারি সারি গাছ। আর গাছের পাতারা যেন বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দোল খাচ্ছিল। নিচের দিকে তাকাতেই এক মনোরম দৃশ্য দেখতে পাই। রিয়াদ বলল, কাছেই মনরোভিল কমিউনিটি পার্ক। চলো যাই। তবে সেদিন আর যাওয়া হয়নি।
পরদিন বিকেলে গেলাম পার্কে। অসাধারণ সুন্দর সবুজে পরিবেষ্টিত পার্কটিতে রয়েছে পিকলবল, বাস্কেটবল, ভলিবল ও টেনিস কোর্ট। রয়েছে সংরক্ষিত পিকনিক প্যাভিলিয়ন, ফুটবলের মাঠ, জমজমাট সংগীতের আসর জমানোর মতো জায়গা, ইভেন্টের জন্যও একটি দুর্দান্ত জায়গা এই পার্কটি। পরিবারের সবাই মিলে আনন্দে মেতে উঠে এমন পার্ক থাকলে।
পার্কে অনুশীলনরত মানুষ। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে সবাই সবার মতো সময়কে উপভোগ করছে। কারও যেন কোনো তাড়া নেই। কিন্তু জানি, এখানে জীবন কত যান্ত্রিক। তবুও এমন পার্কে এলে মন হারিয়ে যায় মুগ্ধ পরিবেশে। বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করে না। প্রায় নয় দিন ছিলাম, প্রতিদিনই ওই পার্কে যাওয়া হয়েছে।
সৌন্দর্যের সমারোহ এখানেই শেষ নয়। বাসা থেকে আরেকটু দূরে গিয়েছিলাম পয়েন্ট স্টেট পার্কে। এক পাশে ঐতিহাসিক ঝরনা, অন্যপাশে বয়ে চলা নদী ও আরেক পাশে সবুজ মাঠ। মন কাড়া সুন্দরের ঝলকানি। পয়েন্ট স্টেট পার্ক একটি জাতীয় ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক। পেনসিলভানিয়া স্টেটের পিটসবার্গ অঙ্গরাজ্যে ৩৬ একর জায়গাজুড়ে অ্যালিগেনি এবং মনোনগাহেলা নদীর সঙ্গমস্থলে ওহাইও নদী। তিনটি নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত পয়েন্ট স্টেট পার্ক, পিটসবার্গের ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ এর অগ্রভাগে অবস্থিত। সেখানে ঝরনা হলো সবচেয়ে আকর্ষণীয়।
শত শত মানুষ পয়েন্ট স্টেট পার্কে নিজেদের মতো করে সময় কাটায়। যান্ত্রিক জীবনে মাপা পদক্ষেপে মানুষের জীবন যখন হাঁপিয়ে ওঠে, তখনই তারা ছোটে পার্কে বিশুদ্ধ বাতাসে নিশ্বাস নিতে। রিচার্জেবল ব্যাটারির মতো মানুষ যেন এনার্জি পায় এসব পার্কে এসে। প্রকৃতি তাদের আলিঙ্গন করে নেয়। মন হয়ে ওঠে সতেজ। পথ চলতে গিয়ে আর ক্লান্তি চেপে বসে না।
ঝরনার অপর পাশে বিরাট মাঠে বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ক্লান্ত মানুষেরা সবুজ মাঠে গা এলিয়ে উপভোগ করে সেসব অনুষ্ঠান। আর বাচ্চারা ছুটে বেড়ায় মুক্ত পাখির মতো। পেনসিলভানিয়া থেকে ফেরার সময় মাইলের পর মাইল দুই পাশের সেই সবুজঘেরা পাহাড়ি গাছ দেখে গান গাইছিলাম আপন মনে—‘পাহাড়ি বনে দেখেছি তারে এলোচুলে ঘুঙুর বাঁধা পায়।’
মন যেন পাখা মেলছিল প্রজাপতির মতো। লং জার্নিতে পথে বিরতি নিয়েছিলাম কিছুক্ষণ। আমাদের মতো শত শত মানুষ যেন প্রকৃতির সৌন্দর্যের অনুভূতি নিয়ে ফিরছে। পেছনে ফেলা আসা ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা বিদায় জানাচ্ছিল আমাদের। বাসায় ফিরতেই সন্ধ্যা নামে। নিয়নবাতির আলোরা জ্বলে ওঠে চারদিকে।