ঝগড়া ও পাগলামি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এখন দুপুর বারোটা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় ব্যস্ত। ঠিক এ সময় ফোন বেজে উঠল। ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ফোন রিসিভ করলাম।

: হ্যালো।

: হ্যালু ভাইজান, আমনে কেমুন আছেন?

: শেফালি, আমি ভালো আছি। তবে সমস্যা হচ্ছে, আমি এখন কথা বলতে পারব না। কারণ, আমি এখন খুবই ব্যস্ত।

: ভাইজান, আমনে এখন কই?

: আমি এখন আমেরিকায়। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে জরুরি মিটিং করছি।

: ভাইজান, আমনে আমরিকায়! কখন গেলেন? আমনেরে তো এখনই উত্তরায় আইতে হইবে।

: এখন তো আসতে পারব না। এখন মিটিং থেকে চলে গেলে ট্রাম্প চাচায় রাগ করবে। এই ব্যাটার মাথায় কিঞ্চিৎ সমস্যা আছে। বলা যায় না রাগ করে বাংলাদেশে বোমাও মেরে দিতে পারে। আমি এত বড় রিস্ক নিতে পারব না। অতএব খোদা হাফেজ।

বলে ফোনের লাইন কেটে দিলাম। একটু পর আবার ফোন এল। তবে এবার শেফালি না, এবার মা ফোন করেছেন।

: বাবা, তাড়াতাড়ি একটু উত্তরায় যা তো। তোর দুলাভাই আর বোনের মধ্যে নাকি আবার ঝগড়া লেগেছে।

: মা, আমি তো এখন যেতে পারব না। কারণ, আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত। তুমি বরং ভাইয়াকে পাঠাও।

: এই, তোর এত ব্যস্ততা কীসের রে? যখনই তোরে কোনো কাজের কথা বলি, তখনই তুই ব্যস্ত। এই মুহূর্তে তুই কী কাজে ব্যস্ত শুনি।

: মা জননী, আমি এখন নোবেল কমিটির একটা মিটিংয়ে ব্যস্ত আছি। এ বছর কারা কারা নোবেল পাবে, তাদের নির্বাচন করা হচ্ছে এই মিটিংয়ে।

: শোন, সব সময় ফাজলামি করবি না। তোর ভাইয়া অফিসে, না হলে তোর মতো পাগলরে আমি অনুরোধ করতাম না। শোন, এবারের ঝগড়া কোনো সাধারণ ঝগড়া না। শেফালি ফোন করে বলল, তোর দুলাভাই নাকি তোর বোনকে খুন করবে বলে হুমকি দিয়েছে।

: তাহলে আর আমি গিয়ে কী করব। তুমি বরং র‌্যাবে ফোন দাও।

: তুই কি যাবি, নাকি আমি তোর বাবাকে ফোন দেব?

: মা, আমি বলেছি র‌্যাবকে ফোন করতে, হিটলারকে না।

এই সময় ফোনে রিংয়ের শব্দ। তাকিয়ে দেখলাম শেফালি আবারও কল করছে।

: মা, তুমি ফোন রাখো। শেফালি কল করছে। আমি আগে ওর সঙ্গে কথা বলি। তারপর দেখি কী করা যায়।

: বাবা, শোন, উত্তরায় গিয়ে আবার কোনো পাগলামি করিস না। তোর কারও পক্ষ নেওয়ার দরকার নাই। শুধু দুজনের মধ্যে মিটমাট করে দিয়ে আসিস।

মার ফোন কেটে দিয়ে শেফালির ফোন রিসিভ করলাম।

শেফালি আপার বাসায় দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে। খুবই ভালো মেয়ে। তবে তার একটি সমস্যা হচ্ছে, সে সকল ব্যাপারেই অতি উৎসাহী। সে আমার অন্ধ ভক্ত। তার ধারণা, আমি হচ্ছি পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী একজন মানুষ। তার এই ধারণার কারণ কী, তা আমি জানি না।

: হ্যালো।

: হ্যালু ভাইজান, আমনে কি অহনো আমরিকায়?

: না, পাঁচ মিনিট আগে বাংলাদেশে চলে এসেছি।

: আলহামদুলিল্লাহ। আমনে তাড়াতাড়ি উত্তরায় আহেন। এই হানের অবস্থা খুবই খারাপ।

: তাড়াতাড়ি আসা যাবে না। এত দূর রাস্তা আসতে সময় লাগবে।

: ভাইজান, আমনে পারবেন। আমনে পাঁচ মিনিটে আমরিকা থাইকা বাংলাদেশে আইলেন। আর উত্তরা আইতে পারবেন না।

: এটা অবশ্য ঠিক বলেছ। আচ্ছা, আসছি।

: ভাইজান, আওনের সময় সঙ্গে কইরা জিনিসপত্র নিয়া আইসেন? আমাগো স্যাররে আজ একটু টাইট দিতে হইবে।

: ওকে। ডোন্টঅরি। তাকে আজ আচ্ছামতো টাইট দেওয়া হবে।

আমার দুলাভাই হাসেম সাহেব খুবই সহজ–সরল হাসিখুশি একটা মানুষ। অপর দিকে আমার বোন সেতু রাগী একটা মেয়ে। ভেজাল লাগানোতে খুবই ওস্তাদ। কারণে–অকারণে কয়েক দিন পরপর স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করা তার অভ্যাস। তবে সে তার স্বামীকে প্রচণ্ড ভালোবাসে।

উত্তরা পৌঁছে শেফালিকে কিছু নির্দেশনা দিলাম। তারপর দুলাভাইয়ের বিচারের জন্য ডাইনিং রুমে অস্থায়ী আদালত বসালাম। ডাইনিং টেবিলের এক প্রান্তে আপা আর অন্য প্রান্তে দুলাভাই বসলেন। আমি আমার ভাগনি রুম্পাকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের মাঝ বরাবর বসলাম। আমি সঙ্গে একটা কাচের প্লেট আর চামচ নিয়ে বসেছি। বিচারকদের মতো প্লেটে চামচ দিয়ে আঘাত করে অর্ডার অর্ডার বলার জন্য। মনে মনে ঠিক করলাম, প্রথম দিকে দুই দিকেই তাল দেব। কারও পক্ষ নেব না। শেষের দিকে দেখব যার জেতার সম্ভাবনা আছে তার পক্ষ নেব। কারণ, সবলের পক্ষে থাকাই নিরাপদ। বিচারের শুরুতেই চামচ দিয়ে প্লেটে আঘাত করে অর্ডার অর্ডার বললাম। তারপর বোনকে বললাম তার অভিযোগ পেশ করতে।

: ইমু শোন, গত সপ্তাহে ইউটিউব দেখে অনেক কষ্ট করে কাচ্চি বানিয়েছিলাম। খাবার সময় জিজ্ঞেস করলাম, রান্না কেমন হয়েছে। সে করল কী, মুখে কোনো উত্তর দিল না। কাগজ নিয়ে বাম হাতে লিখল ভালো হয়েছে। কত বড় অপমান তুই খেয়াল কর। লিখল তো লিখল, তা–ও বাম হাতে লিখল!

: দুলাভাই এটা কিন্তু ভারী অন্যায়। আপনি বাম হাতে কেন লিখলেন? আপনি জানেন না মানুষ বাম হাতে দিয়ে কী করে?

: ইমু শোনো, আমি তো তখন ডান হাত দিয়ে খাচ্ছিলাম। তাই বাম হাত দিয়ে লিখেছি। এখানে আমার দোষ কোথায়?

: আপা, দুলাভাইয়ের কোনো দোষ নাই। উনি ডান হাত দিয়ে খাচ্ছিলেন। সে কারণে উনি বাম হাত দিয়ে লিখেছেন। এটাকে অন্যায় বলা যাবে না।

: আমার প্রশ্ন সেটা না, আমার প্রশ্ন তাকে লিখে জানাতে হবে কেন? সে কি বোবা?

: দুলাভাই, আপা কিন্তু সত্য বলেছে। আপনি মুখে বললেন না কেন? আপনি কি বোবা?

: শোনো, প্রথমবার কিন্তু আমি মুখেই বলেছিলাম। কিন্তু তার একটা বদঅভ্যাস হলো, সে যখন কোনো কিছু বানিয়ে খাওয়ায়, তখন প্রতি দশ সেকেন্ড পরপর জিজ্ঞেস করে কেমন হয়েছে, কেমন হয়েছে। একই উত্তর কতবার দেওয়া যায় বলো? তাই কাগজে লিখে সামনে রেখে দিয়েছি। যখনই জিজ্ঞেস করবে তখনই উঠিয়ে দেখাব। বলো, কাজটা ঠিক করেছি না?

: জি দুলাভাই, আপনি ঠিকই করেছেন। আসলেই আপনার অনেক বুদ্ধি। আপনি যে একজন বিসিএস অফিসার, তা আপনার বুদ্ধি দেখলেই বোঝা যায়। আমি ইমপ্রেসড।

: ইমু শোন, আসলে ব্যাপারটা তা না। আসল কথা হলো, নিজের বউয়ের প্রশংসা করতে তার কষ্ট লাগে, তার মুখ ব্যথা করে। কিন্তু অন্য মেয়ে মানুষের প্রশংসা করতে তার কোনো কষ্ট হয় না।

: তাই নাকি? আপা তাহলে তো মনে হয় দুলাভাইয়ের চরিত্রে সমস্যা আছে।

: শোন, যেদিন আমি কাচ্চি রান্না করলাম, সেদিন পাশের ফ্ল্যাটের টিনা ভাবি এক বাটি আলুর ডাল দিয়েছিলেন। ওই বাটি ফেরত নেওয়ার জন্য পরদিন সকালে ভাবি যখন বাসায় আসলেন, তখন বজ্জাত ব্যাটা গদগদ হয়ে বলল, ভাবি, গতকাল আপনার আলুর ডাল খেয়ে মনে হয়েছে অমৃত খাচ্ছি। এর কাছে তো বিরিয়ানিও ফেল। এখন তুই বিচার কর, একটা মানুষ কতটা বদ হলে নিজের বউয়ের বিরিয়ানি ছেড়ে বেগানা মহিলার আলুর ডালে পাগল হয়।

: আপা, আমার আর কোনো সন্দেহ নাই, আমি এখন এক শত ভাগ নিশ্চিত, দুলাভাইয়ের চরিত্রে সমস্যা আছে। উনি সম্ভবত পরকীয়ায় আসক্ত।

: ইমু, তোমার আল্লাহর দোহাই লাগে, তুমি আর প্যাঁচ লাগিয়ো না। ডালের প্রশংসার সঙ্গে পরকীয়ার কী সম্পর্ক? আচ্ছা ইমু, কারও প্রশংসা করা কি অন্যায়?

: অবশ্যই অন্যায় না। দুলাভাই, আপনি ঠিকই করেছেন। আপনার চরিত্র ভালো। আপনি একজন চরিত্রবান মানুষ।

: কী বললি, সে ঠিক করেছে? শোন, প্রশংসা করেছে সেটা অন্যায় না। সে কেন বলল বিরিয়ানির চেয়েও মজা হয়েছে। এটা তো সরাসরি আমার কাচ্চিকে অপমান করা।

: অবশ্যই অপমান। ঘোর অপমান। দুলাভাই, এটা আপনি করতে পারেন না। ছি, দুলাভাই ছি, আপনি নিজের বউয়ের বিরিয়ানি বাদ দিয়ে অন্যের বউয়ের আলুর ডালে চোখ দেন! আপনার লজ্জা থাকা উচিত। আমি আপনার মতো এমন লুইচ্চা এ জীবনে আর দেখিনি। ছি, ছি, ছি, ছি।

: ইমু, তোমার সমস্যা কী? তুমি তো দেখি দুদিকেই তাল দিচ্ছ। তুমি তো ঝগড়া থামানোর চেষ্টা না করে বাড়ানোর চেষ্টা করছ। এনি ওয়ে, তোমার সঙ্গে আসলে কথা বলা বৃথা। এর থেকে আমি তোমার বোনের সঙ্গে কথা বলি, সেই ভালো। সেতু শোনো, তুমি ঠিকই বলেছ, বিরিয়ানির চেয়েও ভালো হয়েছে—এ কথাটা বলা আমার ঠিক হয়নি। তবে বিশ্বাস করো, আমি তোমার কাচ্চিকে মিন করে এটা বলিনি। তারপরেও যেহেতু তুমি এ কথায় কষ্ট পেয়েছ, সে জন্য আমি সরি।

: আপা, দুলাভাই সরি বলেছেন। ওনাকে মাফ করে দে। উনি একজন ভালো মানুষ।

: না, ও ভালো না, ও একটা বদ মানুষ। সরি বললেই সবকিছু ঠিক হয়ে যায় না। ওকে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে।

: দুলাভাই শোনেন, আপা ঠিকই বলেছে, সরি বললেই সবকিছু ঠিক হয়ে যায় না। আপনি একটা বদ মানুষ। আপনাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।

: তোমার কী ধারণা, তোমার বোন আমাকে শাস্তি না দিয়ে রাখছে? সাত দিন ধরে তো আমি শাস্তির মধ্যেই আছি। আমার জন্য এখন বাসায় ভাত-রুটি সব বন্ধ। আমি যখনই তার কাছে খাবার চাই, তখনই সে আমাকে এক বাটি আলুর ডাল ধরায়ে দেয়। এমনকি এখন চা চাইলেও সে কাপে করে আলুর ডাল দিচ্ছে। বলো, এক আলুর ডাল আর কত খাওয়া যায়।

: এত অল্পতেই তোমার আলুর ডাল খাওয়ার শখ মিটে গেল? শোনো, আমি ঠিক করেছি, তোমারে বাকি জীবন আমি শুধু আলুর ডাল খাওয়ায়ে রাখব। আমি দেখতে চাই, তুমি কত আলুর ডাল খেতে পারো।

: দেখেছ তোমার বোনের অবস্থা। এভাবে কেউ কাউকে নির্যাতন করে? এ জন্য আজ রাগ করে বাসার রান্না করা সব আলুর ডাল ফেলে দিয়েছি। শুধু তা–ই নয়, বাসায় যত আলু ছিল, তা–ও ফেলে দিয়েছি। আর বলেছি, এখন থেকে আমার বাসায় আলু কেনা বন্ধ। যে কিনবে তাকে আমি খুন করে ফেলব। এটা একটা কথার কথা বলেছিলাম। কিন্তু সে এটাকেই ইস্যু বানিয়ে সবাইকে বলছে, আমি নাকি তাকে খুন করব বলেছি।

: আপা, দুলাভাই তো কথার কথা বলেছে। উনি তো সত্যি সত্যি খুন করবে বলেনি।

: না, এটা কথার কথা না। সে এটা সিরিয়াসলি বলেছে। ইমু, তোর ওর কথায় কান দেওয়ার কোনো দরকার নাই। তুই এখন তোর রায় শোনা।

: ইমু, খবরদার উল্টো-পাল্টা রায় দিবা না।

আমি আবার চামচ দিয়ে প্লেটে কয়েকটি আঘাত করে বললাম, অর্ডার, অর্ডার। দুলাভাই, আমি কোনো উল্টো-পাল্টা রায় দেব না। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। আমি অনেক ভালো রায় দেব। আমি অনেক উঁচু লেবেলের বিচারক। আমি দুই পক্ষের বক্তব্য শুনেছি। এখন বিজ্ঞ আদালত তার রায় দেবে। আপা আমার রায় হচ্ছে, তুই তোর স্বামীকে তালাক দিয়ে দে।

দুলাভাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ইমু, এটা কেমন রায়! এটা তোমার ভালো রায়! তুমি তো দেখছি, আমার সংসার ভাঙার চেষ্টা করছ। আমি বুঝি না, তুমি সব সময় মানুষকে ফালতু বুদ্ধি দাও কেন? সেতু, তুমি এই পাগলের পাল্লায় পইড়ো না। ও তোমাকে ভুল পরামর্শ দিচ্ছে।

: না, ইমু সঠিক রায় দিয়েছে। আমি এইমাত্র আমার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি তোমার মতো বদমাশের সঙ্গে আর সংসার করব না।

: সেতু শোনো, সংসার না করলে না করবা। কিন্তু খবরদার মেয়ের সামনে মুখ খারাপ করবা না।

: অবশ্যই করব। মেয়েরও জানা উচিত তুই কেমন খারাপ মানুষ।

: আমি বুঝলাম না, তুমি আমাকে তুই–তোকারি করছ কেন?

: তোর সৌভাগ্য যে বাংলা সাহিত্যে তুইয়ের নিচে আর কিছু নাই। থাকলে সেটাই তোকে বলতাম।

: আপা এক কাজ কর, তুই দুলাভাইকে ওই ব্যাটা ওই ব্যাটা বলে সম্বোধন কর। আমার ধারণা, এটা তুইয়ের নিচে।

: ধন্যবাদ ভাই। এখন থেকে তাই বলব।

: খবরদার সেতু, তুমি আমাকে ওই ব্যাটা ওই ব্যাটা বলবা না। মেয়ের সামনে এমনিতেই অনেক বাজে কথা বলে ফেলেছ। প্লিজ, আর মুখ খারাপ করো না।

দুলাভাই শান্ত স্বরে বললেন।

: মুখ খারাপের কী দেখেছ। তোমার ভাগ্য ভালো যে মেয়ে সামনে আছে। না হলে তোমারে আরও কঠিন কঠিন গালি দিতাম।

আমি দুই হাতে আমার ভাগনির দুই কান চেপে ধরে বললাম, আপা এটা কোনো সমস্যা না। তুই গালাগালি শুরু কর। এই দেখ, আমি তোর মেয়ের কান দুই হাতে চেপে ধরেছি। ও কিছুই শুনতে পাবে না।

আমার কথা শুনে দুলাভাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

: দুলাভাই, আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি এখন বিচারক। আপনি এভাবে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাতে পারেন না। এতে আদালত অবমাননা হয়।

দুলাভাই হতাশ কণ্ঠে বললেন, ইমু আমি বুঝলাম না, তোমার সমস্যা কী। আজ তুমি যখন বাসায় এলে, আমি তোমায় দেখে অনেক খুশি হয়েছিলাম। কারণ, আমি ভেবেছিলাম তুমি ঝগড়া থামাতে এসেছ। কিন্তু এখন তো দেখছি...।

: সরি দুলাভাই, আপনার ধারণা ভুল। আমি ঝগড়া থামাতে আসিনি। আমি এসেছি আপনাকে ধোলাই করতে।

: কী বললা! তুমি আমাকে ধোলাই করবা!

: দুলাভাই, অবাক হওয়ার কিছু নাই। আমি শুধু আপার সিগন্যালের অপেক্ষায় আছি। আপা ইশারা দিলেই আক্রমণ বলে আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমি কিন্তু সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি।

এ কথা বলেই আমার ব্যাকপ্যাক থেকে একটা নানচাক্কু বের করলাম। তারপর ইয়া উয়া ইয়াহু ইয়া বলে নানচাক্কুর এক প্রান্ত হাতে এবং অপর প্রান্ত বগলের মাঝে রেখে ব্রুসলির মতো চোখ-মুখ সরু করে, ভুরু কুঁচকে পোজ দিয়ে দাঁড়ালাম। খেয়াল করে দেখলাম, দুলাভাই বিস্ফারিত চোখে অবাক হয়ে আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন।

একটু পর উনি আপার দিকে তাকিয়ে বললেন, সেতু আমি বুঝলাম না, তোমার ভাইয়ের সমস্যা কী! ও সবকিছুতে এত রিয়াক্ট করে কেন? তুমি দুনিয়ায় আর কোনো লোক পাইলা না, ওরে খবর দিয়ে আনছ!

আতঙ্কে দুলাভাইয়ের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।

: দুলাভাই এত অল্পতে ভয় পেলে তো চলবে না। আপনি কাঁপাকাঁপি বন্ধ করেন। আপনাকে তো এখনো আসল জিনিস দেখাইনি। আমি শিওর, ওটা দেখলে আপনি ভয়ে কাপড় নষ্ট করে ফেলতে পারেন।

এ কথা বলে ব্যাগে নানচাক্কুটা রেখে ব্যাগ থেকে চাপাতি বের করলাম। তারপর ইয়াহু বলে আবার পোজ নিয়ে দাঁড়ালাম। খেয়াল করে দেখলাম, এবার দুলাভাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আপাও দুই চোখ বড় করে মুখ হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সম্ভবত তাঁরা দুজনেই কথা বলার ভাষা ও শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।

একটু পরেই আপা চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে মুখ খুললেন, আমি বুঝি না, মা সব সময় ভাইয়াকে না পাঠিয়ে তোরে পাঠায় কেন? ইমু, তোর অবস্থা তো দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে।

: আচ্ছা ইমু, তুমি আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। তুমি এসব জিনিসপত্র কেন নিয়ে আসছ?

দুলাভাই করুণ সুরে বললেন।

: শোনেন দুলাভাই, আমি কোনো কাঁচা কাজ করি না। আমি খবর পেয়েছি, আপনি আপাকে খুন করতে চেয়েছেন। তাই একজন খুনির মোকাবিলা করার জন্য আমি সব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। শুধু এগুলো না, আমি আমার হলের তিন বন্ধুকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। ওরা বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কল করলেই ওরা ওপরে চলে আসবে। দুজনের হাতে হকিস্টিক আর একজনের কাছে পিস্তল আছে। ওরা তিনজনই আমার হলের ক্যাডার।

: মাই গড! সেতু, তুমি তোমার ভাইকে সামলাও। এই পাগল যেকোনো সময় একটা অঘটন ঘটায়ে ফেলতে পারে।

: ওই, আমি তো তোকে বলিনি যে তোর দুলাভাই আমাকে খুন করতে চেয়েছে। তুই কার কাছ থেকে এই খবর পেয়েছিস?

: তা বলোনি। তবে আমি গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি।

: কে তোকে এই গোপন খবর দিল?

: সোর্সের কথা তো তোমাকে বলা যাবে না আপা। এটা খুবই গোপনীয় ব্যাপার।

: থাক তোর আর বলতে হবে না। আমি জানি এটা কার কাজ। শেফালি, ওই শেফালি, এদিকে আয়।

আপা চিৎকার করে শেফালিকে ডাকলেন।

: সরি আপা, শেফালিকে ডেকে কোনো লাভ হবে না। ও তোমার ডাকে আসবে না। কারণ, ও এখন আমার কমান্ডে আছে। আমার হুকুম ছাড়া ও এখন কারও কথা শুনবে না।

: মাই গড, তাই নাকি! হারামজাদা, ডাক তোর সৈনিকরে।

আমি শেফালিকে কমান্ডো বলে চিৎকার করে ডাক দিলাম। শেফালি হাতে একটা দা নিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল।

: এই, তোর হাতে দা কেন?

দুলাভাই অবাক হয়ে ধমক দিয়ে শেফালিকে প্রশ্ন করলেন।

: স্যার হুনেন, আমি এহন কুমান্ডো। আমারে ধমক দিয়া কুনু লাভ হইতো না। কুমান্ডোরা কাওরে ভয় পায় না। ইমু ভাই অহন আমার বস। আমার বস কইছে দাও নিয়া রেডি থাকতে। তাই আমি দাও নিয়া রেডি আছি।

দুলাভাই ভয়ে ঢোঁক গিলে মোলায়েম সুরে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু তুই দাও দিয়া কী করবি শেফালি?

: কী করমু মাইনে? বসে হুকুম দিলেই আমি আপনেরে দাও দিয়া কোপ দিমু।

এ কথা বলেই শেফালি ইয়াহু বলে হুংকার দিল। তারপর দা উঁচু করে ধরে পোজ দিয়ে আমার পেছনে দাঁড়াল। আমিও শেফালির সঙ্গে সঙ্গে আবারও ইয়াহু বলে হুংকার দিলাম।

: মাই গড। সেতু তোমার পাগল ভাই তো শেফালির মাথাও খারাপ করে ফেলেছে। প্লিজ, তুমি এদের সামলাও। না হলে এ পাগলেরা বাসায় রক্তারক্তি ঘটায়ে ফেলবে।

আপা কোনো কথা না বলে আমার আর শেফালির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। আসলে উনি বুঝতে পারছেন না, ওনার এখন কী করা উচিত। কিছুক্ষণ পর দুলাভাই আমার কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলেন। তারপরে কোমল স্বরে বললেন, ইমু ভাই আমার, তুমি এসব রেখে একটু শান্ত হয়ে বসো। মাথা গরম করার কোনো দরকার নাই। আসো, আমরা কথা বলি। কথা বলে সমস্যার সমাধান করি।

: দুলাভাই প্রথম কথা, আপনি আমার কাঁধ থেকে হাত সরান। আর দ্বিতীয় কথা, আপনি আমার সঙ্গে মধুর স্বরে কথা বলবেন না। কারণ, এতে কোনোই লাভ হবে না। বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের সহজে কেনা যায় না। আপনিও আমাদের কিনতে পারবেন না।

: ওকে, আমি তোমাকে কিনতে চাচ্ছি না। আমি তো তোমাকে পুরো ঘটনাটাই বলেছি। এরপরেও যদি তোমার মনে হয় আমি দোষী, তাহলে তুমি আর শেফালি মিলে ইয়াহু ইয়াহু করো। আমি কোনো বাধা দেব না। শালার হাতে মৃত্যু যদি আমার কপালে থাকে তো হবে। কী আর করা।

: কে আমার স্বামীরে খুন করবে? কার এত বড় সাহস? আয়, আমার স্বামীর গায়ে হাত দিয়ে দেখ। আমি তোদের কল্লা নামায়ে ফেলব। ইয়াহু ইয়া।

হুংকার দিয়ে আপা এসে আমাদের সামনে দুলাভাইকে আড়াল করে দাঁড়ালেন। ওনার হাতে বঁটি। খেয়াল করিনি এর মধ্যে উনি কখন রান্নাঘর থেকে বঁটি নিয়ে এসেছেন। ওনার চোখ-মুখ দেখে মনে হলো, উনি আসলেই যেকোনো সময় আমাকে আর শেফালিকে কোপ দিয়ে ফেলতে পারেন। আপা হাতের বঁটি নাচিয়ে নাচিয়ে ইয়াহু ইয়াহু বলে অনবরত হুংকার দিতে লাগলেন। আপার ইয়াহু শুনে আমি এবং শেফালিও আপার দিকে তাকিয়ে ইয়াহু, ইয়াহু বলে অনবরত হুংকার দিতে লাগলাম। সারা ঘরে শুধু ইয়াহু ইয়াহু ধ্বনি। দেখে মনে হচ্ছে আফ্রিকান দুটি জংলি দল যুদ্ধের ময়দানে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, আর একে অপরকে হুংকার দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে।

আপার হাতে বঁটি দেখে দুলাভাইয়ের চোখ আলুর মতো বড় বড় হয়ে গেছে। আমাদের দুই পক্ষের অস্ত্র হাতে ইয়াহু ইয়াহু চিৎকার শুনতে শুনতে উনি হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর হতাশ কণ্ঠে বললেন, মাই গড, এ আমি কোন ফ্যামিলিতে বিয়ে করেছি। এদের সবগুলোর মাথাতেই তো দেখি সমস্যা। এটা তো দেখি পুরাই একটা পাগল ফ্যামিলি।

দুলাভাই আমাদের ফ্যামিলিকে পাগল বলার সঙ্গে সঙ্গে আপার মেজাজ বিগড়ে গেল। উনি দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিলেন, কী বললা? আমরা পাগল ফ্যামিলি! তোর এত বড় সাহস। ইয়াহু।

আপার সঙ্গে সঙ্গে আমি আর শেফালিও ইয়াহু বলে হুংকার দিলাম।

দুলাভাই আমাদের এই অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। উনি ভয় পেয়ে নিজের বুকে থুতু দিলেন। তারপর এক দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লেন। আপা, আমি ও শেফালি বাথরুমের দিকে অস্ত্র হাতে এগিয়ে গেলাম। তারপর বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে কোরাসে ইয়াহু ইয়াহু হুংকার দিতে লাগলাম। শুনতে পেলাম দুলাভাই বাথরুমের ভেতর উচ্চ স্বরে অনবরত কাঁপা কাঁপা গলায় সুরা পড়ছেন।

হঠাৎ পেছন থেকে ভাগনি রুম্পা আমার জামা ধরে টান দিল। পেছন ফিরে তাকাতেই সে কিছু না বলে আমার হাতে একটা ফোন ধরিয়ে দিল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি মা কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। রুম্পা আমাদের অজান্তে বাসায় ভিডিও কল দিয়ে এতক্ষণ যা যা হয়েছে, সব তার নানি মানে আমার মাকে লাইভ দেখিয়ে দিয়েছে।

কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, মা জননী, তুমি এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?

: হা-রা-ম-জা-দা আমি তোকে উত্তরা এ জন্য পাঠিয়েছিলাম? তুই আজকে বাসায় আয়। তোর আমি পাবনা পাঠানোর ব্যবস্থা করতেছি।

বি: দ্রষ্টব্য: প্রতিটি পরিবারে এ রকম দু-একটা পাগল থাকলে মন্দ হতো না। তাহলে জীবনটা হতো টক-ঝাল-মিষ্টি। যান্ত্রিক এই আধুনিক পৃথিবীতে আমরা সবাই কেমন জানি দিন দিন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি।

বি: দ্রষ্টব্যের বিশেষ দ্রষ্টব্য: স্ত্রীর সামনে ভুলেও অন্য নারীর প্রশংসা করবেন না। রূপের প্রশংসা তো দূরের কথা, রান্নার প্রশংসাও করবেন না। তাহলে খবর আছে।
–––

লেখকের ই মেইল: <[email protected]>