জ্যোৎস্নাময় রাত আছে জোনাকি নেই

কুয়ালালামপুরের চায়নাটাউনে আমরা থাকি প্রায় চার-পাঁচ শ বাঙালি। পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় এ মার্কেটটি অনেকটা ঢাকার হকার্স মার্কেটের মতো। এখান থেকে খোলা আকাশ দেখা যায়। চায়নাটাউনে থাকার অনুভূতির অংশবিশেষ লিখছি এখানে।
ব্যবসায়ী বা সেলসম্যান হিসেবে শপিংমলে না থেকে খোলা আকাশের নিচে মার্কেটে থাকলে আলাদা মজা আছে। চাঁদ-সূর্য, রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, প্রকৃতির আলো-বাতাস সবই উপভোগ করা যায়। এক কথাই অনেকটা প্রাকৃতিক আবহাওয়ার সঙ্গে থাকা যায়। যেটা শপিংমলে সম্ভব নয়। শপিংমলে হলো বৈদ্যুতিক আলো-বাতাসে জীবন। বড়-বড় শপিংমলে থাকলে বাইরে নীলাকাশটা কখন যে মেঘলা হয়ে যায় খবরও থাকে না। প্রকৃতির মিষ্টি মিষ্টি হাওয়াও গায়ে লাগে না। বাইরে তুমুল বৃষ্টিতে শহর ভেজা ভেজা হয়ে গেলেও শপিংমলের ভেতরে খবর থাকে না।
খোলা মার্কেটে ভিন্ন পরিবেশ। খোলা আকাশে পাখিরাও উড়ে যায় খোলামনে। গত ১০ এপ্রিল রাতে কুয়ালালামপুর চায়নাটাউনের আকাশে হঠাৎ ভালো লাগার মতো কিছু দেখলাম। হ্যাঁ, দেখেছিলাম জ্যোৎস্না রাতের চাঁদ। মায়াবী চাঁদ। বহু দেশ ও জাতির পর্যটকে ভরা কোলাহলপূর্ণ জায়গায় থেকেও জ্যোৎস্না রাতের চাঁদ দেখতে পেরে ভালোই লাগল।
কৈশোরে এ রকম চৈত্রের রাতে গরমে ঘুম না আসলে চাঁদের আলোতে উঠোনে বসে গল্প বলা, কিচ্ছা (গল্প) শোনা কত মজার ছিল। মাসে যে কদিন চাঁদের আলো বেশি থাকে সে কয়দিন রাতের খাবারের পরে বাড়ির বাইরে রাস্তার পাশে ধানখেত সামনে নিয়ে বসে বন্ধুদের আড্ডা হতো বেশি। অথবা বাড়ির উঠোনে ছোট-বড় সবাই মিলে কিচ্ছা শোনা হতো।
শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে জীবন-জীবিকার খোঁজে ব্যস্ত যৌবনে জ্যোৎস্না রাতের রুপালি চাঁদের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো হয় না আর সহজে। কত শত বিষয় এসে কখন যে চোখ সরিয়ে দেয় চাঁদের দিক থেকে খেয়ালও হয় না। জ্যোৎস্না রাত কখন আসছে, কখন যাচ্ছে, প্রবাসজীবনে এগুলো কারও মনেই থাকে না। জ্যোৎস্না রাতের রুপালি চাঁদ দেখে রোমান্টিক হয়ে যাওয়ার সময়-সুযোগও তেমন নেই প্রবাসে। কারও করো হয়তো আছে। তবে বেশির ভাগের সুযোগ হয় না। কখনো হঠাৎ যদি জ্যোৎস্না রাতের চাঁদে নজর পড়ে যায় তখনই দেখা হয় চাঁদ। মায়াবী চাঁদ, চিরপরিচিত চাঁদ।
দেশে-দেশে প্রকৃতির রূপে ব্যতিক্রম থাকলেও চাঁদের রূপ কিন্তু পৃথিবীর সব প্রান্তে একই। তবে এখানে একটা জিনিস দেখিনি কোনো দিন। তা হলো জোনাকি। আসলে জোনাকির কথা কখনো খেয়াল করিনি। আজ জ্যোৎস্নাময় রাতের কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ল এখন। সত্যিই তো এখন খেয়াল করে দেখছি, গত ১৪ বছরে কুয়ালালামপুরে কখনো জোনাকি দেখিনি। বাংলাদেশের মতো কত কিছুই তো দেখি এখানকার প্রকৃতিতে। ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝি পোকার ডাক। এই তো গভীর রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্মার্টফোনে লিখছি আর বাইর থেকে ভেসে আসছে চিরচেনা ঝিঁঝি পোকার ডাক। খুবই ভালো লাগছে।
বলছিলাম জোনাকির কথা। কুয়ালালামপুর শহর বলে নয়, কুয়ালালামপুরে ঝাড় ঝোপ আছে, শাক-সবজি খেত আছে, প্রচুর গাছ-গাছালি-লতাপাতা আছে, এ রকম এলাকাতেও এক সময় থেকেছি। সেখানেও জোনাকি দেখেছিলাম বলে মনে হয় না। আমাদের দেশে গ্রামে জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলোতে জোনাক পোকার মিটিমিটি আলো ছড়িয়ে ওড়াউড়ি দেখতে কতই না সুন্দর লাগে। শরতে চাঁদের আলোতে জোনাকির খেলার স্মৃতি মনে পড়ে এখনো।
ছোটবেলার কথা, আমি তখন অনেক ছোট। সেজ চাচার বিয়ে ছিল। রাতের বিয়ে। পাশের গ্রামে হওয়ায় সেখানে হেঁটে গিয়েছিলাম আমরা। সে রাতে চাঁদের ঝলমলে আলোর কথা এখনো মনে পড়ে। ঝলমলে চাঁদের আলোতে রাস্তার পাশে খালের পাড়ে কাশফুলে ওড়াউড়ি করছিল হাজারো জোনাকি। চাঁদের ঝকঝকে আলো, সাদা কাশফুল, তার ওপর জোনাকির মিটিমিটি আলো। জোনাকি উড়ে উড়ে গায়ে এসে লাগত। শৈশবের সেই রাতের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যটা এখনো ভুলিনি।
কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম! শুরু করেছিলাম কুয়ালালামপুর চায়নাটাউনের নীলাকাশে জ্যোৎস্না রাতের চাঁদের কথা দিয়ে। সেই কথায় ফিরি। এ চায়নাটাউনে ভালো লাগার প্রধানতম বিষয় হচ্ছে, এখানে থাকা মানে জাতিসংঘে থাকার মতো! পৃথিবীর বহু দেশের পর্যটকের আগমন হয় এখানে। সব দেশের মানুষের সঙ্গেই কম-বেশি দেখা হয়, কথা হয় এখানে। বিচিত্র মানুষের সঙ্গের ভাব-বিনিময়ে কিছুটা সমৃদ্ধ হয় জানার ও অভিজ্ঞতার ভান্ডার।
দ্বিতীয় হচ্ছে, এত কোলাহলে থেকেও খোলা আকাশের সুবাদে এখানে সূর্যের আলো আর চাঁদের আলো দুটোই দেখা যায়। আকাশের আলোকোজ্জ্বল মুখ, মেঘাচ্ছন্ন মুখ, রংধনুময় রূপ আর টাপুরটুপুর বৃষ্টি, রিমঝিম বৃষ্টি, মুষলধারে বৃষ্টি সবই উপভোগ করা যায়। বার ঘণ্টা কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে প্রকৃতির সঙ্গে থাকা যায়। কখনো মিষ্টি মৃদু হাওয়া উপভোগ করা যায়। প্রাকৃতিক আবহাওয়া কখনো কখনো মনকে নিয়ে যায় ফেলে আসা বাংলাদেশে, বেড়ে ওঠা গ্রামের চারপাশের রূপ-দৃশ্যগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। প্রবাসী মন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায় সাড়ে তিন হাজার মাইল দূরের গাঁয়ে। আমার গাঁয়ে। যেখানে জ্যোৎস্নাময় রাতে জোনাকি এসে শরীর ছুঁয়ে যায়।