জোনাকির দেশে

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

তানিয়া সুলতানা মফস্বলের এক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল ও অস্থির প্রকৃতির এক মেয়ে।

বলতে গেলে সব সময় সে অশান্ত থাকে। একটুতেই অধীর আর উতলা হয় তাঁর মন। উড়ু উড়ু ভাব। মনটা তাঁর ছটফট করে। কীসের জন্য যেন সে সব সময় ব্যাকুল থাকে। কিন্তু কেন যে হয় এসব, সে নিজেও তা ভালো করে জানে না।
অথচ বড় বোন সামিয়া সুলতানা ঠিক তার বিপরীত। ধীর স্থির নম্র শান্ত।
তানিয়ার সঙ্গে সামিয়ার বয়সের পার্থক্য প্রায় ১২ বছরের।
মায়ের কোলে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর ছোট বোন তানিয়াকে পেয়ে সে খুব আনন্দিত হয়েছিল। তার একজন সঙ্গী হলো বলে।
সামিয়া খুবই আদর স্নেহ করে একমাত্র ছোট বোন তানিয়াকে।
তানিয়ারও সব আবদার বড় বোনের কাছে। কিন্তু সামিয়ার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে তানিয়া কেমন যেন একাকী হয়ে পড়ে। মনমরা ও উদাসীন হয়ে থাকে সারাক্ষণ।
কোনো কিছুতেই তাঁর ভালো লাগে না। মন বসে না লেখাপড়ায়।
তানিয়ার বাবা-চাচারা তাঁর দাদার রেখে যাওয়া পৈতৃক বিশাল ভিটায় আলাদাভাবে বাড়ি বানিয়ে বসবাস করেন।
মেজ চাচার বড় সংসার। তিনি রাগী আর বদমেজাজি। স্কুল পড়ুয়া বেশ কয়জন ছেলেমেয়ে। তাদের লেখাপড়ায় সাহায্য করার জন্য একজন ছাত্রকে লজিং মাস্টার হিসেবে রেখেছেন তিনি। মেজ চাচার বৈঠকখানাসংলগ্ন ছোট একটা থাকবার ঘরে সেই লজিং স্যার থাকেন। সেখানেই তিন বেলার খাবার আসে প্রতিদিন।
কলেজ থেকে ফিরলে স্যার বিকেল থেকে বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক নিয়ে বসায়। ঠিক সন্ধ্যার পর তা শেষ হলে তখন নিজের পড়া শুরু করে। ছেলেটা গরিব। তবে লেখাপড়ার রেজাল্ট ভালো। দেখতেও লম্বা গড়ন।
এবারই বিএসসি ভর্তি হয়েছে তানিয়াদের ওই একই কলেজে।
দূর গ্রামের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাঁর বাড়ি। আর্থিক অসুবিধার কারণেই সে লেখাপড়া শেখানোর বিনিময়ে এই ফ্রি থাকা খাওয়ার সুবিধাটা নিয়েছে। যেন নিজের কলেজের পড়াটা কোনোভাবে চালিয়ে নিতে পারে। তারপর ডিগ্রি নিয়ে একটা চাকরি করতে পারে।
তানিয়াও আজকাল মাঝে মধ্যে স্যারের কাছে টুকিটাকি বায়োলজি কিংবা ক্যালকুলাসের সমস্যা নিয়ে আসে।
স্যার ভালো করে সেগুলো বুঝিয়ে দেন।
একই কলেজে পড়ার সুবাদে স্যারের সঙ্গে কলেজ ক্যাম্পাসে দেখা সাক্ষাৎ হয় তানিয়ার। কথাবার্তা হয়। তাই কিছুটা ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। অফ পিরিয়ড থাকলে তানিয়া পীড়াপীড়ি করে কোথাও কোনো নির্জন স্থানে গিয়ে বসতে। স্যার মাঝে মাঝে তা শোনেন। কখনো কলেজ মাঠে বা ক্যানটিনে গিয়ে বসেন। লেখাপড়া নিয়ে আলাপ হয়। গল্পও চলে।
এ রকম মেলামেশা করতে করতে বেশ ভাব হয়ে যায় স্যারের সঙ্গে। বলতে গেলে কিছুটা একতরফা ভাব। শুধু তানিয়ার পক্ষ থেকে।
তানিয়ার জেদাজেদির কারণে স্যারকে সব আবদারই রাখতে হয়।
তাঁর চাচার বাড়িতে লজিং থাকে সে। না শুনে উপায় বা কী।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

একদিন চাচার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেষ হয়ে সবাই চলে গেলে তানিয়া রাতে স্যারের ঘরের দরজায় নক করে। হাসতে হাসতে এসে বলে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের একটা জিনিস সে ভালো করে বুঝতে পারছে না।
জিজ্ঞাসা করে আচ্ছা স্যার লজ্জাবতী গাছ যেটার বোটানিক্যাল নেম মিমসা প্লান্ট তার এত লজ্জা কেন? ছোঁয়া লাগলেই কেন সে নিজেকে জড়িয়ে মুড়িয়ে ফেলে? বলেই মুখ টিপে হাসে।
স্যার বিজ্ঞানভিত্তিক জবাব দিতে চেষ্টা করেন। বলেন দেখ, লজ্জাবতী গাছের পাতাগুলো খুব সংবেদনশীল। কোনো কিছুর সংস্পর্শে এলে পাতাগুলোর অভ্যন্তরীণ কোষের মধ্যকার ভ্যাকুওল বা গর্তে সঞ্চিত পানি পার্শ্ববর্তী কোষগুলোতে গমন করে এবং তা করতে করতে কাণ্ডের দিকে ধাবিত হয়। এক সময় পাতাগুলো পানি শূন্য হয়ে পড়লে স্থির হয়ে শান্ত হয় এবং নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। ক্ষণিক পরে আস্তে আস্তে পাতার কোষের গর্তে পুনরায় পানি ফিরে এলে তা সজীব হয় এবং পাতাগুলো আলোর দিকে মুখ তুলে চায়।
উত্তর শুনে তানিয়া খিলখিল করে হাসে। বলে, স্যার চলেন না আমাদের পুকুর পাড়ে অনেক লজ্জাবতী গাছ আছে একটু প্র্যাকটিক্যাল দেখিয়ে দেন না।
স্যার বলে ওঠেন, না না এখন রাত্রিবেলা তো। দিনেরবেলায় একদিন যাওয়া যাবে। তখন দেখিয়ে দেব।
স্যারকে নিয়ে অভিসারে বের হওয়ার নানান দুষ্টুমি বুদ্ধি করে তানিয়া। দিনেরবেলায় তো আর সুযোগ হয় না তাই ভাবে রাতেরবেলায় স্যারকে নিয়ে বের হবে।
বেচারা স্যার লজিং হারানোর ভয়ে এই চঞ্চল ক্ষ্যাপা পাগলি মেয়েটির কথা শুনতে বাধ্য হয়।
এমনি একদিন জ্যোৎস্না রাতে স্যারকে নিয়ে ওদের পুকুরের ধারে যায়। বড় আমলকী গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে স্যার এইখানে কিন্তু অনেক লজ্জাবতী গাছ আছে।
হঠাৎ অনতিদূরের পত্রপল্লবহীন ছোট্ট শিমুল গাছের ডালে বসে থাকা বাঁকা ঠোঁটের এক বড় লক্ষ্মীপেঁচা দেখে তানিয়া ভীষণ ভয় পায়। জড়িয়ে ধরে স্যারকে। স্যারের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজতে থাকে। স্যার অভয় দেন। আরে ভয়ের কিছু নেই। ওটা একটা নিশাচর পাখি। মানুষের ক্ষতি করে না। সারা রাত জেগে ওরা খাবার খোঁজে।
আরেকদিন রাতে তানিয়াদের তাল বাগানের ভেতর বসে গল্প করার সময় গোক্ষুর সাপের হিস হিস শব্দের তাড়া খেয়ে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচে। স্যার বলেন, তানিয়া এ রকম রাতবিরাতে ঘোরাফেরা করা ঠিক না। তা ছাড়া কেউ যদি কখনো দেখে ফেলে। তাহলে কী হবে?
তানিয়া রাগ করে বলে ওঠে কী হবে? কিছুই হবে না।
এভাবে স্যারকে ঘিরে তানিয়ার বুকে প্রচণ্ড এক ভালোবাসার জন্ম নেয়। অবুঝ ভালোবাসার অদৃশ্য এক মায়াজালে সে আঁটকে যায়। স্যারকে নিয়ে অনেক দিবাস্বপ্ন দেখে।
ভাবে সামিয়া আপুর মতো তাঁর বিয়ে হবে একদিন। সেও ঘর বাঁধবে।
সুখের বন্যায় ভালোবাসার ভেলায় ভেসে ভেসে বেড়াবে স্যারের সঙ্গে।
একরোখা খামখেয়ালিপনা এই মেয়ে তানিয়া কাউকেই তোয়াক্কা করে না। তার যখন যা মনে আসে তাই করে বসে।
আজ কলেজে গিয়েই খবর পেয়েছে আগামীকাল লাল চন্দ্রগ্রহণ হবে। ব্লু ব্লাড ও সুপার মুন দেখা যাবে একই সঙ্গে।
এ এক ব্যতিক্রম ধরনের চন্দ্রগ্রহণ। এক রাতেই চাঁদের তিন তিনটি রূপ দেখার সুযোগ ঘটবে। চোখের সামনে রং বদলাবে চাঁদ। সাদা থেকে নীল নীল হবে এবং তা থেকে লাল। সেইসঙ্গে পূর্ণ গ্রহণও দেখা যাবে।
স্যারের সঙ্গে এই বিরল চন্দ্রগ্রহণ দেখার সুযোগ সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। সেই প্ল্যান তানিয়ার।
এবার স্যারের সঙ্গে ফিজিকসের ব্যবহারিক কিছু একটা শেখা যাবে।
প্রস্তাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্যার বলে উঠলেন, হ্যাঁ এতে ফিজিকসের থিওরির প্রয়োগ দেখা ও শেখা যাবে। কিন্তু তুমি না বৃষরাশির জাতিকা। বৃষরাশির ওপর এই চন্দ্রগ্রহণের প্রভাব মোটেও ভালো না। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে এই রাশির জাতকেরা বেশ সমস্যায় পড়তে পারে। মানসিক সমস্যায় ভোগার খুবই সম্ভাবনা আছে তাই এই চন্দ্রগ্রহণ তোমার না দেখায় ভালো। গ্রহণের দিকে না তাকানোই ভালো হবে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। তানিয়ার জেদ। সে চন্দ্রগ্রহণ দেখবেই দেখবে এবং স্যারকেই তা দেখাতে হবে।
সন্ধ্যার পড় পরেই স্যারের সকল ছোট ছোট ছাত্ররা মিলে পুকুর পাড়ের উঁচু ভিটায় সবায় বসে গেল চন্দ্রগ্রহণ দেখতে। সঙ্গে তানিয়াও। ব্লু মুন, ব্লাড মুন ও পরে সুপার মুন এই তিন ধরনের মিষ্টি চাঁদের রুপা ঝরা আলোয় তানিয়া অবগাহন করল স্যারের পাশে বসে।
আর আবৃত্তি করল, ‘কার্তিক মাঠের চাঁদ’-কে উদ্দেশ করে জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতার পঙ্‌ক্তি।
‘তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে-চাঁদ,...একদিন হয়েছে যা-তারপর হাতছাড়া হ’য়ে হারায়ে ফুরায়ে গেছে-আজো তুমি তাঁর স্বাদ ল’য়ে আর একবার তবু দাঁড়ায়েছো এসে!’
স্যার তো শুনে অবাক হলেন। মনে মনে ভাবলেন এ যেন চাঁদকে নয় তারই উদ্দেশ্যে বলা।
তানিয়াদের পুকুর পাড়ের দক্ষিণ পাশটায় বড় বাঁশ ঝাড় ছিল। তারই নিচে ছিল জলাভূমি-সদৃশ স্থান। যা অনেক ছোট ছোট বুনো ঝোপ আর জংলি গাছে ছাওয়া। বুনো গুল্মের মরা কাণ্ড শুকিয়ে কাঠি হয়ে আছে।
একদিন রাতে তানিয়া স্যারের হাত ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে থামে সেই জলার কাছের এক ছাতিম গাছের তলায়। হাঁফ ছেড়ে সেখানে বসে পড়ে তানিয়া।
স্যার বলতে থাকে এ কোথায় নিয়ে এলে। চারিদিক যে অন্ধকার আর অসম্ভব নির্জনতা।
তানিয়া জবাব দেয় না। শুধু বলে এই জায়গাটা তাঁর খুবই পছন্দনীয়। নিরিবিলি ও এই অন্ধকারে কেউ আমাদের দেখতে পাবে না। এখানেই আজ বসে চুটিয়ে সময় কাটাব।
কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী রাত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছাতিম গাছের পাতাগুলো যেন মাথার ওপর ছাতা মেলে ধরেছে।
নিঝুম নিশ্চুপ। এক কালো স্পর্শ ছাড়া একে অপরের অস্তিত্ব অনুধাবন করা মুশকিল। তানিয়া স্যারের হাত শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। যেন কিছুতেই ছুটে না যায়। ধীরে ধীরে তানিয়ার কোমল হাত খুঁজে ফেরে স্যারের নাক মুখ চোখ। শুনতে পায় স্যারের হার্ট বিটের লাভ ডাব লাভ ডাব রিদম। সে শব্দে পরিমাপ করে রক্ত প্রবাহের তীব্রতা। অনুভব করে নিশ্বাস প্রশ্বাসের গতি। তানিয়ার ঠোঁটে কী এক বিস্ময়ের অনুভূতি জাগে। আরেক জোড়া ঠোঁটের স্পর্শ চায় সে। চোখ মুদে আসে। খেয়াল করে স্বর্গীয় এক ভালোবাসার পুরুষালি হাতের পাঁচ পাঁচটি আঙুল তাঁর মাথার চুলে বিলি কাটছে।
অনেকক্ষণ স্যারকে সে আবেশে ধরে রাখে প্রাণ রসায়নের বিক্রিয়ায়। আদর সোহাগের বিমুগ্ধতায়। লিপ থেরাপির প্রক্রিয়ায়।
তানিয়া যেন কোথাও হারিয়ে যায়। অন্তহীন এক শূন্যে।
বহুক্ষণ পর চোখের পাতা খোলে তানিয়া। চোখ মেলে অবাক হয়।
দেখতে পায় ঘুটঘুটে সেই কালো নিকষ অন্ধকারে হাজারো তারার আলোকচ্ছটা। তাঁদের দুজনকে ঘিরে ধরেছে চারিদিক থেকে। জ্বলছে আর নিভছে। আলোগুলো সারি বেঁধে বেরিয়ে আসছে ওই ছোট্ট ঝোপ থেকে। কী এক আনন্দ ধারায় উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে ওদের দুজনের চারপাশে।
তানিয়ার মনে হচ্ছে এ যেন তাঁদের বিবাহোত্তর রিসিপশনের আলোকসজ্জা। কিন্তু কে করল এই মহা আয়োজন?
স্যারকে জিজ্ঞাসা করে তানিয়া।
স্যার বলেন এরা তো সব জোনাকি পোকা। এরাই এই আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেছে। তোমারই জন্য।
ওমা কী সুন্দর। কেন করল আমার জন্য?
তুমি যে অনেক ভালো একটা মেয়ে তাই।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

স্যার আরও ব্যাখ্যা করে বলতে থাকেন জোনাকিরা হচ্ছে একধরনের বিটল। রাতের আঁধারে এরা নিজেদের শরীর থেকে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে পছন্দের সঙ্গী বা লাভ পার্টনার খোঁজে। রাতের এই সময়টা তাদের সঙ্গী খোঁজার মাহেন্দ্রক্ষণ। পুরুষ জোনাকিরা উড়ে বেড়িয়ে নিজের পেটের লাইট অফ আর অন করে মেয়ে জোনাকিকে জানান দেয় তাঁর উপস্থিতি। খুবই উজ্জ্বল কিংবা তড়িৎ গতির আলোর ছটা ফ্লাশিং করে মেয়ে জোনাকিকে আকৃষ্ট করার প্রয়াস করে। মেয়ে জোনাকিরা উড়তে পারে না। তাই তারা আলোর ফ্লাশিং গতি রং দেখে বুঝতে পারে কে বেশি স্মার্ট। তখন তাকেই চয়েস করে। তারপর নিজের পেটের আলো দিয়ে সিগনাল দেয় স্মার্ট পুরুষ জোনাকিকে। আমন্ত্রণ জানায় কাছে আসার। আবেদন করে ভালোবাসার জন্য।
এরপর ছেলে জোনাকি মেয়ে জোনাকির কাছে আসে। একে অপরকে বিশ্বাস করে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দেয়। তারপর ছেলে জোনাকি আর মেয়ে জোনাকি পিঠে পিঠ লাগিয়ে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে প্রেম সাগরে ডুব দেয়।
তানিয়া এসব কথা শুনে মৃদু হাসি হাসে। সে হাসির রেখা অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়। আর বিড় বিড় আওড়ায় আমি তো আমার ভালোবাসার মানুষকে নির্বাচন করেই ফেলেছি।
এখন আমরা কবে বুকে বুক মিলিয়ে ভালোবাসায় নিমগ্ন হব।
নিজেই তা জানে বলে মাথা নাড়ায়।
অনেক রাত পর্যন্ত তানিয়া আর স্যার জোনাকির মিলনমেলার অপূর্ব আলো খেলা দেখে। ওদিকে পুব আকাশ ফরসা হতে থাকে। তাড়াতাড়ি দুজনে ফিরতে উদ্যত হয়। ফেরার পথে পাড়ার বুড়ো মুয়াজ্জিন সাহেব দুজনকে রাস্তায় ভোরের আবছা আলো আঁধারে দেখে ফেলেন। কিন্তু কিছুই বলেন না। শুধু গলা খাক দিয়ে মসজিদের দিকে চলে যান ফজরের আজান দিতে।
পরে বিষয়টি নিয়ে মুরব্বিদের মধ্যে চর্চা হলে আস্তে আস্তে কথাটি তানিয়ার চাচার কানে গিয়ে পৌঁছায়।
তানিয়ার চাচা ভীষণ রাগান্বিত হলেন। লজিং মাস্টারকে খুব ভর্ৎসনা আর গালাগালি করলেন। গায়েও হাত তুললেন।
মুহূর্ত দেরি না করে তক্ষুনি পাড়া ছেড়ে চলে যেতে বললেন।
স্যারও ভয়ে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে প্রচণ্ড অপমানিত হয়ে নিজের মাথা হেঁট করে অপরাধীর মতো সেখান থেকে বিদায় নেয়।
স্যারকে অপমানিত করে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাটা তানিয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। কিন্তু চাচাকেও কিছু বলতে পারল না।
ঘটনাটি ব্যাপকভাবে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় তানিয়া কিছুদিন বাড়ির বাইরেও বের হলো না। কলেজেও যাওয়া বন্ধ করল।
তাঁর প্রশ্ন তাঁকে কিছুই জিজ্ঞাসা করা হলো না কেন? স্যারকে অপমানিত করা হলো কেন?
কারণ স্যারের কোনোই দোষ ছিল না। তাঁর নিজের খাম খেয়ালিপনার কারণে আর জোর করে স্যারকে ভালোবাসতে গিয়ে স্যারের মতো একজন নরম সহজ সরল মানুষকে কতই না অপদস্থ হতে হলো।
তানিয়া তাঁর অপরাধ বোধ থেকে ভীষণ কষ্ট পেল। তাঁর বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল।
সারাক্ষণ এই এক চিন্তা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
অপমানিত হয়ে স্যার চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে তানিয়ার অস্থিরতা ভয়ানক ভাবে বাড়তে শুরু হলো। কী করে বা কী বলে তাঁর কোনোই গতি প্রকৃতি নাই।
এইভাবে এক সময় সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। তাঁর স্মৃতিভ্রম অসুখ হলো।
বাবা-মা অনেক চেষ্টা করলেন। বড় বোন সামিয়া ছুটে এল। বোন দুলাভাই শহরের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়েও ভালো সুফল মিলল না। ডাক্তার বললেন তানিয়ার মেন্টাল ডিসঅর্ডার হয়েছে। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে সিতসফ্রেনিয়া। আরও বললেন সে তাঁর আবেগ চিন্তাধারা আচরণ ব্যবহার কিছুই ভ্রান্তভাবে উপলব্ধি করছে। সে এখন এক বিভ্রমে আছে। তার সঙ্গে সব সময় যেন একজন সঙ্গী বা অ্যাটেন্ডেন্ট থাকে।
চঞ্চল চপলা একটা সুস্থ মেয়ে তানিয়া নিমেষেই কেমন মলিন হয়ে ভেঙে খান খান হয়ে গেল।
এভাবে এক বছর গড়িয়ে গেল।
একদিন অমাবস্যার রাতের মধ্য প্রহরে তানিয়া চুপিসারে নিজের শোয়ার ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ল। প্রথমে নিজেদের পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটে গিয়ে পা দুটি পানিতে ডুবিয়ে সিঁড়ির ওপর বসে রইল। তারপর উঠে পুকুর পাড়ের তাল গাছের তলায় কিছুক্ষণ বসে থাকল। একাকী নিঝুম অন্ধকারে।
নিজেই ফিশ ফিশ করে বলে উঠল স্যার চলেন যাই ওই জলার ধারের লতাগুল্ম ঝোপটার দিকে গিয়ে বসি।
হেঁটে গেল কিছুদূর। সেই ছাতিম গাছটার নিচে থামল আবার।
ঝোপ থেকে একটা একটা করে জোনাকি দেখা দিল। হাসি মুখে তানিয়ার কাছে এসে থামল।
ক্ষণিকের মধ্যে অসংখ্য জোনাকি ফ্লাসিং লাইট অফ আর অন করে তানিয়াকে দেখতে এল। দলবাঁধা কেউ। কেউ আবার জোড়া বেঁধে ঘুরে বেড়াতে লাগল। নক্ষত্রের আলো মেখে ঝোপ ঝাড়ের পৃথিবীতে গ্যালাক্সির এক ছায়াপথ নেমে এল।
এক মুগ্ধতা ছড়ানো আলোর নৃত্যে গীতে সব জোনাকিরা সমস্বরে গাইতে লাগল—‘তুমি এলে অবশেষে, জোনাকির দেশে-এক বিবর্ণ মলিন বেশে, দ্যুতিময় প্রতিপ্রভ-বরণ করি তোমায়, স্ফুরজ্যোতির হাসি হেসে।’
গানে গানে পুরুষ জোনাকিরা উড়ে বেড়াতে লাগল আর মেয়ে জোনাকিরা নিচে তানিয়ার পায়ের দুই ধারে সারি দিয়ে জোনাকিবন্ধনে আবদ্ধ হলো। ঘিরে রাখল তানিয়াকে। আলো জ্বলছে আর নিভছে। জোনাকিরা শুরু করল আলো আর আঁধারের অপার খেলা। খেলতে লাগল তানিয়ার সঙ্গে। খেলতে খেলতে তানিয়া ক্লান্ত হয়ে পড়ল কিন্তু অনেক অনেক খুশি হলো।
বহুদিন পর প্রাণ খুলে হাসল সে। যেন এত দিন পড় নিজেকে আবিষ্কার করল। নতুন ভাবে।
সংবিৎ ফিরে এল তানিয়ার। খুঁজতে লাগল স্যারকে। স্যার কই।
ভাবল আর একটু এগোলেই পাবে। হেঁটে যেতে লাগল সামনের দিকে। এক পা, দুই পা করে।
জোনাকিরাও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল।
ছায়াপথের খুদে খুদে শতকোটি তারকা পঞ্জির মতো জোনাকিরা তানিয়ার দুই পাশে দাঁড়িয়ে অভয় দিতে থাকল তাদের তলপেটের ফ্লাশিং লাইট অফ আর অন করে।
তানিয়াও কোনো এক অজানা সাহসে তাঁর ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর নিয়ে ধীর পায়ে নির্ভয়ে হেঁটে হেঁটে যেতে থাকল সামনের দিকে।

*রানা টাইগেরিনা: টরন্টো, কানাডা। ইমেইল <[email protected]>