‘জেরুজালেম, আমার বাড়ি’

কয়েক দিন থেকে মাথার চারপাশে একটি আর্তনাদ ঘুরপাক করছিল—‘আমিও মানুষ, বাঁচতে চাই আমিও’। ফিলিস্তিনি আইনপ্রণেতার এ আর্তচিৎকার শুনেছেন অনেকেই। এ পর্যন্তই। এ বিষয়ে লিখতে চাইনি। কী হবে লিখে? শুধু শুধু হতাশাকে আরও ভারী করা।

১৯৪৯ সাল আমি দেখিনি। যখন ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয় ব্রিটিশদের উদ্যোগে। ১৯৬৭ সালে হাইস্কুল থেকে কলেজে উঁকি দেওয়ার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মোগলাবাজার, শহরতলি হলেও ঢাকার দৈনিক পত্রিকা পড়তে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো।

একটি দৈনিক পত্রিকার ছবি এখনো মনে আছে—ট্রাকভর্তি ইসরায়েলি সৈন্যরা বন্দুক উঁচিয়ে উল্লাস করছে জেরুজালেম দখলের পর। এরপর?

লাখো ফিলিস্তিনির আশ্রয় হলো শরণার্থীশিবিরগুলোতে। নিজের বাড়ি-ঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে ৭২ বছর ধরে বাস করছে লেবানন, সিরিয়া ও জর্ডানসহ নানা দেশে। এখনো তারা নিজ ঘর হারাচ্ছে। কারণ ইসরায়েলের আরও জমি চাই, আরও বসতি চাই।

আজকের লেখায় ইতিহাস নয়, দু-এক জিজ্ঞাসার শুধু উত্তর খুঁজব। ১৯৯২ সালে ক্লিনটনের উদ্যোগে এক শান্তি চুক্তির আওতায় ফিলিস্তিনিরা গাজা ও পশ্চিম তীরে কিঞ্চিৎ স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। ব্যস, এটুকুই। দখলদারি যা সমস্যার মূল কারণ, তার কোনো সুরাহা হয়নি। বরং কয়েক বছর পর পর নির্বিচারে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে অহমিকার সদম্ভ প্রকাশ করা হয়।

গাজা ছোট্ট একটি উপত্যকা। বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ জনপদের একটি। গত মে মাসে এখানে ২০০৮, ২০১২ ও ২০১৪ সালের মতো দুর্ভোগ নেমে আসে। ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমান, ট্যাংক ও আর্টিলারি কামানের গোলায় ছোট্ট এই জনপদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ১১ দিনের অভিযানে ২৪৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। এর মধ্যে ৬৬ জনই শিশু।

ইসরায়েলের প্রতিটি হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে বলে থাকে, ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে’ এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রশ্ন থেকে যায়, একই অধিকার তো ফিলিস্তিনি শিশুদেরও ছিল। তাদেরও বলার ছিল ‘আমাদের ওপর বোমা ফেল না। আমরা নিরীহ, নিরপরাধ।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা।

মজার বিষয় হলো, নির্বাচনের আগে জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যে সুষম নীতি গ্রহণ, দুই রাষ্ট্র গঠন, সমঅধিকার বা সম দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সমর্থনসহ বহু প্রতিশ্রুতির কথা শুনিয়েছেন। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে একতরফা ইসরায়েলকে সমর্থন করেছে। শুধু সমর্থন নয়, ইসরায়েলের কাছে ৭৩৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রিরও উদ্যোগ নিয়েছে।

কংগ্রেসের বাম-উদারনৈতিক কিছু সদস্য অস্ত্র বিক্রির বিরোধিতা করে বিল আনার চেষ্টা করলে টম ক্রুজসহ রিপাবলিকান কয়েকজন আইনপ্রণেতা দ্রুত ইসরায়েল সফর করে জানিয়ে আসেন, আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কিছু চাপের মধ্যে আছেন। তাঁর নিজ দলের উদারনৈতিক সদস্যদের এই চাপের ফলে ট্রাম্পের মতো খোলামেলা অনেক কিছু করতে পারছেন না। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স তো ইসরায়েলি হামলার নিন্দাও জানিয়েছেন। বাইডেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজার পুনর্গঠনে অর্থ সাহায্যের কথা জানিয়েছেন। এর আগে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে যে অর্থ সাহায্য দেওয়া হতো, ট্রাম্প যা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, বাইডেন আবারও তা চালু করেছেন।

ইসরায়েলের আচরণের ব্যাপারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির কিছু কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। গত তিন দশকে এই প্রথম তার আঁচ মিলছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন তদন্তে নেমেছে, যুদ্ধাপরাধ হয়েছে কিনা। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৪ সদস্যই ইসরায়েলকে নিন্দা জানাতে প্রস্তুত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে যা জানানো সম্ভব হয়নি।

বাইডেন সমাধানের জন্য দুই রাষ্ট্র থিওরির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলের অস্তিত্ব অবশ্যই মেনে নিতে হবে।

আলোচনার টেবিলে বসলে সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়। বসার আগেই যদি ‘বিচার মানি, কিন্তু তাল গাছটা আমার’ ঘোষণা দেওয়া হয় অথবা মিনেসোটার কৃষ্ণাঙ্গ ফ্লয়েডের গলায় পুলিশ অফিসারের হাঁটু চেপে রাখার মতো ‘স্বীকৃতি দাও, স্বীকৃতি দাও’ বলে দাবি চলতে থাকে তাহলে আলোচনা হবে কীভাবে? এর জন্য আসলে দরকার একজন মধ্যস্থতাকারী। যুক্তরাষ্ট্র তা হতে পারত। কিন্তু ট্রাম্পের মতো পক্ষাবলম্বন নিতে থাকলে তা হওয়া কি সম্ভব?

আবার জিজ্ঞাসায় ফিরে আসি। যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা ইসরায়েলকে সমর্থনের ব্যাপারে এত আগ্রহী কেন—এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ল একটি ডকুমেন্টারির কথা। ইস্ট এল্মহার্স্টের বাসায় থাকার সময় টিভি নেটওয়ার্কে ‘লিংক’ নামে একটি চ্যানেল ছিল। ওই চ্যানেলে শেখা ও জানার মতো ভালো ভালো বিষয় থাকত। একটি ডকুমেন্টারিতে চ্যানেলটি প্রচার করেছিল, যাতে দেখানো হয়েছে আইনপ্রণেতা বা রাজনীতিকেরা কেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বলেন না। যদি বলেন, তাঁর নির্বাচিত বা পুনর্নির্বাচিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। যদি নির্বাচিত হন, ধরে নিতে হবে বর্তমান টার্মই তাঁর শেষ টার্ম।

বাস্তব প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয়, এক কংগ্রেসনাল আসনে (স্টেটের নাম মনে নেই) বিপুল ভোটে একজন নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচিত হয়ে তিনি ইসরায়েলের স্বার্থবিরোধী কিছু কথাবার্তা বলেছেন। দুই বছর পর পুনর্নির্বাচনের সময় এল। তিনি তাঁর আসনে খুবই জনপ্রিয়। ধরে নিলেন, সহজেই তিনি পুনর্নির্বাচিত হবেন। কিন্তু নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসতে থাকল, দেখা গেল এক অখ্যাত প্রার্থীর জোরালো বর্ণাঢ্য প্রচার। সেই প্রার্থীর অঢেল অর্থ। বিপুল প্রচারের কাছে শেষ পর্যন্ত তিনি হেরে গেলেন যা ছিল তাঁর কাছে অকল্পনীয়। পরে জানলেন, তাঁর ইসরায়েলবিরোধী ভূমিকার জন্য পুনর্নির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে নিউইয়র্ক থেকে বিপুল অর্থ প্রতিপক্ষকে দেওয়া হয়।

অনেক আগে হলিউডের একটি সিনেমা দেখেছিলাম। সেখানে এক দানব নারীর বেশ ধরে প্রেম, বিয়ে, সন্তান নিয়ে সুখেই কাটাচ্ছিল। স্বামীর প্রতি তার একটিই শর্ত ছিল, কোনো অবস্থাতেই একটি বিষয়ে কোনো ঔৎসুক্য দেখানো যাবে না। এটিই তার রেড লাইন। কিন্তু স্বামী তো মানুষ। ধৈর্য রাখতে না পেরে একদিন রেড লাইন ক্রস করে ফেললেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা স্ত্রী ভয়ংকর দানবের রূপ নিয়ে নিল। এক শ্রেণির রাজনীতিক, যারা প্রায়ই মানবতা, সমঅধিকার ইত্যাদির কথা বলেন। তাঁরাও এক ধরনের রেড লাইন এঁকে দিয়েছেন। কিছু বিষয়ে তাঁদের কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। করলেই বিপদ।

শেষ করার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার শিল্পী মাস্টার কেজি ও মমকেবোর একটি সাড়া জাগানো গান বারবার শুনছিলাম। গানটি এখন দেশে দেশে নৃত্য সহকারে গীত হচ্ছে। সুর আর কথা মোহাবিষ্ট করে রাখে।

‘এ স্থান আমার নয়,

এ আমার কিংডম নয়,

আমাকে নিয়ে চলো,

আমার সঙ্গী হও,

আমাকে নিরাপত্তা দাও,

জেরুজালেম, আমার বাড়ি।

আমার সঙ্গী হও,

আমাকে ফেলে যেও না,

আমাকে নিয়ে চলো,

বাঁচাও আমাকে, বাঁচাও আমাকে,

জেরুজালেম, আমার বাড়ি।’