জীবনের লক্ষ্য

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমাদের সময় স্কুলে বাধ্যতামূলক একটা রচনা পড়ানো হতো—My Aim in Life. কিন্তু আমাকে এটা নিয়ে চিন্তা করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। বইয়ে সুন্দর ভাষায় যা লেখা ছিল, বড়জোর অতি সিরিয়াস বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের সুন্দর ঝরঝরে ভাষায় তা লিখে দিতেন। ছেলেমেয়েরা সেটাই মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে আসত।
ভুলের শুরুটা সেখান থেকেই। একজন মানুষ তার জীবন নিয়ে কী করতে চায়, তার কী কাজে আগ্রহ আছে, তার মন কীসে আনন্দ পায়, এগুলো খুঁজে বের করতে এমনিতেই বেশির ভাগেরই অনেক সময় লাগে। জীবনের জন্য যেমন অর্থ উপার্জন অপরিহার্য, সেই সঙ্গে কাজে আনন্দ পাওয়াটাও অনেক জরুরি। এই আনন্দটা থাকলে অর্থ উপার্জনের পথটাও সহজ হয় আর জীবনটাও। নিজের কাছে নিজের প্রায়োরিটি পরিষ্কার হওয়াটাও খুব দরকার। যাই ঘটুক না কেন, আমি দেশের মাটি ছাড়ব না, মা-বাবার সঙ্গে থাকব, আমার কাছে গবেষণাটা সবার ঊর্ধ্বে, আমি কিছুতেই আমার সন্তানকে আর কারও হাতে দেব না, আমি চাকরিও করব, সংসারও করব, মানি আমার সেকেন্ড গড, আমাকে ওই কোম্পানির সিইও হতে হবেই। এ রকম একেকজনের একেক প্রায়োরিটি হতে পারে, কিন্তু সবচেয়ে জরুরি নিজের প্রায়োরিটির নিজের জানা। নিজের ক্ষমতা ও আগ্রহ বুঝে সেই প্রায়োরিটির লক্ষ্যে আগানোর বাস্তবসম্মত প্ল্যান করা। দুর্ভাগ্য যে আমাদের প্রায় জীবনের অর্ধেকটা কাটিয়ে এসব শিখতে হয়েছে।

আমি যখন কলেজে পড়ি, সেই সময়েও আমি নিশ্চিত জানতাম না আমি কী পড়তে চাই বা বড় হয়ে কী পেশা বেছে নিতে চাই। My Aim in Life তো আর আমার মনে কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। ভালো শিক্ষার্থীরা সবাই ডাক্তারি পড়ে বা ইঞ্জিনিয়ারিং। তাই দুই জায়গাতেই পরীক্ষা দিলাম। ব্যাকআপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর আব্বুর খুব শখ ডাক্তারি পড়ি। আম্মু কিছুটা স্বাধীনতা দিলেন। এক মাস ক্লাস করে লাশের গন্ধে কেটে পড়লাম। সবারই এক গল্প। সিরিয়াল অনুযায়ী সিএসই, তাই সিএসই। এ পর্যন্ত ভালো লাগা বা প্যাশন বলতে শুধু অঙ্ক আর ফিজিকস-কেমিস্ট্রি। এর সঙ্গে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কী যোগাযোগ মন কিন্তু একবারও জানতে চায়নি। ভাবটাই যেন আসল, জীবনের My Aim in Life। তার চেয়েও ভয়াবহ কথা লেভেল ফোরেও আমি জানি না কোন পেশা আমার পছন্দ। পেশা ভাবার সময় কোথায়? ভালো শিক্ষার্থীরা সব টিচার হয়, ভাবই আলাদা। এদিকে মা অবশ্য ছোটবেলা থেকেই কানের কাছে মন্ত্র দিচ্ছেন, মেয়েদের জন্য মাস্টারি ভালো, মহান পেশা, মহান স্ত্রীর সুখের সংসার। মেয়ে মহান স্ত্রী হতে চায় কিনা সেই খবর নাই, তার আদৌ পড়াতে ভালো লাগে কিনা সেই প্রশ্নই ওঠে না। ওই যে বুয়েটের টিচার, ভাবটাই আলাদা। আর আমি, আমি বেকুবের সারা জীবনের My Aim in Life সামনের পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া। এই ফার্স্ট হয়ে আমার কী হবে সেই প্রশ্ন জীবনেও নিজেকে করি নাই।
আবারও গা ভাসালাম পাস করে। বুয়েটে জয়েন করলাম। বিদেশে যাব নাকি দেশে থাকব। বিদেশে গেলেই বা কেন যাব, জানি না। মাস্টারি করলে একটা উচ্চ ডিগ্রি দরকার। উচ্চ ডিগ্রি হলে বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল হবে সুতরাং যাও বিদেশ। আমার কী সাবজেক্টে পড়তে ভালো লাগে, সেটা মুখ্য না। কোন সাবজেক্টের বাজার ভালো, সেই হিসেবে সাবজেক্ট পছন্দ কর। বরের ইচ্ছা সেও বিদেশে যাবে। আমরা কিন্তু বিদেশে এসেও একদম দ্বিধান্বিত, কি করব আর দুই বছর পরে তাও জানি না। এগুলো প্রতিটা ঘটনাই একেকটা মস্ত বড় ভুল।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত


আমার এই ভুল আমি বয়ে চলেছি বহুদিন, নিজের অজান্তে। ছেলেটাকে ছোটবেলায় মাঝে মাঝে বলতাম, বাবা ডাক্তারি পড় না, বেতন বেশি, জব সিকিউরিটি বেশি। আসলে আমার ভেতরে আমার বাঙালি জিন কথা বলত। আমার ছেলে খুব মন খারাপ করে বলত, তোমার কাছে ফিউচার মানেই খালি টাকা আর জব সিকিউরিটি কেন? আমার ভালো লাগাটাই তো আসল হওয়ার কথা তাই না?
ওকে আমি যতটুকু পড়ালেখা করতে দেখেছি, তার তিন গুণ সময় খরচ করতে দেখেছি বিভিন্ন পেশা সম্পর্কে জানতে। তাদের কাজের ধরন, কী ধরনের নলেজ লাগে, কীভাবে সেই নলেজ কাজে লাগায়, এগুলো নিয়ে খোঁজ খবর নিতে। একদম হাতেকলমে কিছুটা কাজ করে, কিছু প্রাইমারি ক্লাস করে তারপরে সে তার পথ বেছে নিয়েছে। একবারও আমাদের চিন্তার কোনো প্রাধান্য দেয়নি। টাকাটা যে একদম মাথায় নেই তা কিন্তু না, ভালো লাগা আর অর্থ উপার্জনের একটা অপটিমাইজ কম্বিনেশনে আসার চেষ্টা করছে।
সে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত না। কিন্তু ইউনিভার্সিটি শুরু হওয়ার এক দেড় মাসের মাথায় আমাকে জিজ্ঞেস করেছে কম্পিউটার সায়েন্সের উচ্চশিক্ষায় বা রিসার্চ ওয়ার্কে ওর কী ধরনের অঙ্ক জানতে হবে। অঙ্কের শুধু সূত্র মুখস্থ বা আপ্লাই জেনে সে সন্তুষ্ট না, সূত্রটা কীভাবে বের হয়েছিল সেই জ্ঞানটুকু কী ধরনের রিসার্চে কতটুকু কাজে লাগে ইত্যাদি।
এ দেশের বাচ্চারা বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে নিজের My Aim in Life-এর ওপরে সক্রিয়ভাবে কাজ করে। বাবা-মা, বন্ধু বা চেনাজানার কাছ থেকে তথ্য নেয়, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিজের। আমি আশা করি, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরাও এই সুযোগ পাক ও কাজে লাগাক। তারাও ছোটবেলা থেকেই এগুলো নিয়ে ভাবুক। সুখবর যে, বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েরা অন্তত এই কনসেপ্টগুলোর সঙ্গে কিছুটা হলেও পরিচিত হচ্ছে। আমাদের মতো মাঝবয়সে এসে My Aim in Life বা Passion হাতড়ে মরবে না আশা করি।