জীবনের চ্যালেঞ্জকে হাসিমুখে নিয়েছেন নাসরিন

সাইয়েদা নাসরিন। এক সময় তিনি ছিলেন বিটিভির (বাংলাদেশ টেলিভিশন) তালিকাভুক্ত সংগীতশিল্পী। বাবা আশরাফ আলী চৌধুরী চার মেয়েকেই বাসায় ওস্তাদ রেখে গান শিখিয়েছেন। শুধু কী গান শেখা? ‘বাবা গিটার শিখব।’ এক মেয়ের আবদার। ‘শেখো...’। আরেক মেয়ে বায়না ধরেছে, ‘বাবা, ইকেবানা শিখব।’ বাবার কোনো আপত্তি নেই। নিজের মেয়েরাই কেবল নয়! ছেলের বউয়েরা চাইনিজ-বেকারি রান্না শিখতে চাইলেও তাঁর শতভাগ সমর্থন পেতেন। আশরাফ আলী চৌধুরী নিজের মেয়ে, পরের মেয়ে সবাইকে ডেকে একটা কথাই বলতেন, ‘দেখো, তোমরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছ ঠিকই! কিন্তু জীবন তোমাদের কোন দিকে নিয়ে যায় তার কী কোনো ঠিক আছে?’
নাসরিন নিজেও কি কোনোদিন এমনটা ভেবেছিলেন? ১৯৯৬ সালে ড্রাইভিং শিখেছিলেন অনেকটা শখের বশেই। তখন কী জানতেন, এই শেখাই তাঁকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে সাহায্য করবে প্রবাসে বিশাল এক শহরে! শখের বশে শেখা ড্রাইভিংই হবে একদিন তাঁর বেঁচে থাকার অবলম্বন! নীল আকাশের নিচে নিউইয়র্ক শহরের পথে পথে ট্যাক্সি চালাবেন তিনি! অচেনা শহরে, অপরিচিত মানুষের ভিড়ে নরম মাটিতে বহুদিন আগেই পা পিছলে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু তিনি কেবল শক্ত পায়ে দাঁড়াননি, বেছে নিয়েছেন ড্রাইভিংয়ের মতো নারীদের জন্য অপ্রচলিত এক পেশাকে।
ভাবুন একজন সাধারণ যাত্রীর কথা। যিনি ড্রাইভিং সিটে একজন নারীকে দেখে এমনিই চমকিত। তারপর যখন আলাপচারিতায় জানতে পারলেন, সেই নারী একজন বাংলাদেশি, তখন তো তাঁর চমক দ্বিগুণ হবেই। নারী নির্যাতন, অ্যাসিড সন্ত্রাস, ধর্ষণ, ইভ টিজিং দিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হওয়া দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর একজনকে এই মহানগরে এভাবে দেখতে পাওয়া অবাক হওয়ার মতোই।
নাসরিন কোনো নারীবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন। এসব নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামেও যান না তিনি। এসবের প্রয়োজনই হয় না তাঁর। নিজের জীবনকেই তিনি গড়েছেন নারী স্বাধীনতার এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে। তাই তো অনেকেই নাসরিনের গাড়িতে উঠে বলেন, ‘সারা বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নের তোমরাই হলে আসল শক্তি।’

কোথা থেকে এই শক্তি পেলেন একজন নাসরিন? সময়টা ২০০০ সাল। ওই বছর তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদের পরে পরিবারের সবাই বলেছিল দেশে চলে আসতে। ভিনদেশে শিশুসন্তানকে নিয়ে কীভাবে টিকে থাকবেন নাসরিন, এটাই ছিল প্রিয়জনদের দুশ্চিন্তার কারণ। কিন্তু নাসরিনের কেবল মনে হয়েছে, যে সন্তান আমেরিকার মাটিতে জন্মেছে। তার অধিকার আছে উন্নত দেশে বড় হওয়ার। তাকে সেই সুযোগ কেন দেয়া হবে না! বিয়ে ভেঙেছে বলেই জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে হবে?
আসলে এই দুর্ঘটনাই ছিল নাসরিনের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। নিজেকে চিনেছেন তিনি, খুলে গেছে তাঁর সব বাধ। অনেক দিন পরে সেই দিনগুলোর কথা ভেবে নাসরিনের আত্মবিশ্লেষণ হলো, ‘বিয়ে ভেঙে গেছে বলে ব্যক্তিসত্তা বিলীন করব কেন? যদি কোনো মেয়ের উপযুক্ত শিক্ষা আর আত্মবিশ্বাস থাকে, তবে সে যে কোনো জায়গায় ভালো করতে পারবে।’
ঢাকার ফার্মগেটের কাছে মণিপুরীপাড়ায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা নাসরিনের। স্কুলজীবন থেকেই ছিলেন লিডার। খুবই স্বাধীনচেতা। পরিবারের সবার ব্যক্তি চেতনাকে গুরুত্ব দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। এক ভাই গীতিকার শাহাদাত ইসলাম চৌধুরী মিন্টু। আরেক ভাই হকি খেলোয়াড় আমিনুল ইসলাম চৌধুরী লিটন। চার বোন গান শিখতেন। হোম ইকোনমিকস কলেজ থেকে সাইকোলজিতে মাস্টার্স করেছেন নাসরিন।
বিয়ের পরে আমেরিকায় আগমন। পরে এখানে ছেলের জন্ম। নাসরিন আমেরিকায় আছেন ২৭ বছর ধরে। এখানে আসার পর প্রথম ফাস্ট ফুডের দোকানের ক্যাশে কাজ করেছেন। ডোয়াইন রিডে কাজ করেছেন। নাসরিনের ভাষায়, ‘যত কাজ করেছি, আত্মবিশ্বাস তত বেড়েছে।’ বিবাহবিচ্ছেদের পরে প্রথম ছয় বছর রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে সেলসপারসন হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু সেখানে কাজের চাপ ছিল প্রচণ্ড। অফিস ছুটির পরও দীর্ঘক্ষণ থাকতে হতো। একপর্যায়ে আমেরিকাজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় ধস নামে। তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই ইয়োলো ক্যাব ড্রাইভিং পেশাকে বেছে নেন নাসরিন। একমাত্র পুত্র রাফফাত আলমও মায়ের নতুন পেশাতে খুব খুশি। কারণ আগের চেয়ে মাকে বেশি কাছে পাচ্ছে ও।
ড্রাইভিং পেশাতে স্বাধীনতা অনেক বেশি বলে জানালেন নাসরিন। ভোর পাঁচটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত গাড়ি চালান তিনি। কাজের ফাঁকে ব্যক্তিগত অনেক কাজ সেরে ফেলেন। ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে একসঙ্গে লাঞ্চ করেন। বাজার করেন একফাঁকে। নাসরিন হেসে বললেন, ‘বাবা ও মা দুই ভূমিকাতেই কাজ করতে হয় আমাকে। এমন তো নয় সারা দিন পরিশ্রম করে বাড়িতে ফিরে সবকিছু সাজানো-গোছানো দেখতে পাব। বাসারও তো সব কাজই নিজেকে করতে হয়।’ এরপর তিনি যুক্ত করেন, ‘ইনডেস্ক জবে সমস্যা হলো বসের কথা অনুযায়ী চলতে হয়। এখানে আমার কোনো বস নেই। যখন খুশি তখন অফিসে এলাম, গেলাম, কেউ বাধা দিচ্ছে না।’
নাসরিন জানিয়েছেন, নিউইয়র্ক শহরে শতকরা ৬০ ভাগ ক্যাবচালক এশিয়ান। এর বাইরে রাশিয়া ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত চালকও আছে অনেক। ইয়েলো ক্যাব, ব্ল্যাক ক্যাব, লিমোজিন চলে সাধারণত নিউইয়র্কের রাস্তাঘাটে। ট্যাক্সি লিমো কমিশনে আবেদন করতে হয় হ্যাক লাইসেন্স পাওয়ার জন্য। এটাকে স্পেশাল লাইসেন্স বলে। টিএলসিতে গিয়ে ড্রপ টেস্ট করতে হয়।
নাসরিনকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনো সমস্যা হয় না গাড়ি চালাতে গিয়ে? নিউইয়র্ক তো বারো জাতের মানুষের শহর, কেউ কি কোনো বাজে মন্তব্য করে?
‘আরে না! বরং অনেকেই গাড়িতে উঠে খুশি হন। মজা করে বলেন, ওয়াও! লেডি ড্রাইভার! আজকের দিনটা ভালো যাবে মনে হচ্ছে। আর এখানে সব চালকই গাড়িতে ঢুকেই লগ ইন করেন। কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটর করা হয়। আর গাড়িতে যদি কোনো যাত্রী সমস্যা করে, তবে আমরা একটা লাইট জালাই। তৎক্ষণাৎ পুলিশ আমাদের পিছু নেয়।’
অভিবাসী বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ এখানে ট্যাক্সি চালান। আর্থিক দিক থেকে পেশা হিসেবে এটা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। তবে নারীদের মধ্যে সেভাবে কাউকে এই পেশায় আসতে দেখা যায় না। এ তথ্য জানিয়ে নাসরিন বললেন, ‘১৯৯৩ সালে নাজমা আপা প্রথম এই পেশায় আসেন। তারপর ২০০৬ সালে শুরু হয় আমার পথ চলা। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ২০ জন মেয়েকে পাওয়া যাবে, যাঁরা নিউইয়র্ক শহরে ট্যাক্সি চালান।
রিয়েল এস্টেটে কাজ করার সময় নিউইয়র্ক শহরের ওজোন পার্কে বাড়ি কিনেছেন নাসরিন। ঢাকার মণিপুরীপাড়ায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি নিজের শখকেও বিসর্জন দেননি। সংগীত চর্চায় যুক্ত আছেন এখানেও। শিল্পকলা একাডেমি নিউইয়র্ক ইনকের সব প্রোগ্রামে নিয়মিত যান।
খুব সংস্কৃতিমনা এই মানুষটি বলেন, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশের মানুষ অনেক প্রগতিশীল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। ওই সময়টাতে বাবা-মায়ের সঙ্গে পালিয়ে বেড়াতাম। আমি তখন শিশু। তবু বোমা পড়ার শব্দ এখনো শুনতে পাই। ওই সময়ে মানুষের সাহস এখনো মনে কাজ করে।’
মনিজা রহমান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র