জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে বিশ্ব বইমেলা
মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারক ইয়োহানেস গুটেনবার্গের জন্ম জার্মানির মাইনস শহরের কাছে। তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত মাইনস বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এ জন্যই বিশ্ব বইমেলা বসে প্রতিবছর সোনালি শরতে মিষ্টি রোদের আমেজে মাইন নদীর বুকে ব্যাংকিং শহর ফ্রাঙ্কফুর্টে।
স্কাই লাইনের জন্য এ শহরকে জার্মানির মাইনহাটন বলে। তবে অফিশিয়ালভাবে বলে Frankfurt am Main. কারণ, ইউরোপের দীর্ঘতম নদী মাইনপারে অবস্থিত বলে। নদী চওড়া খুব বেশি নয়। গত বছর কোভিড–১৯ মহামারির কারণে ভার্চ্যুয়ালি এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বইমেলা আয়োজন করে জার্মান বই প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা। মেলা চলাকালে মেলা মুখর হয় সারা বিশ্বের খ্যাতনামা লাখো লেখক, সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক, প্রকাশক ও বইপাগল মানুষের পদচারণে।
এবারের মেলা চলবে অক্টোবরের ২০–২৪ তারিখ পর্যন্ত। প্রতিবছর একেকটি দেশকে বিশেষ অতিথি করা হয়। আর সেই দেশটি মেলায় বইয়ের সঙ্গে তাদের পুরো কৃষ্টি তুলে ধরে। গত বছর এ সম্মানিত দেশ ছিল কানাডা, এ বছরও তারা। উদ্বোধনীতে অংশ নেন জার্মান সরকারপ্রধান; অতিথি হিসেবে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানসহ উচ্চপদের প্রধানেরা। এ অনুষ্ঠানের নাম ‘লালগালিচা ওপেনিং বইমেলা’। গত বছরের এ ওপেনিংয়ে বাংলাদেশ, তথা এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন লেখক–কবি, গণমাধ্যমকর্মী ও একুশে পদকপ্রাপ্ত নাজমুন নেসা পিয়ারী এবং জার্মান বাংলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি খান লিটন।
গতবারের মেলায় বঙ্গবন্ধু কর্নার করার কথা ছিল জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে। এবার সেটা হবে, দূতাবাসের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন। তবে মহামারির কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশকেরা আসবেন কি না, এখনো সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানান বাংলাদেশ সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ। এ মেলায় প্রতিবছর তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের একজন প্রকাশককে বিনা মূল্যে স্টল দেয় এবং ফ্রাঙ্কফুর্টে আসা–যাওয়ার খরচ ও হোটেলের ব্যবস্থা করে। নারী প্রকাশক ও নতুন প্রকাশকদের এ সুযোগ দেওয়া হয়। তাই বাংলাদেশের প্রকাশকেরা বাংলাদেশের বাংলাবাজারে সীমাবদ্ধ না থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় এলে মুদ্রণ ব্যবসায় হতে পারে আমূল সাফল্য। যদিও মেলা চলাকালে কোনো বই বিক্রি হয় না, শুধু বাণিজ্যিক চুক্তি হয়। মেলায় টিকিট কেটে সবাইকে ঢুকতে হয়। তবে মেলার শেষের দিন যাঁরা বাহারি সাজে সেজে আসবেন, তাঁরা ফ্রি প্রবেশ করতে পারেন। অন্যদিকে কোভিডের এ বছর এককালীন পুরো সময়ের টিকিট দেওয়া হবে না, অনলাইনে নিবন্ধন করে প্রতিদিনই টিকিট নিতে হবে। কোভিড নেগেটিভ সনদ থাকতে হবে। তা ছাড়া বেশির ভাগ ইভেন্ট সরাসরি ও অনলাইনভিত্তিক হবে।
পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি প্রতিবছর সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ‘শান্তি পুরস্কার’ দেয় শহরের পল গির্জায়। জার্মানরা যখন খাবার কিনতে যান, তখন খাবার কেনেন পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য। ফুল কেনেন প্রিয়জনের জন্য, সঙ্গে বই কেনেন জানার জন্য। ট্রেনে বসে কিংবা স্টেশনে দাঁড়িয়ে ও রাতে শোবার আগে বই পড়েন, বাচ্চাদের পড়ে শোনান। নিজে পড়েন ও প্রিয়জনকে বই উপহার দেন। বেশির ভাগ রাস্তার মোড়ে আলমারিতে বই রাখা আছে। যাঁর দরকার, তিনি নিয়ে বই পড়ে আবার যথাস্থানে রেখে যান। অনেকে নিজের পড়া শেষে তাঁর বইও এসব আলমারিতে রেখে যান। এ কারণেই টিকে থাকবে, বসবে বিশ্ব বইমেলা ফ্রাঙ্কফুর্টে।
মেলা কর্তৃপক্ষ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘এ শরতে আবার শুরু হবে বইমেলা। যখন ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা তার দরজা খুলবে, আমরা আপনাকে, মেলার প্রদর্শকদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। আমরা আবার বিশ্বের বইপাগল মানুষদের জড়ো করতে সহযোগিতা করছি। সর্বোপরি, কেবল একসঙ্গে কাজ করে আমরা ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলায় যা বিগত দিনে করতে পেরেছি ও করতে পারি, এমনকি এই বছরও। বিশেষ করে এ বছর ২০২১ সালে আবার আমাদের সঙ্গে যোগ দিন, যখন বিষয়বস্তুর জন্য বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য মেলা প্রতিটি মহাদেশের মানুষের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করে। ফ্রাঙ্কফুর্টে যখন বই এবং মিডিয়া শিল্প পুনরায় সংযোগ স্থাপন করে, তখন সেখানে থাকুন। সর্বোপরি, ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ হচ্ছে, যা অপ্রত্যাশিত ব্যবসায়িক সুযোগ, বিস্ময়কর মুহূর্ত এবং উদ্ভাবনী ধারণা তৈরি করে, যা সবই ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা বিশ্বব্যাপী প্রকাশনা সম্প্রদায়ের জন্য মহামিলন মেলা। আমরা এ বছরের মেলায় সব অংশগ্রহণকারীর জন্য একটি অনন্য ধারণা তৈরি করেছি, সংশোধিত শর্তাবলি, একটি উদার বাতিলের নীতি এবং একটি নমনীয় কর্মসূচি, যা পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি এবং চ্যালেঞ্জগুলোর দ্রুত সাড়া দেওয়া সম্ভব করে তোলে।’
জার্মান সরকারের ‘সংস্কৃতির নতুন যাত্রা’ কর্মসূচির তহবিল থেকে ৭৩তম ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলাকে সমর্থন করা হচ্ছে।