জার্মানিতে বড়লোক নেই কেন

বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় অটোমোবাইল কোম্পানি জার্মানিতে। কেমিক্যাল প্রোডাকশনে বিশ্বে ১ নম্বরে রয়েছে জার্মানি। প্রসাধনী তৈরিতেও বিশ্বে প্রথম সারির দেশের তালিকায় রয়েছে জার্মানি। মেশিনারিজ ও কলকবজা তৈরিতেও জার্মানি হচ্ছে বিশ্বে অন্যতম সেরা দেশ। স্পোর্টস ও গার্মেন্টস ব্র্যান্ডিংয়ে প্রথম সারির দেশের তালিকায়ও রয়েছে জার্মানির নাম। জার্মানিতে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনে জার্মানি বিশ্বে ২ নম্বরে। সফটওয়্যার তৈরিতে বিশ্বে ৪ নম্বর দেশ জার্মানি। রেলের ইঞ্জিন তৈরিতে জার্মানি বিশ্বে ২ ও ৩ নম্বর। জার্মানির তৈরি পণ্যের মার্কেট রয়েছে বিশ্বব্যাপী। এত এত হোমরাচোমরা কোম্পানি আর কোম্পানির মালিক থাকার পরও বিশ্বে প্রথম ৩৩ জনের মধ্যে জার্মানির কোনো বড়লোক নেই! কী আশ্চর্য! কেন নেই? ব্যাপারটা মোটামুটি জার্মানিতে যাঁরা ব্যবসা বা চাকরি করেন, তাঁরা সবাই ঠাওর করতে পারেন।

আসলে জার্মানির প্রশাসন হচ্ছে ইনকাম–চোষা প্রশাসন। মানুষ ইনকাম যা করেন, তার প্রায় অর্ধেক তারা এটা-সেটা করে চুষে, চেটেপুটে খেয়ে ফেলে। তারা এতটাই ইনকাম-চোষা যে শিক্ষার্থীদের গতরখাটানো মাত্র ৪৫ হাজার টাকা (৪৫০ ইউরো) ইনকামেও ভাগ বসায়। মাস শেষে ৪৪ হাজার টাকা ইনকাম করবেন তো কানের গোড়া দিয়ে গুলি যাবে। মানে ট্যাক্স দেওয়া থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাবেন। ৪৫ হাজার টাকা কামালেই ধরা! ট্যাক্সের টাকা কেটে বেতন পাঠিয়ে দেবে।

ট্যাক্সের আবার ক্লাসও বসিয়ে দিয়েছে। ১, ৩, ৫, ৬ ইত্যাদি ধরনের ক্লাস। মানে হচ্ছে কার ইনকাম কত, সংসারে ছেলেমেয়ের বোঝা কেমন, যদিও বিবাহিত হলে ট্যাক্স কম কাটে। কারণ, বাচ্চাদের ভরণপোষণের ব্যাপারস্যাপার আছে। অবিবাহিত হলে গোড়া থেকেই ট্যাক্সের পোঁচটা দেয়। আর চাকরি যদি দুইটা হয়, তাহলে দ্বিতীয় চাকরির খুব সামান্য টাকাই খরচ করতে পারবেন। প্রায় পুরোটাই তারা খেয়ে ফেলবে। তাহলে চিন্তা করেন, যাঁরা সামান্য ৪৫ হাজার টাকা বেতনের লোভ সামলাতে পারে না, তারা এসব বিলিয়ন ইউরো কামানো মানুষদের ইনকামে কেমনে ছোবলটা দেয়!

আপনি ট্যাক্স ফাঁকি দেবেন? নো ওয়ে! তারা ট্যাক্স, পেনশন, জবলেস ইনস্যুরেন্স, হেলথ ইনস্যুরেন্স বেতন থেকে ছেঁড়াফাটা করেই উচ্ছিষ্টটুকু আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেবে। ‘নাও বিয়ার খাও, আর দেশ–বিদেশে ঘুরে বেড়াও’—ভগিজগির কোনো সুযোগই নেই।

তবে এটা ভালো যে টেনেহিঁচড়ে যে কয়টা টাকা রেখে দিল, ওটা আপনার জন্যই খরচ হবে। সিস্টেমটা খুব মজার। বড়লোকের ন্যূনতম খরচ বাদ দিয়ে উচ্ছিষ্ট টাকা প্রশাসন তার নিজ দায়িত্বে অসহায়, বেকার, বয়স্ক ও শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষের মধ্যে ভাগ–বাঁটোয়ারা করে দেয়। একটা নিখাঁদ ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার সিস্টেম।

বেতন প্রায় অর্ধেক কেটে নেয় বলে যাঁরা আফসোস করে কষ্ট পাচ্ছেন, তাদের জন্য এবার কিছু ভালো কথা বলি! বিশ্বের অন্যতম সেরা নাগরিক সুবিধা পাবেন জার্মানিতে। পড়াশোনা করতে টাকা লাগবে না। বিনা মূল্যে পাবেন উচ্চশিক্ষা। পড়াশোনা করার জন্য তো একটা বাসাবাড়ি নিয়ে থাকতে হবে। টাকা কোথায় পাবেন? নো টেনশন! টাকার ব্যবস্থা সরকার করবে। পরে আপনি চাকরি পেলে ওই টাকা আবার কড়ায়–গন্ডায় উশুলও করে নেবে। চাকরি–বাকরি নেই? আরে টেনশন নেই। বেকার ভাতা দেবে সরকারে। এটা অগা–মগা টাইপের ভাতা নয়। প্রায় বেতনের সমানই ভাতা পাবেন। সন্তানের সংখ্যার ওপর সরকারি ভাতা পাবেন। টিভি–রেডিও শোনেন বা না শোনেন! মাস শেষে দেড় হাজার টাকা বিল আপনাকে গুনতেই হবে। রেডিও-টিভির কর্মচারীদের বেতন দিতে হবে না! তাঁদের পেট চলবে কী করে?

মাহবুব মানিক

আপনাকে মরণব্যাধিতে ধরছে অথচ পকেট ফুটো! বেঁচে থাকার জন্য বিশ্বের সেরা চেষ্টাটুকু পুরো ইউরোপের নামীদামি হাসপাতাল করবে। টাকা নিয়ে টেনশন নেই। পুরো চিকিৎসার বিল আপনার ইনস্যুরেন্স কোম্পানি যে কোন দিক দিয়ে পরিশোধ করবে, টেরও পাবেন না। দৈনন্দিন খাবার নিয়ে টেনশন করতে হবে না। নিত্যপণ্য জিনিসের দাম নাগালের মধ্যে। মানে আর কী! আপনি যে বেতন পাবেন, তা দিয়ে ইচ্ছা করলে কমপক্ষে তিন মাস মন যা চায়, তা–ই বাজার করে খেতে পারবেন। উল্টাপাল্টা কাজ কিংবা দুই নম্বরি করলে ধরাও খাবেন সেই মতোই। সামান্য পান থেকে চুন খসলে জরিমানাও গুনবেন বড় আকারে, অর্থাৎ সিধা হয়ে চলতে হবে৷

রাস্তাঘাটে ‘আমাকে চিনিস’ বলে ঘুষি মেরে বসলেই খবর। আর্থিক বিশাল অঙ্কের জরিমানা তো আছেই সঙ্গে জেলও খাটতে হতে পারে। তবে দৈনন্দিন জরিমানা ও অযাচিত বিল থেকে এড়ানোর জন্য অনেকগুলো ইনস্যুরেন্স করে রাখতে হয়। যদিও এগুলো নামমাত্র ইনস্যুরেন্স নয়, কাজেরও বটে। যেমন ঘরের ইনস্যুরেন্স, এটাকে বলে ‘হাউজরাট ফার্জিশারুং’। ঘরের কোনো ফার্নিচার বা জানালা–দরজা ঝড়বাদল বা দুর্ঘটনায় ভেঙে গেলে ইনস্যুরেন্স রিপেয়ার করার টাকা দেবে। লায়াবিলিটি ইনস্যুরেন্সের নাম ‘হাফটফ্লিশ ফার্জিশারুং’। কোয়ালিটিসম্পন্ন যেকোনো জিনিসেরই জার্মানিতে দাম একটু বেশি থাকে। তাই অন্যের দামি কোনো কিছু ভেঙে ফেলা কিংবা দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি করা জার্মানিতে বড়ই বিপদের।

তার জন্য লায়াবিলিটি ইনস্যুরেন্স করে রাখতে হবে। লাইফ ইনস্যুরেন্সের নাম ‘লেবেন্স ফার্জিশারুং’। এটা আমাদের দেশেও আছে। মরে গেলে পরিবার কিছু টাকা পাবে। গাড়ির ইনস্যুরেন্স করা হয় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে ভেঙে গেলে মেরামত খরচ পোষানোর জন্য৷ ডেথ ইনস্যুরেন্সের নাম ‘স্টেরবেগেল্ড ফার্জিশারুং’। এই ইনস্যুরেন্স করার কারণ হচ্ছে জার্মানিতে ফিউনেরাল কস্ট অনেক বেশি। তাই ইনস্যুরেন্স করা থাকলে মরার পর আত্মীয়দের আর আপনার ডেড বডি নিয়ে টেনশন করতে হবে না। ইনস্যুরেন্স কোম্পানি আপনার দাফন–কাফন করিয়ে কবরে রেখে আসবে। মোদ্দা কথা, জার্মানি কোনো হম্বিতম্বি–মার্কা বড়লোকের দেশ নয়, তবে শান্তির দেশ। জার্মানির অফিসগুলোতে কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ হয় না, এখানে সবাই কর্মচারী। ঘরে যেমন কাজের বেটি রহিমা নেই, তেমনি অফিস–আদালতে পিয়ন–চৌকিদার আবদুল নেই। নিজের কাজ সবাই নিজে করে। সবাই জার্মানিতে আমজনতা। এখানে ভিআইপি বলে কিছুই নেই। মধ্যবিত্ত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বাঁচার জন্য এর থেকে উত্তম জায়গা পৃথিবীতে পাওয়া বিরল।

  • লেখক: মাহবুব মানিক, হালে, জার্মানি