জাপানের রঙিন পাতা দেখার উৎসব

নদীর তীরে কাশফুল, নীল আকাশে মেঘের ভেলা আর ঘাটে নৌকা বাঁধা—স্কুল জীবনে শরতের এ রকম অনেক ছবি এঁকেছি। বাংলার প্রকৃতিতে শরতের আবির্ভাব মুগ্ধ করেছে আমাদের। শরৎ মানেই নদীর তীরে কিংবা বালুচরে কাশফুল। শরৎ মানেই গাছে গাছে হাসনাহেনা আর বিলে শাপলার সমারোহ। বর্তমানে শরতের পাকা তাল দিয়ে তৈরি পিঠা কিংবা পায়েস না খেলেও কিংবা খেতে আমন ধানের বেড়ে ওঠা চারা দেখতে না পেলেও ফেসবুকে মানুষের কাশফুলের সঙ্গে সেলফি তোলা দেখেই আমরা বুঝতে পারি বাংলায় শরৎ এসেছে।
বাংলার ছয় ঋতুর তৃতীয় ঋতু শরৎকে ইংরেজিতে অটাম বলা হলেও উত্তর আমেরিকায় একে ফল নামে ডাকে। এই সময়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পত্র ঝরা বৃক্ষের পাতা ঝরে যাওয়া। পশ্চিমা দেশে অবস্থানরত বন্ধুদের ফেসবুক প্রোফাইলের ছবি শরতে ম্যাপল গাছের কল্যাণে রঙিন হয়ে ওঠে। জাপান চার ঋতুর দেশ—গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত ও বসন্ত। তবে কাগজে-কলমে বর্ষাকাল না থাকলেও সারা বছর বৃষ্টি হয়।

জাপানের শরৎকালটা অন্যরকম। একদিকে হালকা শীতের আমেজ অন্যদিকে গাছে গাছে রঙিন পাতা। জাপানে শরতের গাছের রঙিন পাতার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর স্পট আছে। তারা উৎসবের আমেজ নিয়ে রঙিন পাতার সৌন্দর্য অবলোকন করেন। একে বলা হয় মমিজি মাতসুরি বা রঙিন পাতা দেখার উৎসব। মমিজি অর্থ হলো গাছে গাছে রং বদলানো পাতা বা ম্যাপল পাতা। এ সময় সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে ম্যাপল গাছের রঙিন পাতা যা আমরা সেঞ্চুরি পাতা হিসেবে চিনি। হানাবি বা চেরি ফুল দেখার উৎসবের মতোই মমিজি ক্ষণস্থায়ী। এক থেকে দেড় মাসের মাথায় সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়। সাধারণত নভেম্বর মাসে মমিজি দেখার উৎসব হয়ে থাকে। ভাবতেই অবাক লাগে, পত্র দর্শনও এখানে এক জমজমাট উৎসবের মতো।

জাপানে মমিজির জন্য বিখ্যাত জায়গাগুলো এ সময় প্রচুর দর্শক আকর্ষণ করে। গত ১৩ নভেম্বর পত্র দর্শনে আমরা বন্ধুরা মিলে সপরিবারে গিয়েছিলাম জাপানের আইচি প্রিফেকচারে টয়োটা শহরের করানকেই নামক স্থানে। আমাদের শিজুওকা শহর থেকে গাড়িতে প্রায় চার ঘণ্টার পথ। যেতে যেতেই অনেক জায়গায় চমৎকার রঙিন পাতা চোখে পড়ল। কখনো পাহাড়ের গায়ে সবুজ বৃক্ষের ফাঁকে ফাঁকে, কখনো বা পথের ধারে। করানকেই সত্যিই আমাদের অবাক করে দিল। পাহাড়ের দিকে তাকালে যত দূর চোখ যায়, লাল কমলা হলুদের হাতছানি। মাঝে মাঝে গাঢ় সবুজ যেন লাল হলুদের ঘনত্বকে আরও উজ্জ্বলতর করেছে! এ অপার সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয় না। নাওয়া খাওয়া ভুলিয়ে দেওয়ার মতো অতি মনোহর,

মনোমুগ্ধকর এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য! নদীর দুই পাশে পাহাড়ে গাছগুলোতে যেন আগুন ধরে গেছে। পাহাড়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সুন্দর রাস্তা। অন্যদিকে নদীর এ পাশ থেকে ওপাশে যাওয়ার জন্য ঝুলন্ত সেতুসহ অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর সেতু। চোখ ভরে এ নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখার জন্য রয়েছে বসার স্থান। একদিকে পাহাড়ি ঝরনা, অন্যদিকে পানির কল কল ধ্বনির সঙ্গে রঙিন পাতার সৌন্দর্য, সব মিলিয়ে অন্য রকম এক অনুভূতি। রাতেও এ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। রঙিন লাইটের আলোতে এ এলাকা আরও আলোকিত হয়ে নতুন রূপ ধারণ করে। এখানকার খাবার হোটেলগুলো এমনভাবে নদীর ধারে স্থাপন করা যে আপনি বসে খাবার খেতে খেতে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। ছোটবেলায় যা ক্যালেন্ডারে কিংবা দেয়ালে টানানো পোস্টারে দেখতাম, সেই অপরূপা দৃশ্যগুলো সামনে থেকে দেখে মুগ্ধ আমরা হয়ে গেলাম।
*লেখক পিএইচডি গবেষক, শিজুওকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।