জাপানের ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট ফুজি

জাপানের মাউন্ট ফুজি আগ্নেয়গিরি। ছবি: মো. আরিফুর রহমান ফাহিম
জাপানের মাউন্ট ফুজি আগ্নেয়গিরি। ছবি: মো. আরিফুর রহমান ফাহিম

মাউন্ট ফুজি জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে হনশু দ্বীপে অবস্থিত। বিশ্বের সবচেয়ে সৌন্দর্যময় এই পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা ৩ হাজার ৭৭৬ মিটার (১২ হাজার ৩৮৯ ফুট)। জাপানিদের কাছে এটি শুধু একটি পর্বত নয়; অন্যতম জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীকও। বরফে ঢাকা ঘুমন্ত এই আগ্নেয়গিরি কত কবির কল্পনাকে সমৃদ্ধি করছে, তার ইয়ত্তা নেই।

দর্শনীয় এই স্থানকে ২০১২ সালে জাপানের ১১তম বিশ্ব হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে ইউনাইটেড ন্যাশনস এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (ইউনেসকো)। টোকিও জাপানের রাজধানী হয় ১৬০০ সালে, তখন এর নাম ছিল এডো। এডো যাওয়ার পথের নাম ছিল তোকাইডো। সেই পথ থেকেই দেখা যেত ফুজি। শিজুওকা থেকে টোকিও যাওয়ার ট্রেনলাইন ‘তোকাইডো লাইন’ নামে পরিচিত। এ লাইন দিয়ে ট্রেনে টোকিও যেতে হলে ফুজি এলাকা দিয়ে যেতে হয়। পরিষ্কার দিনে শিজুওকা কিংবা টোকিও থেকে এ পর্বতকে স্পষ্ট দেখা যায়।
পর্যটক ও পর্বতারোহীদের কাছে মাউন্ট ফুজি একটি জনপ্রিয় স্থান। লোকমুখে জানা যায়, ৬৬৩ সালে এক ভিক্ষু প্রথমবার এই পর্বত জয় করেন। অন্যদিকে, ৮৬০ সালে স্যার আলোক নামে এক বিদেশি প্রথম ফুজি আরোহণ করেন। এ পর্বতশৃঙ্গের চূড়ায় আরোহণ করতে গেলে প্রায় ১০টি স্টেশন পার হতে হয়, তবে পঞ্চম স্টেশন পর্যন্ত গাড়ি নিয়েই ওঠা যায়।

জাপানের উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট ফুজি। ছবি: মো. আরিফুর রহমান ফাহিম
জাপানের উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট ফুজি। ছবি: মো. আরিফুর রহমান ফাহিম


জাপানে আসার পর থেকে অপেক্ষা করছি কাছ থেকে মাউন্ট ফুজির মোহনীয় রূপ দেখার জন্য। প্রথমবার দেখতে গেলাম এ বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় এবং পঞ্চম স্টেশনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ থাকায় কাছ থেকে দেখা হলো না। দ্বিতীয়বার মে মাসের প্রথম দিনে গেলাম। আগে থেকেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে জেনে নিলাম ২৮ এপ্রিলের পর পঞ্চম স্টেশনে যাওয়ার রাস্তা খুলবে। অনেক আনন্দ নিয়ে মাউন্ট ফুজির মোহনীয় রূপ দেখতে দেখতে যাচ্ছি। কিন্তু পঞ্চম স্টেশনের খুব কাছে পাহাড়ি পথে আমাদের গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। নিচে নামতে সমস্যা নেই, কিন্তু ওঠার পথে গাড়ির ইঞ্জিন কাজ করছে না। ঝুঁকি না নিয়ে ফিরে এলাম, তবে হাল ছেড়ে দিইনি। আবার গেলাম ৫ মে। এদিন সফলভাবে পঞ্চম স্টেশনে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলাম। অবশেষে আকাশছোঁয়া জাপানের উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট ফুজির দেখা পেলাম। ছবিগুলো পঞ্চম স্টেশন থেকে তোলা, যার উচ্চতা ২ হাজার ৪০০ মিটার অর্থাৎ আর ১ হাজার ৩৭৬ মিটার হেঁটে পাড়ি দিলেই জয় করা যাবে এই পর্বত।
তুষারে আবৃত পাহাড়চূড়ার অপার সৌন্দর্য ও একে ঘিরে থাকা পাঁচটি লেকের সৌন্দর্য সমানভাবেই আকর্ষণীয়। ফুজি একটি সক্রিয় স্ট্র্যাটো ভলকানো। বছরে প্রায় তিন লাখ পর্বতারোহী এর আকর্ষণে ছুটে আসেন। প্রতিবছর জুলাই-আগস্ট মাসে এটি পর্বতারোহীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। আমার বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ শিজুওকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি গবেষক নজরুল ইসলাম ও জাহাঙ্গীর আলম ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট মাউন্ট ফুজি জয় করেছিলেন। এটি একটি লাভা গঠিত সক্রিয় আগ্নেয়গিরি এবং ১৭০৭-০৮ সালে এখানে সর্বশেষ অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটে। মাউন্ট ফুজির জ্বালামুখটি আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিসম, যা বছরের বেশ কয়েক মাস বরফাচ্ছাদিত থাকে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যদি মাউন্ট ফুজির প্রবল অগ্ন্যুৎপাত ঘটে, তবে টোকিও শহরটি ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে যেতে পারে। এ ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট ফুজিকে নিয়ে জাপানিদের যেন গর্বের শেষ নেই।

মো. আরিফুর রহমান ফাহিম : পিএইচডি গবেষক, শিজুওকা ইউনিভার্সিটি, জাপান