জাপানের আসিকাগা শহরে পঞ্চম পিঠা উৎসব
পিঠা বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পিঠা খেতে ভালোবাসেন না, এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রবাসীদের অনেকেই পিঠা খাওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হন। সে জন্য জাপানে বসবাসরত প্রবাসীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় পঞ্চম আসিকাগা পিঠা উৎসবের। ১২ ডিসেম্বর তোচিগি কেনের আসিকাগা সিটিতে বাংলাদেশ কমিউনিটি কিতা কানতোর পক্ষ থেকে সুইয়ামা লুবনার উদ্যোগে পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়।
বরাবরের মতো এ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রবাসীদের পিঠা খাওয়ার অতৃপ্তি কিছুটা দূর করার পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরা। অন্য বছরের তুলনায় করোনার কারণে বিধিনিষেধ মান্য করে কিছুটা ছোট পরিসরেই আয়োজন করা হয় এবারের পিঠা উৎসব। জাপানের বিভিন্ন শহরের ৩৫টি পরিবারের সদস্যসহ প্রায় ১৩০ জন এই পিঠা উৎসবে অংশ নেন। পিঠা উৎসবটি জাপানের কানতো অঞ্চলের বাঙালির এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। নারীদের পরনে ছিল একই রঙের শাড়ি আর পুরুষদের বাঙালির প্রিয় পোশাক পায়জামা-পাঞ্জাবি। মহান বিজয় দিবসকে মাথায় রেখে পুরুষদের পাঞ্জাবির রং নির্ধারণ করা হয় সবুজ।
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিল মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাচ্চাদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এতে ২৬ প্রতিযোগী অংশ নেয়। সবাইকেই পুরস্কার দিয়ে উৎসাহিত করা হয়।
মধ্যাহ্নভোজে বড়দের জন্য ছিল বিফ বিরিয়ানি, কাবাব, ডিম ও সালাদ। ছোটদের জন্য ছিল জাপানিজ কারি। রান্নার দায়িত্বে ছিলেন শিলা আলম, সুইটি জাকির, সাবরিনা আজিম, মেহেজাবিন ইরা, দিপা আলম ও লুবনা। করোনার বিধিনিষেধ মেনে হলের বাইরে খোলা মাঠে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
দ্বিতীয় পর্বে ছিল পিঠা প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় পর্বের শুরুতেই আসিকাগা পিঠা উৎসবের পিঠা প্রতিযোগিতার বিচারক আসলাম খন্দকারের সুস্থতা কামনা করে দোয়া প্রার্থনা করা হয়।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছিল রাফি ও মিমনুনের সুরা পাঠ। এরপর ছিল নারীদের সমবেত সংগীত ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি’। এরপরই ছিল পুরুষদের ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর’। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একক গান পরিবেশন করেন জাপানের বাংলাদেশ কমিউনিটির গুণী শিল্পী নিপুণ তাবিয়া, সাবরিনা ও রেইন কারিম। কবিতা আবৃত্তি করেন সুপরিচিত আবৃত্তিকার আয়েশা মিতু ও মেহেজাবিন ইরা। নৃত্য পরিবেশন করে খুদে শিল্পী আমিরা তাহরিম, নাবা ও পূজা। বরাবরের মতোই দর্শকেরা উপভোগ করেন নৃত্য তিনটি। সব শেষে ছোট্ট সুইয়ামা তিরানা করে জাপানিজ গানের সঙ্গে নাচ।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর শুরু হয় জাপানের অন্যতম জনপ্রিয় ‘নিপুণ তাবিয়া’ পেজের সৌজন্যে আসিকাগা পিঠা উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব পিঠা প্রতিযোগিতা।
নিজ হাতে তৈরি পিঠা নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন ১৬ প্রতিযোগী। পিঠা প্রতিযোগিতায় ছিল পাঁচটি বিভাগ। প্রতি বিভাগের জন্য ছিল আলাদা নম্বর। বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ কমিউনিটির পরিচিত দুই মুখ লেখক-সাংবাদিক কাজী ইনসানুল হক ও দিদার কচি। বিচারকের একটি আসন আসলাম খন্দকারের সম্মানে খালি রাখা হয়। প্রতিযোগিতা শেষে বিচারকেরা যখন বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করছিলেন, তখন পুরো হলে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে।
প্রতিযোগিতায় বিচারকদের রায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন খোদেজা আক্তার। তিনি তৈরি করেন দুধক্ষীর পুলি পিঠা। নারকেলের পাকন পিঠা তৈরি করে প্রথম রানারআপ হন মারিয়াম সাথি, মেরা পিঠা তৈরি করে দ্বিতীয় রানারআপ হন নিগার সুলতানা। ঝাল ফুলি পিঠা তৈরি করে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন ঊর্মি কামাল। পঞ্চম ও ষষ্ঠ হন আয়েশা মিতু ও ফারজানা দোলন। তাঁরা তৈরি করেন গোলাপ পিঠা ও মুগের পাকন পিঠা। বিজয়ী ছয়জনের হাতে পুরস্কার তুলে দেন নিপুণ তাবিয়া পেজের কর্ণধার নিপুণ তাবিয়া।
পুরস্কার হিসেবে ছিল নিপুণ তাবিয়া পেজের পক্ষ থেকে বেশ কিছু উচ্চ মানের কসমেটিক। চ্যাম্পিয়ন খোদেজা আক্তারকে মুকুটও পরিয়ে দেন সুইয়ামা লুবনা। এ ছাড়া সব প্রতিযোগীকে বাংলাদেশ কমিউনিটির পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করা হয়।
পিঠা উৎসবে ছিল নারীদের পিলো গেম। দারুণ উত্তেজনার পিলো গেমের স্পনসর করে জাপানের ‘মনিকা অনলাইন শপ’। পিলো গেমের প্রথম তিনটি পুরস্কার জিতে নেন ঊর্মি কামাল, মুন হায়দার ও মেহেজাবিন ইরা। পুরস্কার হিসেবে ছিল দুটি শাড়ি ও ব্যাগ। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন মনিকা অনলাইন শপের কর্ণধার মনিকা চন্দ।
এরপর ছিল সবার আগ্রহে থাকা পিঠাভোজন। মজাদার প্রায় ২০ রকমের পিঠা দিয়ে সাজানো হয় পর্বটি। উল্লেখযোগ্য পিঠার মধ্যে ছিল ভাপা পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, নারকেলের পাকন পিঠা, দুধক্ষীর পিঠা, মিষ্টি পুলি পিঠা, মেরা পিঠা, পাটিসাপটা, মুগের পাকন পিঠা, চিতই পিঠা, ঝাল পুলি পিঠা। এ ছাড়া ছিল দুই রকমের কেক, ডোনাট ও জাপানিজ গিউজা। পিঠাগুলো তৈরি করেন আরেফিন মৌ, পার্সিয়া, আয়েশা মিতু, সাদিয়া, আঁখি, দোলন, ঊর্মি, ফারজানা আঁখি, নীলাঞ্জনা, নিপুণ, সাথি, খোদেজা, ডলি ও লুসি। পিঠা উৎসব উপলক্ষে অসাধারণ সুন্দর কেক দুটি তৈরি করেন সীমা ও চৈতী।
পিঠা উৎসবের শেষে অন্যতম আকর্ষণ ছিল র্যাফল ড্র। র্যাফল ড্রর সময় সবার মধ্যে ছিল চরম উত্তেজনা। পাঁচজন ছোট সোনামণি র্যাফল ড্রর বক্স থেকে পাঁচটি নাম তোলে। র্যাফল ড্রতে পাঁচটি আকর্ষণীয় পুরস্কারের মধ্যে প্রথম পুরস্কার জিতে নেন ইসতিয়াক শুভ।
পিঠা উৎসবে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কাজী ইনসানুল হক, দিদার কচি ও রেজা মীর। এ ছাড়া উৎসবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রবাসী ব্যবসায়ী, লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বাংলাদেশ কমিউনিটির নেতারা।
বর্ণাঢ্য এই পিঠা উৎসবের প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন সুইয়ামা লুবনা। তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা করেন শিলা আলম, সুইটি জাকির, সাবরিনা আজিম, মেহেজাবিন ইরা, দিপা আলম, মুন হায়দার, ফারজানা ইমু, ফারজানা আহমেদ, লুসি আহামেদ, ডলি খান, মারিয়াম সাথি, ঊর্মি কামাল, পার্সিয়াসহ অনেক ভাই ও ভাবি। সাউন্ড সিস্টেম ও মিউজিকের দায়িত্বে ছিলেন এ এম রাহাত। রিসিপশনের দায়িত্ব পালন করেন তুহিন তালুকদার, সেজান ও সৈকত।