জাপানি স্কুলের বিচিত্রানুষ্ঠান দেখার অভিজ্ঞতা
বুনকাসাই (文化祭) ) জাপানিজ শব্দ। বাংলা করলে বিচিত্রানুষ্ঠান বলা যায়। অনুষ্ঠানটি প্রাইমারি ও হাইস্কুলের বিচিত্রানুষ্ঠানের মতোই। তবে কলেবরে বেশ বড়। অভিভাবকদের দাওয়াত থাকে ছেলেমেয়েদের পারফরমেন্স স্বচক্ষে দেখার জন্য। এখানকার স্কুলের এই জাতীয় অনুষ্ঠান মানেই ধরে নেওয়া যায় স্কুলের জিমনেসিয়ামেই হবে। ভুলেও কখনো খোলা মাঠ বা স্থানে করে না। খোলা মাঠে অনুষ্ঠান করা মানেই স্টেজ বানানো। জিমনেসিয়ামে করলে সবকিছু তো আছেই। আশপাশের ডেকোরেশনটা একটু অনুষ্ঠান উপযোগী করলেই হলো। সেদিনও এর ব্যতিক্রম দেখলাম না। হ্যাঁ, আমি আমার ছেলের মাধ্যমিক স্কুলের কালচারাল ফেস্টিভ্যালের কথা বলছি। ওর স্কুলে বুনকাসাই ছিল। ছেলে কয়েক দিন আগে থেকেই বলছে, আব্বু, অনুষ্ঠানটা মিস করো না।
ভেবেছিলাম শনিবার একটা লম্বা ঘুম দিয়ে, চা খেতে খেতে পেপার পড়ব। ফেসবুকের পোস্টগুলো সিরিয়াল ধরে লাইক দেব, সম্ভব হলে মজার মজার কমেন্টস দেব বন্ধুদের পোস্টগুলোতে। সেটা আর হবে না জেনেই অনুষ্ঠান দেখতে রওনা হলাম। আমার ছেলের গান শুনেছি (বাসায় মাঝে মাঝে চিৎকার করে বন্ধুদের সঙ্গে জাপানিজ গান গায়)। ওর গলার সুর আমার মতো না আবার ওর মায়ের কণ্ঠটাও পায়নি। এই বয়সেই কণ্ঠে এক ভরাট ভাব এসেছে। মাঝে মাঝে ওর সুর এদিক সেদিক হলেই মনে পড়ে যায় মেজ ভাইয়ের কথা। আমার মেজ ভাইটা সুর ঠিকমতো দিতে পারত না। হাজার মানুষের মাঝে গান গাইলেই চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারতাম মেজো ভাই কোথায় গাইছে। বড় ভাই ওকে বেসুরো সুরের আইডল খেতাব দিয়েছিলেন।
আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ বেসুরো গলায় গাইলেই মেজ ভাইয়ের উপাধিটা গায়কের নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হতো। তাই ছেলে একটু বেসুরো সুরে গাওয়া মানেই আমি আমার ছোটবেলার স্মৃতিগুলোকে চোখের সামনে দেখতে পাই। আমার গলা ভালো না, তবে সুরে ভুল খুব কম হয়। ওর মায়ের গলা ভালো, সুর ভালো দেয়, তবে গানের কলিগুলোকে ঠিকমতো মনে রাখতে পারে না। গানের মাঝপথে মনের মাধুরী মিশিয়ে স্বরচিত শব্দ ঢুকিয়ে গানের বারোটা বাজায়। আমাদের ছেলে কেমন গান গাইবে সেটার জন্য আর রিসার্চ নাই বা করলাম। তবে ও যখন গান গায় তখন আমরা দুজনেই কান দুটোকে খরগোশের কান বানিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনি। মাঝে মাঝে গলার ভলিউমটা একটু বেড়ে গেলে ওর মা অবশ্য রেগে যায়, আমি কিন্তু উপভোগ করি ওর চিৎকার দিয়ে গান গাওয়াটাকে, কেননা ওটাতেই যে ফিরে পাই আমি আমার শৈশব।
মাথার ভেতরে শৈশব কৈশোরের একরাশ স্মৃতি নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হলাম। আগেই বলেছি অনুষ্ঠান মানেই জিমনেশিয়ামে হবে। প্রাইমারি স্কুলগুলোর জিমনেশিয়ামে ঢোকার অভিজ্ঞতা আছে। এবার জুনিয়র হাইস্কুলেরটাও দেখার সৌভাগ্য হলো। জাপান সরকার আর্কিটেক্টের ভাত মেরে সব জিমনেসিয়ামের কাজ একটা ডিজাইন দিয়েই চালিয়ে নিয়েছে। আমাদের দেশে প্রাইমারি ও হাইস্কুলে জিমনেসিয়ামের বালাই ছিল না। কলেজে যদিও বা ছিল যাওয়া হয়নি কোনো দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে অনেকবার গিয়েছি জিমনেসিয়ামে। তাই এখানকার জুনিয়ার হাইস্কুলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়ামের তুলনা করতে পারব। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়ামে বাস্কেট বলের কোর্ট একটা আর এখানে পাশাপাশি দুটো কোর্ট। কাজেই স্পেসের দিক থেকে দ্বিগুণ। অভিভাবকদের আসনের ব্যবস্থা সবার পেছনে। ছাত্রছাত্রীদের আসন সামনে। অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি ছিল কিনা বলতে পারব না। থাকলেও কোথায় বসেছেন সেটাও জানি না। যা হোক, যন্ত্রসংগীত দিয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান। টম & জেরির জেরিকে হাতের কাঠিটাকে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে নির্দেশনা দিতে দেখেছি, টিভিতে একই ধরনের প্রোগ্রাম দেখেছি তবে লাইভ এই প্রথম দেখলাম। বাদকদের চেয়ে বাদ্যযন্ত্রগুলোর আকৃতি এতই বড় ছিল যে আমার হাই পাওয়ারের চশমাও ডিটেক্ট করতে পারছিল না কোনটি যন্ত্র আর কোনটি বাদক। তবে ওদের পারফরমেন্স সত্যিই উপভোগ্য ছিল। পারফরমেন্সের শেষে হাততালি দিতে ভুললাম না। ঘোষকের অনুরোধে আরও একবার জোরেশোরে দিলাম।
শুধু শিক্ষার্থীরাই পারফর্ম করবে তা কি করে হয়? শিক্ষকেরা বাদ যাবেন কেন? অভিভাবকেরা কী দোষ করল? না কাউকেই হতাশ করেনি স্কুলের কর্তৃপক্ষ। PTA নামে একটা কমিটি থাকে প্রত্যেক স্কুলে। আমাদের দেশের মতো ভোটাভুটি হয় না কমিটিতে ঢোকার জন্য। অন্যান্য অভিভাবকদের অনুরোধে কাজ করে বিশেষ কিছু লোক এই কমিটিতে। ঘোষণা দেওয়া হলো স্পিকারে PTAদের কোরাস হবে এখন। ঘোষণার পর পরেই দেখলাম সুটেড বুটেড অনেক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা হাতে চোথা নিয়ে স্টেজে উঠেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদের হাতে থাকা চোথার মতো ময়লা ধরা না, মডার্ন চোথা ও সবার হাতেই একই ধরনের কভার। বয়সের কারণে মাঝপথে যাতে গানের কলি ভুলে না যান সে জন্যই এই ব্যবস্থা। গান শুরু হতেই পরিষ্কার হলো প্রফেশনাল আর অ্যামেচারের পার্থক্য। যার পর নাই চেষ্টা করলেন ওনারা পিয়ানোর সঙ্গে তাল মেলাতে। বাংলাদেশে হলে তো (আমাদের সময়) নানা ধ্বনি উঠত দর্শক সারি থেকে। এখানে সে রকম কিছু ঘটল না বরং হাততালির শব্দে মুখরিত হলো হলরুমটি।
এর পর শুরু হলো শিক্ষার্থীদের জাপানি ভাষায় বক্তৃতা। প্রত্যেক ক্লাসের একজন করে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করল। ক্লাস সেভেনের এক ছাত্রের পরিবেশনা দেখে রীতিমতো থ বনে গেলাম। টপিকসটা ছিল এ রকম—নৈরাশ্যের সর্বোচ্চ চূড়ায়-আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ছেলেটি তার ছাত্র জীবনের গত সাতটা বছরের নৈরাশ্যের কাহিনি ও সেখান থেকে বের হয়ে আসার বিবরণ দিল। সেটা শুনে চোখের কোণে কিছু একটা অনুভব করলাম। আমার ছেলের চেয়ে এক বছরের ছোট ছেলেটা আমাকে ইমোশনাল বানাল। ক্লাস এইটের এক ছাত্র বক্তব্য রাখল সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকার উপদেশ দিয়ে। নাইনের ছেলেটি তার বাউন্ডুলে লাইফ থেকে সুশৃঙ্খল জীবনে ফিরে আসার ঘটনা উপস্থাপন করল। এর জন্য যাদের অবদান তাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে কৃপণতা দেখাল না। শেখার কোনো বয়স নাই, শিক্ষকের কোনো ডেফিনেশন নাই, কথাগুলো শুনেছিলাম আজ নিজেই শেখার মাধ্যমে প্রমাণ পেলাম।
ইংরেজিতে ঘোষণা দেওয়া হলো যে, পরের প্রোগ্রাম ইংরেজিতে মুখস্থ বক্তৃতা। ঘোষকের ঘোষণায় ও সূচিপত্র থেকে জেনেছিলাম টপিকস ছিল Nature and Human এবং I have a dream। আর কিছুই বুঝতে পারি নাই পরবর্তী সময়টুকুর। আমার কানের সমস্যা নাকি বক্তার উচ্চারণের সমস্যা, এর বিচার কার কাছে চাইব? তবে জাপানে থাকতে থাকতে ইংরেজির চেয়ে জাপানিজ শব্দগুলো খুব সহজেই কানে ঢুকে পরে। বাসায় ফিরে ছেলেও অভিযোগ করল যে সেও কিছু বুঝে নাই। ওর ইংরেজির কান অবশ্য আমার কান থেকে সরস।
শুরু হলো গবেষণা সংক্রান্ত পরিবেশনা। জুনিয়র হাইস্কুলে আবার গবেষণা হয় নাকি? ঘোষণা শুনে আকাশ থেকে পড়লেও পাওয়ার পয়েন্টের চোখধাঁধানো অ্যানিমেশন দেখে স্বাভাবিক হলাম। এদের স্কুলগুলোতে সায়েন্স ক্লাব নামে একটা গ্রুপ থাকে, উপস্থাপনটা ওদেরই ছিল। গবেষণার বিষয় আহামরি কিছুই না, টপিকসটা ছিল এ রকম—বামদিকে ঘুরে কাজ করলে নাকি ডান দিকে ঘুরে কাজ করলে কাজের গতি বাড়ে। বিভিন্ন ধরনের এক্সপেরিমেন্টের ডাটা ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে দেখাচ্ছিল। ২০০ মিটার দৌড়ে ডানে ঘুরলে সময় কম লাগবে নাকি বামে ঘুরলে সময় কম লাগবে এটা দেখার জন্য stuntman হিসেবে নিয়েছিল এক শিক্ষককে। স্যুট প্যান্ট পরে দৌড়ের চিত্র ও দৌড় শেষে হাঁপানোর ক্লোজ আপ দেখে হাসির রোল পড়ে গেল জিমনেসিয়ামে।
প্রোগ্রামগুলোর গ্যাপগুলোতে অভিভাবকেরা মিনি পুনর্মিলনীতে ব্যস্ত ছিল। কেননা ওনাদের অনেকেই তো আবার এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। ব্যস্ত লাইফে এই সমস্ত নস্টালজিক জায়গার স্মৃতিগুলোকে সহপাঠীদের সঙ্গে শেয়ার করার মজাই আলাদা। বাঁধ সাধছিল ঘোষক। বারবার ঘোষণা করছিল 静かにしてください! (সিজুকানি সিতে কুদাসাই quiet please!)।
নিজের বাচ্চাদের পারফরমেন্স শেষ হলেই পেছন থেকে চুপিসারে কেটে পড়ছে কিছু অভিভাবক। আবার সেই আসনগুলো দখল করছে ছেলেমেয়েদের পারফরমেন্স দেখতে আসা অপেক্ষমাণ অভিভাবকেরা। ছেলে বলেছিল তার পারফরমেন্স সকালের দিকে, ওর কথায় বিশ্বাস করে সূচিপত্রটা আর চেক করিনি। আসলে ওর পারফরমেন্স ছিল লাঞ্চের পরে। তাই স্টেজের পারফরমেন্সের চেয়ে আশপাশের লোকজনদের কৃতকর্ম দেখছিলাম। কেউবা ভিডিওটি অন করে, ফোন দিয়ে গেম খেলছে, কোলের বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে আসা মা চেষ্টার ত্রুটি করছেন না বাচ্চাটাকে শান্ত রাখতে। দরজা দিয়ে ঢুকে পড়া শীতের বাতাসে আমার পা দুটো জমাট বেঁধে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে খুঁজে ফিরছি ছেলের বয়সী নিজেকে। আমাদের হাইস্কুলেও হতো বিচিত্রানুষ্ঠান। যদিও এদের মতো এত বড় না। শিল্পীও মোটামুটি ফিক্সড ছিল। শিল্পীর লিস্টে আমার নামটাও থাকত। একই গান কতবার যে গেয়েছিলাম তা বলতে পারব না। তবে অন্যদের গাওয়া গানগুলি এখনো চোখের সামনে ভাসে। সেগুলোর মধ্যে মান্নানের যারে যাবি যদি যা পিঞ্জর খুলে দিয়েছি...গানটি, কল্পনা ও কণা আপার নজরুল সংগীতগুলোও।
অপেক্ষার পালা শেষ হলো যখন শুনলাম আমার ছেলের সেকশনকে ডাকা হলো স্টেজে। বাবা মায়েদের ছবি তোলার প্রস্তুতিতে যে শোরগোল সৃষ্টি হলো তা কোরাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল। ক্যামেরার শার্টারের শব্দ ছিল তবে গানের শব্দের কাছে হার মেনেছিল। জাপানিজ গান খুব কম শোনা হয় তাই পরিবেশিত গানের মাথামুণ্ডু কিছুই বুজছিলাম না। আমার কানে বাজছিল মোদের বাংলাদেশের খেতে সোনা ফলে, কর ভাই কৃষিকাজ সুকৌশলে। ১০-১২ বছরের নিজেকে দেখছিলাম স্টেজে। আব্বার লেখা এই গানটি গাচ্ছি আমি বন্ধুদের সঙ্গে। পায়ে ৫.৫ ম্যাগনিচিউড ভূমিকম্পের কম্পন। সামনের দর্শকদের অনেক নিচুতে দেখছি আমি। আমি স্টেজে নাকি আকাশে ছিলাম তা টের পাইনি। তবে ভয়ে আমার পা যে স্টেজে ছিল না এটা ঠিক। আমার ছেলে যে ভয় পাচ্ছিল না সেটা ওর গলার আওয়াজ শুনেই টের পেয়েছিলাম। মাথা নুয়ে কুর্নিশ করতে দেখে বুঝলাম গান শেষ। নিজের দায়িত্বকে শেষ মনে করলাম। যবনিকা পতন পর্যন্ত আর অপেক্ষা করি নাই। পরে ছেলের মুখে শুনেছিলাম ওদের গ্রুপ নাকি ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিল।