জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও বাংলাদেশ নিউজ প্রসঙ্গ

জাপানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হায়াকাওয়া তাকাশি (মাঝখানে) ১৯৭৩ সালে
জাপানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হায়াকাওয়া তাকাশি (মাঝখানে) ১৯৭৩ সালে

আশি দশকের শেষদিকে আমি যখন বাংলাদেশ সোসাইটি জাপানের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলাম, তখন বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে মিসেস হায়াকাওয়া মোতোয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি একবার নেম কার্ড দিয়ে বলেছিলেন, তার বাসায় যাওয়ার জন্য। বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক নিয়ে ও সদ্যপ্রয়াত তার স্বামী হায়াকাওয়া তাকাশি (১৯১৬-৮২) সম্পর্কে আলাপ করবেন জানিয়েছিলেন। কিন্তু নানা ব্যস্ততার কারণে তার বাসায় আমার আর যাওয়া হয়নি। তিনি এশিয়ান লেডিস ক্লাব, জাপানের সভাপতি ছিলেন। তখনো দু-একবার কোনো-কোনো সমাবেশে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

হায়াকাওয়া তাকাশি জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিংবদন্তিতুল্য এক নাম। রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন শ্রমমন্ত্রী হায়াকাওয়া সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন তা অবিস্মরণীয়। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। হায়াকাওয়ার বিপুল কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নস্বরূপ ঢাকায় অবস্থিত প্যান-প্যাসেফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ের ভেতরে তার একটি স্মারকচিত্র খোদিত আছে। তিনি বাংলাদেশ ও বাঙালিকে এত ভালোবাসতেন যে, দুই দেশের মৈত্রীবন্ধনের প্রতীক হিসেবে তার চিতাভস্ম ঢাকার বাসাবোতে অবস্থিত ধর্মরাজিক বৌদ্ধমন্দিরে সংরক্ষিত হয়েছে। এমন ঘটনা বিরল।
নব্বই দশকের প্রথম দিকে আমি দু-একজন বয়োজ্যেষ্ঠ প্রবাসী বাঙালির মুখে শুনেছিলাম, ডায়েট (সংসদ) সদস্য হায়াকাওয়া নিহোন-বাংলাদেশ কিয়োকাই বা জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। কেইসুকে ইতোও ছিলেন কর্মসচিব। তিনিও ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বড়মাপের ভক্ত। এর বেশি আমার জানা ছিল না এই সংগঠনটি সম্পর্কে।
২০১০ সালে যখন হঠাৎ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আরেকজন বড়মাপের বঙ্গবন্ধুর ভক্তকে খুঁজে পেলাম, তখন ফোন করে যোগাযোগ করলাম। তিনি জাপানের খ্যাতিমান অধ্যাপক, লেখক ও জাপান রেডক্রসের প্রাক্তন প্রধান পরিচালক ফুকিউরা তাদামাসা। তার আরেকটি পরিচয় তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পতাকা বিশেষজ্ঞ। যোগাযোগ করে সাক্ষাতের বাসনা জানালে তিনি যেতে বললেন। টোকিওর তোরানোমোন শহরে তার অফিস।
একদিন দুপুরবেলা হাজির হলাম তার অফিসে। তিনি আমাকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন, বহু বছর পর বাঙালির দেখা পেলাম! সেদিন তিনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে স্বচক্ষেÿদেখার ইতিহাস বললেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জাপান রেডক্রসের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করেছেন। সেই ঘটনা নিয়ে বইও লিখেছেন চি তো দোরো তো বানগুরাদেশু দোকুরিৎসু নো হিগেকি (১৯৭৩) অর্থাৎ রক্ত, কাদা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ট্র্যাজেডি নামে। সেটার একটি কপি আমাকে উপহার দিলেন। আমিও আমার একটি বইয়ের কপি তার হাতে তুলে দিলাম স্মৃতি হিসেবে।

ম্যাগাজিনে বঙ্গবন্ধুর বাণীযুক্ত একটি পৃষ্ঠা
ম্যাগাজিনে বঙ্গবন্ধুর বাণীযুক্ত একটি পৃষ্ঠা

তিনি বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ও অন্যান্য জাপানি ভক্তরা শোকসভা ও প্রতিবাদের আয়োজন করেছেন। জাপান-বাংলাদেশে অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান, কর্মসচিবসহ সকল সদস্য প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে শোকাভিভূত হয়ে। তিনি দুঃখ করে বললেন, হায়াকাওয়া স্যার মারা যাওয়ার পর (১৯৮২) সংগঠনটিও ভেঙে গেল। জানালেন বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের কেউ কোনো দিন খোঁজ নেয়নি আমাদের। এভাবেই সম্পর্কটা ছিঁড়ে গেছে। আরও বললেন, এই হায়াকাওয়া স্যারের উদ্যোগেই ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু জাপান সফরে এসেছিলেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুয়েই তানাকা হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে প্রেরণ করেন বঙ্গবন্ধুকে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। বাকি দুজন হলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, শিক্ষক ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞ তানাকা মাসাআকি ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোদ্ধা রাজকীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এফ কিকান ফোর্সপ্রধান ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি। জাপানি রাজনৈতিক জগতের শিক্ষাগুরু বিরল বঙ্গবন্ধুভক্ত যার শিয়রের কাছেই বঙ্গবন্ধুর ছবি থাকত সেই তানাকা মাসাআকির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। তিনি টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল খ্যাত (১৯৪৬-৪৮) ভারতীয় বিচারপতি রাধা বিনোদ পালের ছিলেন পুত্রতুল্য শিষ্য। উল্লেখ্য, বিচারপতি পাল ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতায় বয়োপ্রাপ্ত হয়েছেন।
এখানে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই তিরজনের সবাই নির্মল জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুও ছিলেন খাঁটি জাতীয়তাবাদী ও নেতাজির আদর্শের শেষ অনুসারী। যেহেতু নেতাজির সঙ্গে জাপানের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল জাপানে নির্বাসিত মহা বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর মাধ্যমে, তাই তাদের সহানুভূতি ছিল বাংলা নামক অঞ্চলটির প্রতি বরাবরই। সেই ১৯০২ সালে কলকাতায় জাপানি মনীষী ওকাকুরা তেনশিন (১৮৬৩-১৯১৩) ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ ও বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকে। কাজেই বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও এর প্রধান নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য জাপানে জাপানিদের সক্রিয় কর্মতৎপরতার পেছনে জাপান সরকার ও রাজবংশের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতা ছিল।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতা বঙ্গবন্ধুকে হানেদা বিমানবন্দরে লাল কার্পেট বিছিয়ে অসামান্য এক সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছিল সরকারিভাবে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হায়াকাওয়া তাকাশি তার জন্মস্থান ওয়াকায়ামা প্রদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন জাহাজে চড়ে। সঙ্গে ছিলেন ফুকিউরা তাদামাসা, বঙ্গবন্ধুর দোভাষী রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা প্রমুখ। এসব কথা আমি ফুকিউরা তাদামাসার মুখেই প্রথম শুনি। তার সাক্ষাৎকারটি ২০১০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এই সব কথা লেখার কারণ অতি সম্প্রতি প্রয়াত অধ্যাপক কাজুও আজুমার বাড়িতে পরিত্যক্ত দলিলপত্রের মধ্যে একটি ম্যাগাজিন বা বুলেটিন খুঁজে পাই জাপানি ভাষায় মুদ্রিত ৩২ পৃষ্ঠাসংবলিত বানগুরাদেশু নিউসু বা বাংলাদেশ নিউজ নামে। প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা এটি। কিন্তু কত সাল মুদ্রিত নেই কোথাও। আওয়ামী লীগ নেতা মনোরঞ্জন ধর ১৯৭২ সালে জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তাই মনে হয় এটা ১৯৭২ সালেরই হবে। তা ছাড়া প্রথম বর্ষ হিসেবে এই সালকেই নির্দেশ করে।
ম্যাগাজিনটির রচনাসম্ভারের শুরু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর একটি সচিত্র বাণী দিয়ে। ইংরেজি বাণীটির জাপানি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে নিচে। প্রথম লেখাটি লিখেছেন তৎকালীন প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি জাপানের সভাপতি এম এস মাসুদ। তিনি নিহোন নি কিতাই সুরু (ইচি) বা জাপানের কাছে প্রত্যাশা (১) শীর্ষক রচনায় জানাচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাপানে যখন জনসমর্থনে কাজ করছিলেন তখন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের চরম দুরবস্থার কথা অনেক জাপানিই জানতেন। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার তার কাছ থেকে ভাড়া না নিয়ে উল্টো আরিগাতোও (ধন্যবাদ) বলে গামুবাত্তে কুদাসাই অর্থাৎ লড়াই করো বলে নিজের সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। তাতে লেখক অবাক হয়েছেন! তাকে অসীম শক্তি জুগিয়ে গেল একজন সাধারণ ট্যাক্সিচালক! অনুরূপ তিনি জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের কাছ থেকেও অন্তর মথিত জোরালো কণ্ঠে লড়াই করো কথাটি যেন বলেন এই প্রত্যাশা করেছেন।

জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র বাংলাদেশ নিউজ
জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র বাংলাদেশ নিউজ

পরের রচনাটি ৬ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ রিপোর্ট বানগুরাদেশু এনজো অ দোও সুরুকা অর্থাৎ বাংলাদেশে সাহায্য কীভাবে সম্ভব এই বিষয়ে একটি বৈঠক। তাতে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশে প্রাক্তন কৃষি প্রযুক্তিকরণ কেন্দ্রের মহাপরিচালক, জাপানের কৃষি ও বন দপ্তরের গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান, কলকাতার জাপানি কনস্যুলেটের প্রধান কর্মকর্তা, জাপানের কানসাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, নিহোন কোওয়েই কোম্পানির সহ কর্ণধার, জাপান রেডক্রসের দুজন চিকিৎসক আর বৈঠক পরিচালনা করেন জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মসচিব। এক নম্বর সভা হিসেবে যমুনা সেতুর বিষয় ছাড়াও বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। রিপোর্টটি অসমাপ্ত ও আগামী সংখ্যায় সমাপ্ত হবে লেখা ছিল।
রিপোর্ট শেষে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সোসাইটি জাপানের সহসভাপতি ই এ চৌধুরী (ইসকান্দার আহমেদ) প্রায় এক মাস বাংলাদেশে থাকার পর জাপানে ফিরে আসেন জুলাই মাসের ২ তারিখে। গত এপ্রিল মাসে ঢাকায় স্থাপিত এশিয়া সংস্কৃতি কেন্দ্র: বাংলাদেশি ছাত্র পুনর্মিলনী সমিতির চেয়ারম্যান ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতামূলক আহ্বান সংবলিত চিঠি জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হায়াকাওয়ার হাতে তুলে দেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের (মুক্তিযুদ্ধে) ক্ষতিগ্রস্ত নারী পুনর্বাসন পরিকল্পনার অনুলিপি প্রদান করেন তাতে জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতা চাওয়া হয়। ইসকান্দার আহমেদ চৌধুরীর ঢাকার জাপানি দূতাবাসে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সেপ্টেম্বর মাসে হানেদা বিমানবন্দর ত্যাগ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
আমার সঙ্গে ইসকান্দার আহমেদ চৌধুরীর পরিচয় হয় ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে। তিনি তখন বাংলাদেশ সোসাইটি জাপানের সঙ্গে জড়িত ও এর কর্মকর্তা। তখন জাপান প্রবাসী এলিট বাঙালি অর্থাৎ যারা উচ্চশিক্ষার্থে জাপানে এসেছেন, বড় বড় প্রতিষ্ঠান চাকরি করছেন কিংবা ব্যবসা করছেন তাদের সংগঠন ছিল এটা। সদ্য আসা প্রবাসী যারা ছিলেন অধিকাংশই ছাত্র নামে অবৈধ শ্রমিক, তাদের সদস্য হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এই নিয়ে কম বাদানুবাদ হয়নি! এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে। সর্বস্তরের প্রবাসীদের সোসাইটির সদস্য করে নেওয়ার দাবিতে কয়েকবার তার সঙ্গে আলোচনা করতে যাই এনএইচকে ভবনে। তখন তিনি এনএইচকে বেতারের বাংলা সম্প্রচার বিভাগে কাজ করতেন। পরে অবশ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সোসাইটি প্রবাসী তরুণদের হাতে চলে আসে। আমি দু-দুবার সোসাইটির সাংস্কৃতিক ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলাম। জাপানি ভাষা শেষ করে আমি তখন চাকরি করছি। এরপর বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে। আমরা একদিন দুপুরবেলা শিবুইয়া শহরে অবস্থিত রয়্যাল বেঙ্গল রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্নভোজ গ্রহণের মধ্য দিয়ে অনেক কথাবার্তা বলি। তার মুখ থেকেই জানতে পারি—তরুণকালে তিনি পাকিস্তানের করাচি শহরে ছিলেন। সেখানে বাংলা ভাষা শিক্ষার স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মূলত ছিলেন বেতার সাংবাদিক সেই সুবাদে লেখালেখিও করতেন। আফগানিস্তান নিয়ে তিনি একটি বইও রচনা করেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। শিক্ষামনস্ক চৌধুরী সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। ঢাকা জাদুঘরকে গুদামঘর বলে উল্লেখ করেছিলেন। আমি একটি পত্রিকা প্রকাশ করার ইচ্ছে নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। তিনি স্বাগত জানিয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছিলেন সেদিন। যথারীতি ১৯৯১ সালের মার্চ মাসে আমি মানচিত্র নামে জাপানে প্রথম বাংলা ভাষায় মুদ্রিত কাগজ প্রকাশ করি সাদাকালো ট্যাবলয়েড আকারে। প্রথম সংখ্যাতেই তার একটি নিবন্ধ প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ করেছিলাম। তিনি পত্রিকা দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। উৎসাহ দিয়েছিলেন।
এরপর নানা ব্যস্ততার কারণে তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। পাটশাকের ইতিবৃত্ত নিয়ে তিনি পরে আরও একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন মানচিত্রে। মানচিত্রের একটি সংখ্যার জন্য তার কাছ থেকে কয়েকটি আলোকচিত্র ধার করেছিলাম, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাপানে গৃহীত। তিনিও জড়িত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেÿজাপানি জনমত গঠন ও তহবিল সংগ্রহে। সেই সময়কার অনেকগুলো ছবি তার অ্যালবামে ছিল। জানি না সেই সব দুর্লভ ছবিগুলো হারিয়ে গেছে কি না।
সোসাইটি তরুণ প্রবাসীদের হস্তগত হলে পরে তিনি আর সোসাইটিতে আসেননি। সোসাইটির প্রাক্তন এলিটরা সিটিজেন ফোরাম জাপান নামে আলাদা একটি সংগঠন গঠন করলে তাতেও তিনি ছিলেন না বলেই মনে হয়। বয়সও হয়েছিল তার। ১৯৩৩ সালে চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া ইসকান্দার চৌধুরী ১৯৬৫ সালে জাপানে আগমন করেছিলেন, জাপানি ভাষা শিখেছিলেন। জাপানিদের বাংলা শিক্ষাদানেও তার অবদান রয়েছে। তার স্ত্রী ছিলেন জাপানি নাগরিক। তার দুই ছেলে ছিল বলে জানতাম। বার্ধক্যজনিত কারণে শেষ বয়সে তিনি একাই স্বদেশে ফিরে গিয়েছিলেন। গ্রামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার জাপানি বন্ধুরা সেই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছেন। তিনি জাপানি ভাষাও শিক্ষা দিতেন সেই বিদ্যালয়ে। ২০০৪ সালে তার আকস্মিক মৃত্যু হয়।
যা হোক, ম্যাগাজিনের পরবর্তী বিষয় বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট নিয়ে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের জুন মাস ও ১৯৭২ সালের জুলাই মাস থেকে ১৯৭৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত দুটি বাজেটের সংক্ষিপ্ত কাঠামো তুলে ধরা হয়েছে চার পৃষ্ঠাব্যাপী।
এ ছাড়া জাপানিদের বাংলা ভাষা শেখার একটি সংলাপভিত্তিক কলামও রয়েছে ম্যাগাজিনে।
এরপর রয়েছে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য, যোগাযোগ, শিল্প ও তার-টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কী কী দপ্তর রয়েছে তার একটি ইংরেজি ও জাপানি তালিকা। সম্ভবত জাপানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনে জাপানি বিনিয়োগকারীদের অবগতির জন্য জরুরি তথ্য হিসেবে এটা প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে হয়। পরবর্তী দুই পৃষ্ঠাব্যাপী প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্যভিত্তিক বিধিবিধান। এখানেই উপসংবাদ হিসেবে রয়েছে রাষ্ট্রদূত মনোরঞ্জন ধর কর্তৃক ১৯৭২ সালের জুলাই মাসের ২৬ তারিখে টোকিওর সুগিনামি-ওয়ার্ডে অবস্থিত বিখ্যাত রেনকোওজি বৌদ্ধমন্দিরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে শ্রদ্ধা নিবেদন করার তাৎক্ষণিক লিখিত মন্তব্য। উল্লেখ্য যে, এই মন্দিরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তাইওয়ানে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর নেতাজির পবিত্র চিতাভস্ম এনে রাখা হয়। আজও তা সংরক্ষিত হচ্ছে। যদিও বা এই বিষয়ে বিতর্ক বিদ্যমান।
পরবর্তী বিষয় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস ও অর্থনীতি। এতে জানা যায় বাংলাদেশে ১৯৫০ সালেই প্রাকৃতিক গ্যাস খনন শুরু হয়। ১৮৫৫ সালে সিলেটের হরিপুরে প্রথম গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯৬০ সালে সিলেটরই ফেঞ্চুগঞ্জে। এভাবে পরে কুমিল্লার রশিদপুর, কৈলাসটিলা, তিতাস; আবার সিলেটের হবিগঞ্জ, ছাতক; কুমিল্লার বাখরাবাদে গ্যাস ও তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। সেই প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিমাণ নিয়ে একটি তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদন শেষ হয়নি চলবে বলে লিখিত আছে। (বাকি অংশ কাল দেখুন)

(প্রবীর বিকাশ সরকার: জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক)