জর্জ-মোবারকের ভঙ্গুর বিকেলের মেরামত

যুক্তরাষ্ট্রের আফগান দখল করে নেওয়ার দিনটি মনে পড়ে মোবারকের। যৌবনে মিসরে বাম আন্দোলন করেছেন। স্বপ্ন দেখতেন, প্রাচ্যে একদিন সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। বস্তুবাদী ধারণা সঞ্চারিত হবে সর্বত্র।

‘দ্য প্রফেট অ্যান্ড দ্য প্রলেতারিয়েত’ বইটি ৯০-এর দশকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল মুসলিম বিশ্বে। মিসরে থাকার সময় মোবারক ছাত্রাবস্থায় বইটি বিলি করতেন কমরেডদের মধ্যে।

বামপন্থী ব্রিটিশ লেখক ক্রিস হারম্যানকে স্মরণ করেন মোবারক। বইটি শাহানাকে দেওয়ার জন্য হাতে নিয়েছেন। নিউজার্সির লোরেল গ্রোভ কবরস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন জর্জ ও মোবারক। প্রায় ২০০ একর এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এ কবরস্থান। বহু জাতিগোষ্ঠীর এই সমাজে বৈষম্য আর বিদ্বেষ নিয়ে লড়াই চলছে ক্রমাগত। যখনই কোনো বিদ্বেষ বা বৈষম্যের অভিযোগ প্রকাশ্য হয়, সমাজ লজ্জিত হয়। এ লজ্জা নিয়ে মার্কিন সমাজ বিব্রত হয়, নিজেদের শোধরানোর প্রয়াস নেয়। এমনটাই মোবারক দেখছেন গত চার দশক থেকে।

সারি সারি কবরের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। এসব কবরে শায়িত লোকজন আমেরিকান যোদ্ধা। জর্জ অনেকটা প্রার্থনার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে নিয়ে আসা গোলাপের তোড়া ভিয়েতনামে যুদ্ধ করা এক সহযোদ্ধার কবরের ওপর রাখলেন জর্জ।

জর্জ প্রায়ই বন্ধু মোবারককে সঙ্গে নিয়ে কবরস্থানে যাতায়াত করেন। সাবেক যোদ্ধাদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সামরিক কায়দায় স্যালুট জানান মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক সৈনিক জর্জ। লোরেল গ্রোভ কবরস্থানে এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটল। পতাকা শোভিত এক কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন জর্জ। কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। স্যালুট না দিয়ে জর্জ উচ্চারণ করছিলেন, আই অ্যাম সরি! উই আর সরি!

পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। মোবারকও বিষয়টি লক্ষ্য করলেন। কিছু না বলে জর্জের পিঠে হাত রাখেন।

—একজন আমেরিকান হিসেবে আমি গর্বিত, যেখানে অন্তত আমি জানি আমি মুক্ত, আমি স্বাধীন। যাদের ত্যাগের কারণে আমরা এ অধিকার ভোগ করছি, তাঁদের আমরা ভুলব না। কথাগুলো বলে দেশের জন্য একাধিক যুদ্ধ করা জর্জ স্যালুট করার জন্য কপালে হাত রাখেন।

আমরা তাঁকে অনুসরণ করি। এমন ভাবগম্ভীর অবস্থার মধ্যেই পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন শাহানা। লাল শাড়ির ওপর কালো ওড়নায় দারুণ দেখাচ্ছে। নিস্তব্ধ কবরস্থানে গ্রীষ্ম বিকেলের রোদের ঝিলিক পড়ছে শাহানার মুখে। মোবারক দ্রুত শাহানার দিকে মনোযোগী হলেন। কোনো কথা না বলেই হাতে রাখা বইটি শাহানার হাতে তুলে দেন মোবারক।

—স্যু, আপনার জন্য বইটি। মধ্যপ্রাচ্যের প্রগতিশীল আন্দোলন জানার জন্য বইটি আপনার পড়া দরকার।

মৃদু উচ্চারণে শাহানা ধন্যবাদ জানালেন। সারি সারি পতাকা শোভিত কবরের দিকে অপলক চেয়ে আছেন জর্জ। কারও মুখে কোনো কথা নেই।

আফগানিস্তানে মার্কিন সমর্থক সরকারের পতন ঘটেছে। আবার তালেবানদের দখলে দেশটি। গত দুই দশকের আড্ডায় আফগানিস্তান বারবার এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান দখলের দিনটির কথা মনে পড়ে।

মোবারক বিদ্রূপ করছিলেন। ক্ষেপে গিয়েছিলেন জর্জ। মোবারক বলছিলেন, সমাজতন্ত্র হজম করাতে চেয়েছে রাশিয়া, এখন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র হজম করাবে? যে জাতি নিজেদের অবস্থানকে আঁকড়ে থাকতে চায়, তাদের যুক্তরাষ্ট্র বদলে দিতে যাবে কেন? কেন জোর করে অন্যদের বদলে দেওয়ার মোড়ল সাজবে যুক্তরাষ্ট্র?

মোবারকের এসব প্রশ্নের জবাবে জর্জ সে সময় বলেছিলেন, বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্যই নিজেদের ভাবাদর্শ ছড়িয়ে দিতে হবে।

জর্জ বুশ তখন ক্ষমতায়। আফগানিস্তান দখলের কয়েক মাস পর সান্ধ্য আড্ডায় জর্জ তাঁর এক সেনা বন্ধুর কাছ থেকে শোনা কৌতুকটি আমাদের শুনিয়েছিলেন।

আফগানিস্তান দখল করার পর যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের দেশের মতো সবকিছু চালু করতে চেয়েছে সে দেশটিতে। মাদ্রাসার বদলে স্কুল খোলা হচ্ছিল। নারী ও শিশুদের জন্য মক্তব নয়, পশ্চিমা ধারার স্কুল স্থাপন করা হয়। নাগরিক জীবনেও পশ্চিমা নানা ব্যবস্থা চালু করা হয়।

নিউইয়র্কের মতো কাবুলেও চালু করা হলো সুইসাইড হট লাইন। কেউ সুইসাইড করার মনোবিকারে পড়লে এ ফোন নম্বরে কল করা যায়। সেখানে সার্বক্ষণিক মনোচিকিৎসক কর্তব্যরত থাকেন। লোকজনকে আত্মহত্যা থেকে নিবৃত্ত করার জন্যই এ হটলাইন। কাবুলে সুইসাইড হটলাইনে কল করেছে একজন আফগান। অপর পাশ থেকে আরেকজন আফগান জিজ্ঞেস করছে, তুমি কি ট্রাক চালাতে পারো?

আত্মঘাতী ট্রাক বোমার জন্য চালক খুঁজছিল হটলাইনে ঘাপটি মেরে থাকা তালেবান!

আফগানিস্তানের ফোন কল নিয়ে মোবারক পাল্টা কৌতুক শুনিয়েছিলেন তখন। আফগান দখলের পর আত্মঘাতী ট্রাক বোমা হামলায় মারা পড়েছে বহুজাতিক বাহিনীর দুই সেনা সদস্য এবং আত্মাহুতি দেওয়া আফগান ট্রাকচালক।

মৃত্যুর পর নরকবাস কেন হলো এ নিয়ে জিজ্ঞাসা তাঁদের। তিনজনের উদ্দেশ্যই মহৎ ছিল। আমেরিকান সৈনিকটি দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে শত জঞ্জালের দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গেছেন। ফরাসি সৈন্যটি যুদ্ধে গেছেন মধ্যযুগীয় বাস্তবতা থেকে একটি ভূখণ্ডের মানুষকে আধুনিকতার আলো দেখাতে। আফগান লোকটি মারা গেছেন নিজের দেশকে, সমাজকে নিজেদের মতো রাখার মহান ব্রত নিয়ে।

তিনজনই মনে করছেন, কোথাও কোনো মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। এ নিয়ে নরক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলা দরকার। তিনজনই তিন মিনিট করে ফোনে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন নরক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। ফোনালাপ শেষে আমেরিকান সৈনিকটির জন্য তিন মিনিটে ২০ ডলারের বিল। ফরাসি সৈনিকটির বেলায় একই সময়ের জন্য ২০ ইউরো। আফগান লোকটি তিন মিনিট নয়, পুরো দশ মিনিট কথা বলে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছে কোথাও ভুলচুক হয়েছে কিনা। তাঁর কাছে কোনো ফোন বিল চাওয়া হলো না। টেলিফোন বিল নিয়েও এমন জাতিভেদ। নতুন লড়াই বাধার উপক্রম।

শেষ পর্যন্ত জানা গেল, আমেরিকান বা ফরাসি লোকজনের জন্য ফোন কলটি ছিল লং ডিস্টেন্সের। আফগান লোকটির জন্য নরক কর্তৃপক্ষের কাছে করা ফোন কল লোকাল। লোকাল কল সবসমই ফ্রি! ২০০১ সালে জর্জ ও মোবারককে নিয়ে আড্ডার সেই সন্ধ্যার কথা মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। তার আগে মোবারকই স্মরণ করিয়ে দিলেন।

—মনে নেই ইব্বি, সেদিন আমি বলেছিলাম ‘Afganistan is the graveyard of empires ’। আজ এই লোরেল গ্রোভ কবরস্থানে দাঁড়িয়ে আবারও বলতে চাই, আফগানিস্তান সাম্রাজ্যের কবরস্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারি শুরু হওয়ার পর তখনকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের দেওয়া বক্তৃতার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার মোক্ষম সময়টি হাতছাড়া করতে ইচ্ছে করল না।

স্টেট অব ইউনিয়ন বক্তৃতায় দাঁড়িয়ে ২০০৪ সালের ২০ জানুয়ারি জর্জ বুশ বলেছিলেন, আফগানিস্তানের নারী-পুরুষেরা জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করে একটি স্বাধীন এবং গর্বের জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্র বন্ধু হিসেবে তাদের পাশে থাকায় নিজেদের সম্মানিত মনে করছে বলে জর্জ বুশ বলেছিলেন।

কবরস্থান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ ধরে সবাই হাঁটছিলেন। ফটকের বাইরেই পানশালায় সন্ধ্যাটি কাটানোর সিদ্ধান্ত। জর্জকে কোনো অবস্থায়ই মুডে পাওয়া যাচ্ছে না। নিজেই পরিস্থিতি থেকে যেন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেন।

—স্যু, আপনাকে শাড়িতে চমৎকার দেখাচ্ছে।

বাঙালি নারীদের শাড়িতেই সবচেয়ে সুন্দর লাগে। সায় দিলাম।

—তোমার তো তা লাগবেই ইব্বি!

মোবারক আলাপকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এমন টের পেয়ে জর্জ থামানোর চেষ্টা করেন।

—শাড়ি পরার সুবিধা অসুবিধা নিয়ে মোবারকের জানা বিষয়গুলো আমরা পান করতে করতে জেনে নেব। স্যু, এবারে আপনি কিছু বলেন।

—তাই হোক!

শাহানা হাসতে শুরু করে দিয়েছেন। কৌতুক বলে নেওয়ার আগে একবার খিলখিল করে হেসে নেওয়া শাহানার অভ্যাস। হাসিতে শাহানার গালে পড়া টোলের দিকে অপলক চেয়ে থাকেন মোবারক।

শাহানা বলতে শুরু করেন। ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আফ্রিকার কোনো এক দেশে গেছেন। সেখানকার প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্পের সম্মানে দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে ফুটবল (সকার) খেলার আয়োজন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে খেলাটি মোটেই জনপ্রিয় নয়। বহু আমেরিকানদের কাছে সকার তেমন পরিচিতও নয়। খেলা দেখতে দেখতে আফ্রিকান প্রধানমন্ত্রী তাঁর দেশের দারিদ্র্যের কথা জানাচ্ছিলেন। ট্রাম্পের একান্ত সাহায্যও কামনা করছিলেন। খোশ মেজাজে থাকা ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিলেন, ওয়াশিংটনে ফিরেই তিনি এ নিয়ে কিছু একটা করবেন।

এক সপ্তাহের মধ্যেই জাহাজ বোঝাই করা সাহায্য নিয়ে মার্কিন জাহাজ আফ্রিকান বন্দরে ভিড়েছে। বেজায় খুশি আফ্রিকান নেতা। মালামাল বোঝাই জাহাজের চালান দেখে আফ্রিকান প্রধানমন্ত্রীর আক্কেলগুড়ুম। কয়েক মিলিয়ন সকার বল। প্রথম চালানেই লক্ষাধিক উৎকৃষ্ট মানের ‘মেড ইন আমেরিকা’ অ্যাডিডাস কোম্পানির বল।

হতভম্ব প্রধানমন্ত্রী ফোন করলেন ট্রাম্পকে।

—মি. প্রেসিডেন্ট, এত ফুটবল দিয়ে আমি কী করব?

—মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমি আপনার সমস্যা হৃদয় দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। খেলার মাঠে দেখেছি মাত্র একটা বল নিয়ে ২২ জন লোক কাড়াকাড়ি করছে। আপনার দেশের সব লোকজন যাতে একটা করে বল পায়, এমন ব্যবস্থা আমি নিয়েছি।

ট্রাম্পকে নিয়ে বলা কৌতুকে জর্জ মৃদু হাসেন। অন্য দিনের মতো তাঁকে গড়িয়ে পড়তে দেখা যায় না। মোবারক শাহানার পিঠ চাপড়ে অভিবাদন জানাচ্ছেন।

সূর্য ততক্ষণে পশ্চিমের সীমারেখা অতিক্রম করেছে। চারটি হরিণের দল সড়কের উল্টো পাশ থেকে কবরস্থানের দিকে যাচ্ছে। জর্জ বলে ওঠেন, গ্রীষ্মের এমন কোনো কোনো বিকেল বেশ জটিল হয়ে ওঠে। ভঙ্গুর লাগে! চলেন বন্ধুরা এমন ভঙ্গুর বিকেলকে আমরা মেরামতের উদ্যোগ নেই।