জবাবদিহি না থাকলে যা হয়
প্রতি ডোজ করোনার টিকার ক্রয়মূল্য
নেপাল ৩৬২ টাকা
ভারত ৪২৯ টাকা
মালদ্বীপ ৪৪৭ টাকা
মিয়ানমার ৭৭৪ টাকা
শ্রীলঙ্কা ১ হাজার ৪০৯ টাকা
বাংলাদেশ ১ হাজার ৫৮৯ টাকা।
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত করোনার টিকা কেনায় ব্যয় করেছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
অন্যান্য ব্যয়সহ করোনার টিকা কার্যক্রমে ব্যয় করেছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সূত্র: প্রথম আলো, ১১ এপ্রিল ২০২২
প্রতিদিন এ ধরনের শত শত খবর আমরা পড়ি, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া নেই আমাদের মধ্যে। আমরা ধর্মগ্রন্থ পড়ি, বিজ্ঞান পড়ি, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কারণ ইংরেজি ভাষায় পড়া শব্দের দুটো অর্থ আছে, to study or to read। শুধু পড়লেই হবে না, যদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না বুঝি কী বর্ণনা করা হয়েছে এবং কেন, তাহলে কী হবে? ওপরের প্রতি ডোজ করোনার টিকা কিনতে কোন দেশে কত টাকা খরচ হয়েছে শুধু জানব, কিন্তু কোনো ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া দেখাব না। সময়ের সঙ্গে যে ঝড় বয়ে চলেছে, সেগুলোর মূল্যায়ন যদি সঠিকভাবে না করা হয় বা মোকাবিলা না করে অতি সামান্য জিনিসগুলোর দিকে জনগণের নজর কেড়ে নেওয়া হয়, সেটা খুবই অন্যায়।
এই অন্যায়গুলো আমরা সবাই করে চলেছি জানা ও অজানার মধ্য দিয়ে। যেমন দেখা গেল, সারা দেশে একটানা প্রায় ৫০ ঘণ্টা বৃষ্টির কারণে কৃষকদের চরম ক্ষতি হলো। সেটা নিয়ে মিডিয়া, রাষ্ট্র বা সাধারণ মানুষের কোনো মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েনি অথচ একজন প্রতিমন্ত্রীর অশ্লীল আচরণ বা বেগুন থেকে বেগুনি না কুমড়া থেকে বেগুনি খেতে হবে, সেটা নিয়ে সারা দেশের মানুষের নজর কেড়ে নিয়েছে!
কিন্তু কেন এই নীরবতা! জবাবদিহি না থাকার কারণেই কি সবাই হার মেনে নিয়তির ওপর সবকিছু ন্যস্ত করেছে? নাকি পরাধীনতার গ্লানি সহ্য করতে না পেরে অন্ধকারে সবাই ডুবে গেছে? হার মেনে নেওয়ার নাম জীবন নয়, লড়াই করে বেঁচে থাকার নাম জীবন। ধাক্কা খেয়ে পড়ে থাকলে চলবে না, উঠে দাঁড়াতে হবে। প্রতিবাদ করতে হবে, নতুন ধাক্কা বা বাধা আসবে, তারও মোকাবিলা করতে হবে, শেষ পর্যন্ত বিজয়ের ধ্বনি শোনা যাবে ধ্যানে, মনে, প্রাণে, আকাশে, বাতাসে।
দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে কৃষির উন্নয়ন, নাকি মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, বিরোধী দল বা উপমন্ত্রীর ভেলকিবাজির উন্নয়ন জরুরি? এদিকে বর্তমানে শিক্ষার ক্রান্তিলগ্নে মেধাকে বিসর্জন দিয়ে লটারির মাধ্যমে রাষ্ট্র নতুন শিক্ষাপদ্ধতি উন্মোচন করল। এইচএসসির পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হলো আবার ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হলো বিধায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী শুরুতেই ঝরে গেল। যেমন অনেকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও সেটা থেকে বঞ্চিত হলো। মিডিয়া, টক শো বা জ্ঞানী-গুণীর মুখে এর ওপর কোনো কথা নেই, অথচ দেখা গেল কে, কোথায়, কবে বিয়ে করেছে, সেটা নিয়ে দেশকে মাতিয়ে রেখেছে দেশের সব মিডিয়া!
মনে হচ্ছে বাধাগ্রস্ত বা সমস্যাজড়িত ইস্যু নিয়ে কেউ কথা বলতে বা লিখতে চায় না। তাই সহজ বা যা ক্ষণিকের তরে বিনোদনমূলক, সে ঘটনারই প্রচার চলছে। যদি শুধু ফালতু জিনিসের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তবে দেশ তো রসাতলে যাবে। সে বিষয় কি ভাবার সময় আমাদের হবে না? শুধু ইয়ার্কি আর ফাজলামি দিয়ে কি দেশ চলবে?
আমি এখন দুর্নীতিমুক্ত ও সুশিক্ষাযুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই, আমার মতো করে অনেকেই দেখতে চায়। আমি হুবহু নতুন প্রশিক্ষণ কারিকুলাম দেখেছি। এই কারিকুলামের অনেক নতুন দিক রয়েছে। নতুন শতকে পা দিয়ে নতুন কারিকুলাম চালুর বিষয়টি নিঃসন্দেহে ভালো।
প্রশিক্ষণ একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং সময়ে সময়ে এর মধ্যে সংযোজন, বিয়োজন তথা পরিমার্জন হওয়ারই কথা। শিক্ষাক্রমের সঙ্গে শিখন-শেখানোর সামগ্রীও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন কারিকুলামের বড় বৈশিষ্ট্য হলো শিক্ষার্থীরা বাড়িতে সময় পাবে এবং খেলাধুলা করবে। তাদের ওপর বইয়ের চাপ ও পরীক্ষার চাপ কমবে। সপ্তাহে তারা দুদিন ছুটি পাবে। কোনো বাড়ির কাজ দেওয়া হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার প্রশ্ন, যাঁরা এ কাজগুলো করতে সাহায্য করবেন, তাঁরা কি শতভাগ সংকল্পবদ্ধ এ কাজগুলো করতে? আছে কি বা দেওয়া হচ্ছে বা হয়েছে কি সে ধরনের প্রশিক্ষণ তাঁদের? তা যদি না দেওয়া হয়ে থাকে, কীভাবে সম্ভব হবে পুরো প্রশিক্ষণকে বাস্তবায়ন করা? পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে কী যাচাই করা হবে যে নতুন শিক্ষাপদ্ধতি সুশিক্ষার রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে? যদি সেটা পরিকল্পনায় থেকে থাকে, তবে সেটা হবে ভুল, কারণ যাদের সামর্থ্য আছে, তারাই হয়তো ভালো করবে পরীক্ষার ফলাফলে, কারণ তারা দুই দিন ছুটি থাকায় ঘরে বসে প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পাবে, কিন্তু অভাগা গরিব পরিবারের সন্তানদের কী হবে?
বিশ্বে স্যাটেলাইট রয়েছে, আমাদেরও থাকতে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি হাসপাতালে কিনে ভর্তি করা হয়েছে অথচ সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। স্যাটেলাইট আকাশে উড়ছে, তার সঠিক ব্যবহার নেই। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের হোম পেজ খুললে মনে হবে, বাহ, চমৎকার! দেশে কোনো কিছুরই অভাব নেই। অথচ সহজ বাংলা ভাষায় বলতে হয়, ‘ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’। যে দেশে গানের সুরে বলা হয় ‘মাকালের ফল দেখিতে ভালো, ওপরে লাল তার ভেতরে কালো’, সে দেশের প্রতিটি স্তরের একই অবস্থা।
এখন কাজ একটাই, সেটা হলো মাকাল ফলকে দূর করতে হবে। কে করবে সেই কাজ, সেটাই এখন রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন? কিছুদিন আগে সারা দেশের সরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় ২০২২ শিক্ষাবর্ষে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তিতে ডিজিটাল লটারি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ লটারির ফল প্রকাশ করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। যে সুযোগ ও দায়িত্ব তিনি পেয়েছেন শিক্ষায় পরিবর্তন আনতে, তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যোগ্য ব্যক্তি যোগ্য জায়গায়। তা সত্ত্বেও শিক্ষার পরিকাঠামোর সুচিন্তিত ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে দেশের শিক্ষাপদ্ধতি অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে। কী কারণ রয়েছে শিক্ষার এই চরম অবনতির জন্য?
সমস্যা যদি না জানি, সমাধান করা সম্ভব কি? জানা সমস্যার সমাধান না করে যদি নতুন সমস্যার সৃষ্টি করা হয় এবং সত্যিকারে মূল কারণ কী, তা যদি এড়িয়ে চলা হয়, তাহলে হবে কি আদৌ সমস্যার সমাধান করা? সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কি এক রকম? না হওয়ার কারণ কী?
দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার যদি একটি বড় সমস্যা হয়ে থাকে, তবে এর সমাধান না করে লটারির মাধ্যমে ভর্তি করা কি যুক্তিসংগত? শুধু ক্ষেত্রবিশেষে এ পদ্ধতি চালু করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? কী অবস্থা তাহলে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যুগ যুগ ধরে ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি চালু রেখেছে, যেমন ক্যাডেট কলেজ, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলসহ শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান? কী গ্যারান্টি আছে যে সেখানে দুর্নীতি হয় না? সর্বোপরি আমার শেষ প্রশ্ন, ‘গোটা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কেন একই ধরনের সুযোগ-সুবিধার অন্তর্ভুক্ত নয়?’
আমি দূর পরবাসে বসবাস করলেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে লতার মতো জড়িয়ে রেখেছি। জড়িয়ে রাখার কারণ একটিই, আর সেটা হলো মেধা বিক্রি করে আমাদের চলতে হবে।
বাংলাদেশ জনবহুল দেশ, মেধাই হবে আমাদের সম্বল এবং সেটা হতে হবে ওয়ার্ল্ড ক্লাস। কিন্তু দেশের শিক্ষাপদ্ধতির যে দিক নির্দেশনার আভাস পাচ্ছি, তাতে ভয় হচ্ছে ভেবে, যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি লটারির মাধ্যমে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুধু লটারিপদ্ধতির কারণে প্রথম সারির শিক্ষার্থীরা ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ হারাবে। যদিও সরকার বলছে, এ পদ্ধতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মেধার সমতা ফেরাবে। দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার এটাই মনে হচ্ছে বর্তমান রাষ্ট্রের শেষ প্রচেষ্টা, সেটা হলো লটারির মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন।
ডিজিটাল পদ্ধতি চালু থাকা সত্ত্বেও যে দেশে জনগণ ভোট দিতে পারেন না, সে দেশেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার উন্নতি হবে বা দেশে সুশিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হবে, ভাবতেই গা শিউরে উঠছে!
লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন। [email protected]