জগৎ আসলে মায়ার খেলা

হাসান ভাই, আরে ও হাসান ভাই। করেন কী? মোটরওয়েতে গাড়ির মধ্যে বসে ঘুমান? আপনাকে দিয়েই হবে।
চোখ খুলে পাশের সিটের দিকে তাকিয়ে দেখি হিমু ভাই বসে আছে। মোটরওয়েতে অফিস ফেরার পথে এমনিতেই গাড়ির অনেক চাপ থাকে তার ওপর আজ আবার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে তাই গাড়ি সত্যিকার অর্থেই একেবারে থেমে থেমে এগোচ্ছে। ক্লান্তিতে তাই মাঝেমধ্যেই দুই চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছিল।
আমি বললাম, এই অসময়ে আপনি কোথা থেকে?
: আপনার অফিসের ঠিকানা আর গাড়ির নম্বরতো আমার জানা তাই। পার্কিংয়ে গিয়ে আপনার গাড়ির মধ্যে শুয়ে পড়েছিলাম। তারপর থেকেই আমি পেছনের সিটে শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছি। তবে ঘুমিয়ে আরাম নাই। কারণ আপনার ছেলে রায়ানের সেফটি সিটটার কারণে সটান শুয়ে পড়তে পারি না। তাই বসার ভঙ্গিতেই শুয়ে ছিলাম।
: আপনাকে দেখলাম না কেন তাহলে?
: কবে আপনি গাড়িতে ওঠার সময় পেছনের সিটের দিকে তাকান যে আমাকে দেখবেন?
: তা ঠিক। আর আজতো এমনিতেই দৌড়ের ওপর আছি, তাই আরও দেখার সময় পাইনি।
: কী এত কাজ করলেন আজ যে এত তাড়াহুড়োর মধ্যে আছেন?
: কী করিনি সেটা বলেন? সিডনি আসার পর এই প্রথম একটা অজি দিন পালন করলাম। বাই দ্য ওয়ে আপনি জানেন তো অজিদের লাইফস্টাইল?
: জানব না কেন পাঁচ দিন গাধার জীবন আর দুই দিন বানরের জীবন।
: একদম ঠিক বলেছেন হিমু ভাই। এরা ঠিক পাঁচ দিন গাধার মতো খাটে আর বাকি ছুটির দুই দিন বানরের মতো নর্তন কুর্দন করে আনন্দ করে।
: আমি যত দূর জানতাম আপনি এই লাইফস্টাইল পছন্দ করেন না। আপনি এতে অভ্যস্তও হতে চান না। কারণ এগুলো আপনার কাছে যান্ত্রিক মনে হয়। তাহলে হঠাৎ কী হলো যে আজ আপনি অজি হয়ে গেলেন?
: গিন্নি একটা কাজ পেয়েছে। আমাদের বাসা থেকে সেই হাসপাতালের দূরত্ব দুই ঘণ্টার ড্রাইভ। সে আবার লং রুটে ড্রাইভ করতে ভয় পায়। তাই ভোরে ঘুম থেকে উঠে দুজন মিলে বাচ্চাদের রেডি করে তাহিয়াকে আশফাক ভাইয়ের বাসায় আর রায়ানকে ওর ফ্যামিলি ডে কেয়ারে দিয়ে এসেছি। তাহিয়া আশফাক ভাবির সঙ্গে ওনার দুই ছেলেমেয়ে আলিশা ও দৃপ্তর সঙ্গে স্কুলে যাবে। আর রায়ান সারাদিন ডে কেয়ারে থাকবে। এরপর ড্রাইভ করে গেছি হাসপাতালে। সেখান থেকে এসেছি অফিসে। অফিসে আসার পথে রাস্তার মধ্যে বেশ কয়েকবার চোখের পাতা বুজে এসেছিল। কিন্তু অফিসে আসতেই হবে, কারণ আমাদের হাতে এখন কোনো কাজ নেই তেমন, তাই বস বলেছিল হাফ ডে হলেও অফিস করো।
: বুঝছি, এত দিনে আপনি সাইজ হইছেন?
: সব দোষ আপনার বাবার। নিজের ছেলেকে হিমালয় বানান না হিমু বানান তাতে কী, কিন্তু উনি আবার ওনার বাণীগুলোও লিপিবদ্ধ করে গেছেন। আর আপনিতো জানেন আমার জীবনে ওনার কতখানি প্রভাব।
: বুঝেছি। আপনি সব সময় নিয়ম ভাঙার অছিলা খোঁজেন তো, তাই ওনার বাণীগুলো একটা ভালো অজুহাত হিসেবে কাজ করেছে আপনার ক্ষেত্রে।
: আপনি তো জানেন বহু মানুষ ব্যাচেলর জীবনে হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় ঘুরেছে। কিন্তু যখনই তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে তখনই তারা বউয়ের শাড়ির আঁচলের তলে আশ্রয় নিয়েছে। অবশ্য আমি অত গোঁড়া ভাবধারার না হলেও আপনার কাজকর্ম আমার ভালো লাগত। লোক দেখানো হিমু আমি সাজি নাই, কিন্তু আমার কাজকর্মগুলোর মধ্যে আপনি আপনার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাবেন। এমনকি ঘড়ির কাটা ধরে চলা এই সিডনি শহরও আমাকে লাইনে আনতে পারেনি। তবে আজ আমি বাস্তবতার কাছে সত্যিই পরাজিত হয়ে গেছি।
: আসলে সভ্যতার তার সঙ্গে যান্ত্রিকতার সম্পর্ক সমানুপাতিক। আপনি যত বেশি সভ্য হবেন তত বেশি যান্ত্রিক হবেন। এটাই এখানকার নিয়ম। ভাবেন একবার যান্ত্রিকতার চাপে পিষ্ট হয়ে মানুষ তার আত্মীয়স্বজন-বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। তাই তাদেরকে ফেসবুকে নতুন নতুন বন্ধু খুঁজতে হয়।
: ওমা, আপনি ফেসবুকের কথাও জানেন?
: জানব না কেন? ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট সবগুলোর কথায় আমার এক ভক্ত আমাকে জানিয়েছিল আর বলেছিল আপনার একটা ফেসবুক আইডি খুলে দিই। আমি বলেছি না রে ভাই, ওসব লাগবে না। আমাকে বা আমার কর্মকাণ্ডকে ভালো লাগলে আমাকে এমনিতেই মনে রাখবে। আইডি খুলে মনে করিয়ে দিতে হবে না। তখন বলল, অন্তত একটা ফ্যান পেজ খুলে দিই। আমি বললাম, এখনকার ফ্যান আমার লাগবে না। এরা বুঝে না বুঝে যাতা পেজে লাইক বা শেয়ার দেয়।
: তাই বলেন! ভালোই করেছেন। জানেন অনেক আগে ফেসবুক খুললেও আমি তখন অতটা ব্যবহার করতাম না। আর এখন একবেলা ফেসবুক না চেক করলে মনে হয় দুনিয়া থেকে পিছিয়ে পড়েছি।
: আসলেই কী তাই? ফেসবুকের অনেক ভালো ব্যাপার আছে কিন্তু খারাপ ব্যাপারও তো কম না। বাংলাদেশে ধর্মের দোহাই দিয়ে যে ঘটনা হয়েছে সবগুলোর গুজবই ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। আর মিয়ানমারে যে গণহত্যা ঘটল তার সবচেয়ে বড় অনুঘটক ছিল ফেসবুক। আর যেকোনো আন্দোলন বা উৎসবের ইভেন্টে যে পরিমাণ মানুষ গোয়িং বা ইটারেস্টেড দেয়, তার কতজন বাস্তবে সেটাতে যোগ দেয় বলেন। আর একটা ব্যাপার দেখেছেন, যারা একটু বেকার টাইপের তারা আমার মতো ইদানীং আর রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে মানুষের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য না করে ফেসবুকে অন্যের সমালোচনায় ব্যস্ত। কিছু একটা হলেই গেল সব রসাতলে গেল বলে জের তোলে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ঘটনার তীব্রতা অতটা না। যা হোক, অনেক জ্ঞানের কথা বলে ফেললাম স্বভাববিরুদ্ধভাবে। আপনার কথা বলেন।
: আমার আর কথা কী! ভাগ্যান্বেষণে সিডনিতে এসেছিলাম কিন্তু মনের মধ্যে আপনার স্বভাব লুকিয়ে ছিল। তাই আগের মতোই ছিলাম এত দিন। একটা মোটামুটি জব করি তা দিয়েই আমাদের চড়ুই পাখির সংসার চলে যেত। অনেক দিন ধরে কাজের বাইরে তাই সে কাজ পাওয়াতে খুশিই হয়েছি। এখন বাস্তবতা সামলাতে আমার জেরবার অবস্থা।
: ব্যাপার না হাসান ভাই। অভ্যাস হয়ে গেলে আর এতটা খারাপ লাগবে না। আর এখানকার লাইফস্টাইলই এমন। আপনি আর কতটা এর ব্যতিক্রম হতে পারবেন বলেন।
: তাও ঠিক হিমু ভাই। কিন্তু একটা ব্যাপার না আমি কোনো ভাবেই নিতে পারছি না। সকালবেলায় মেয়েকে ঘুম থেকে ওঠাতে হয় অনেক ডাকাডাকি করে। প্রতিদিনই সে একই প্রশ্ন করে, বাবা আজ কি তোমার ছুটি? কারণ সে জানে আমার ছুটি থাকলে আমি ওর সঙ্গে খেলব।
: সেটাতো আপনি সপ্তাহ শেষেও খেলতে পারবেন।
: আসলে মেয়েটা দুনিয়ার সব আবেগ তার হৃদয়ে নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছে হিমু ভাই। তাই আমি যদি তার সঙ্গে সামান্য একটু খেলাধুলা করি তাতেই সে অনেক খুশি হয়ে যায়।
: আপনিওতো এমন ছিলেন একসময়। আপনার কিন্তু এখন আর আগের মতো আবেগ নাই, তাই না?
: কথা সত্য হিমু ভাই। আমারও আর আগের মতো আবেগ নেই কিন্তু একটা ব্যাপার আমাকে আজ সকালে খুবই আহত করেছে।
: সেটা আবার কী? আপনি না আমার অনুসারী তাহলে জাগতিক আবেগ অনুভূতি আবার আপনাকে কেন আহত করে?
: জাগতিক আবেগ অনুভূতিতো আমাকে অতটা আহত করে না, সেটা আপনি জানেনইতো। তা না হলে মানুষ আমাকে যে পরিমাণ খোঁটা দেয় অস্ট্রেলিয়ার ভাষায় বুলিইং করে, সেটা আমলে নিলেতো জীবন অসহ্য হয়ে যেত। কিন্তু আমি সেগুলোকে শুনেও না শোনার ভান করি।
: তাহলে কী এমন ব্যাপার ঘটল আজ?
: সকালে রায়ানকে যখন ডে কেয়ারে নামিয়ে দিয়ে আসতেছি তখন গাড়ি থেকে নামার সময় রায়ান আমাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে এমনভাবে কান্না শুরু করে দিল, যেন আমি ওর কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছি। এরপর থেকেই মনটা খারাপ হয়ে আছে এবং কোনো কাজে আর মন দিতে পারিনি সারা দিন।
: হাসান ভাই মন খারাপ কইরেন না। এই পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই মায়ার খেলা। এখানে আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে কারও মায়ার বাঁধনে বাধা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বাঁধন অন্য রূপে পরিবর্তিতও হয়। যা হোক, একদিনের তুলনায় অনেক বেশি কথা বলে ফেলছি। আমি আসলে কথা বলতাম না। আপনি মোটরওয়ের মতো রাস্তায় গাড়ির সিটে বসে ঝিমাচ্ছেন, তাই ভাবলাম একটু সাবধান করে দিই। কারণ আপনার ছেলেমেয়ে দুজনই অধীর আগ্রহে আপনার অপেক্ষায় রয়েছে। আপনি সুস্থভাবে ফিরে গিয়ে ওদেরকে বাসায় নিয়ে গিয়ে আবার হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠবেন সেটাই আসল জীবন।
এই কথা বলেই হিমু ভাই আবার গাড়ির পেছনের সিটে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। একটু পরেই আমি তার নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু নাক ডাকার শব্দ গাড়ির হর্নের মতো লাগছে কেন আমার কাছে। আমি হতচকিত হয়ে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি আমার সামনে কোনো গাড়ি নেই। ইতিমধ্যেই জ্যাম ছুটতে শুরু করেছে। কিন্তু আমার পেছনের গাড়িটা আমার জন্য আটকে গেছে। তাই হর্ন দিয়ে আমাকে সজাগ করে দিচ্ছে। এখানে রাস্তায় চলার সময় এমনিতে মানুষ গাড়িতে হর্ন দেয় না। হর্ন দেয় কোসান বা নিরাপত্তার জন্য। আমি অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিতে দিতে আড়চোখে পেছনের সিটে তাকিয়ে দেখি সেখান হিমু ভাই নেই। তখন আমার মনে পড়ল হিমু ভাইয়ের সেই কথাটা। জগৎ আসলে মায়ার খেলা। আমিও তখন মনে মনে ভাবলাম আসলেই জগৎ একটা মরীচিকা। যতই দ্রুত এর মায়া কাটানো যাবে জীবনটা ততই সহজ হয়ে যাবে। এটা ভাবতে ভাবতে আমি গাড়ির গতি বাড়িয়ে এক শ দশ কিলোমিটারে নিয়ে গেলাম। কারণ মোটরওয়েতে গতিসীমার নিচে গাড়ি চালালে অনেক সময় দণ্ড দিতে হয়।
...
মো. ইয়াকুব আলী: মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>