ছেলেরাও কাঁদে

রোববার সকালে ঘুম থেকে উঠে রুদ্র এমন একটা কষ্ট পাবে ভাবেনি। কী করবে বুঝতে পারছিল না। দ্রুত তাঁর মাকে নিয়ে হাসপাতালের পথে রওনা দিল। তাঁর মা পৃথিবীর সহজ–সরল নারী। সে চোখে অন্ধকার দেখছে, কিন্তু তাকে ঠিক থাকতে হবে। জীবনে ছোটখাটো সমস্যা এলেও সে নিজে তা সমাধান কমই করেছে। তার সব সমস্যার সমাধান বাবা, চাচা ও ছোট ভাই করে। সে শুধু সমস্যা তৈরি করে বিড়ালের মতো গুটি মেরে বসে থাকতে জানে। নিতান্ত দুর্বল স্থানে গলাবাজি করলেও বিশেষ ক্ষেত্রে সে ভাজা মাছ উল্টে না খাওয়া মানুষ। আজ এ সময় কেউ সঙ্গে নেই। বিশাল পরিবার এখন ছোট হয়ে গেছে। এর মধ্যে আজ ঘরের প্রধান দুজন নেই। ছোট ভাই রিয়ান ও বাবা গতরাতে ঢাকা গেছেন রিয়ানের চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য। মেজো চাচা পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। আরেক চাচা প্রবাসী। আগে যেকোনো দায়িত্ব সব তাঁরাই করেছেন। এখনো করেন, আর্থিক বা বড় সব সিদ্ধান্তের বিষয়ে। তার জীবনের হাল ধরার জন্যও তার স্ত্রী শক্ত ধাঁচের মেয়ে।

বিয়ের পরও যাকে বলে গায়ে তেল লাগিয়ে চলাফেরা করেছে সে। তবে কয়েক মাস ধরে তার জীবনে সব গিয়ার উল্টো হতে চলেছে। এক দিকে জোড়া লাগে তো আরেক দিক ভাঙে। আজ ঘুম ভেঙেছে ছোট বোন ইরিনার চিৎকারে। তার মা ঘর থেকে পেছনের দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে ছুটল। মুখে চিবুকের কাছে, ভেতর থেকে রক্ত ঝরছে। তার বিশাল শরীরে এত মনের জোর নেই।

রুদ্র দেখতে হিরোর মতো। হাসলে গালে টোল পড়ে। চাল–চলনে খুব ভদ্র। চেহারায় শিশুদের সরলতা যেমন, তেমন ভেতরেও। তাই, হয়তো ভালোমন্দের বিচার অনেক সময় করতে পারে না। নিজেও বুঝতে পারে না কী ভুল কোন দিকে করে ফেলে। এর মাশুল দিচ্ছে এখন। অনেক দিন হয়, তার বউ ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে। এসব ঠিক হয়ে যাবে বলে মনে হলেও আবার বেঁকে যায়। মাঝে মাঝে বউ তাকে ব্লক করে রাখে হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে। মন এত খারাপ হয় যে, বলার মতো না। ছেলেকেও দেখতে পারছে না। তাই সে জিমে সময় কাটায়।

ছোটবেলায় সে নিজের হাসিকে শাহরুখ খানের সঙ্গে তুলনা করত। সেই ছোট রুদ্র কখন যে এত বড় হলো! তবে, অনেক বড় হলেও ভেতরে এখনো শিশুর মতো। বাইরে শুধু ছয় ফুট উচ্চতা, সুঠাম। তবে রুদ্রের স্বভাব হঠাৎ করে খারাপ হতে শুরু হলো। একটু খারাপ না, যাকে বলে বখে যাওয়া। এ জন্য বউ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে চলে গেছে। স্বভাব ঠিক হলে তবেই ফিরবে। তার খারাপ স্বভাবের কথা সে সবাইকে বলতে পারে না। তার ফুফু ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফোন করে চাপ দেওয়াতে সে স্বীকার করেছে, সে ড্রাগ নেয়। নাম বলতে লজ্জা লাগছে তার, তাই বলেনি। শুধু বলেছে ভারতীয়। ড্রাগ শরীরের কোনো কার্যকারিতা সাময়িক সময়ের জন্য বাড়িয়ে দেয় হয়তো। তবে অনেক স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা রহিত করে। তাই সে তার চাহিদা মতো জীবনযাপন করত। নতুবা স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। সে তা বুঝতেই পারছে না। নাবিলা তা লক্ষ্য করেছে এবং তখনই সে বুঝতে পেরেছে, সে কিছু একটা নেয়। ফুফু শাশুড়ির সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক হওয়ায় সে অকপটে এটা বলেছে।

২০২০ সালের গত মার্চে প্রথম জানতে পারেন অ্যালেন। তখন একবার শাসন শুরু হলেও কিছুদিন পরে সে আবার শুরু করে। সে আর বের হয়ে আসতে পারে না। পড়ে নিস্তেজ হয়ে ঘুম দেয়। এমনিতে কোনো উপদ্রব বা মদের মতো গন্ধ নেই যে, সে নেশা করে কেউ বুঝবে। টাকার কোনো হিসাব মিলে না। ঘরে সে টাকা পয়সা দেয় না। তার ওপর লকডাউন চাকরি নেই বলে বলে সে আত্মীয়স্বজন অনেকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছে। নিতে নিতে সে হাত এখন সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। তার নৈতিক অবক্ষয় যাকে বলে। এক আত্মীয়ের নালিশ এ ঘটনা সামনে আসে।

ডিসেম্বরে সে অসুস্থ হয়ে বেশ কিছুদিন বাসায় ছিল। হয়তো ড্রাগ বন্ধ হওয়ার কারণেই বারবার বমি হচ্ছিল। কোভিড–১৯ পরীক্ষা করা হলেও এসব কিছু না। তবে সে খুব দুর্বল বোধ করত। খেতে পারত না। সে পরিবারের চাপের মুখে এই সুযোগে তার বদ অভ্যাস থেকে বের হয়ে এসেছে। কিন্তু পাওনাদাররা তার পিছু ছাড়ছে না। নিজেকে সংশোধন করার এই সুযোগ সে ছাড়েনি। শারীরিক কসরতের জন্য জিমে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন মেডিটেশন করছে। কাউন্সেলিং করেছে। তাকে বাচ্চাদের মতো এখন মুখস্থ করতে হচ্ছে, ‘সদা সত্য কথা বলিব।’ তার মিথ্যাচারের জন্য তাঁর বউ দূরে চলে গেছে। সে ফেসবুকে প্রেম করে অনেক কষ্টে এ মেয়েকে বিয়ে করেছে। তার ফুফু জিজ্ঞেস করেছিলেন, মেয়ে দেখতে কেমন। যে ছবি দিল, তাতে তেমন সুন্দর লাগছিল না। এটা বলার পর বলল, আমি আর কী সালমান খান? যে নিজেরে শাহরুখ খান ভাবত, সে তো সালমান ভাববে না—এটাই স্বাভাবিক। বিয়ে হয়ে এখন তাঁদের পাঁচ বছর বয়েসের একটা ছেলে। যে কি না দেখতে তারই কপি। সবাই ওর মধ্যে তার ছোট বেলা দেখেন।

রুদ্রের মায়ের চিবুকে বাইরে–ভেতরে ছয়টা সেলাই লেগেছে।

ওপরের মাড়ির দাঁত সামনের কয়েকটা পড়ে গেছে। ওনার ডায়াবেটিস প্রচণ্ড বেশি। হয়তো এ জন্য আরও নরম হয়ে গেছেন। হাসপাতাল থেকে ফেরত এসে রুদ্র ফুফুকে ফোন দিল হোয়াটসআপে। এলেন তখন শুধু ঘুমানোর আয়োজন করছেন। ফোন ধরতে গিয়ে দেখেন হোয়াটসআপে ভাবির ছবি দেওয়া। একটা ব্যান্ডেজ করা, একটা এমনি।

-কী হয়েছে ভাবির? এ প্রশ্নের জবাবে রুদ্র ওপাশ থেকে ডুকরে উঠল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কথা বলতে পারছে না।

-আগেতো বল কী হয়েছে...?

বলতে বলতে এলেনেরও চোখে জল ভরে আসে। তাঁর ভাবির মতো ভাবি হয় না। এ সেই ভাবি, যে কিনা পড়তে পড়তে খাবার টেবিলে না গেলে, খাবার প্লেটে বেড়ে পড়ার টেবিলে দিয়ে যেতেন, ‘আপা খেয়ে ফেলো’ বলে। ভাবি গ্রামের অতি সহজ–সরল মেয়ে। ভাইয়ের নানা অত্যাচার সহ্য করেও সংসার করেছেন। তার কারণ স্বামী–স্ত্রীর প্রেম মায়া-মমতা সব ঠিক ছিল এবং এখনো আছে। দোষ ছিল যেকোনো কিছুর রাগ বউয়ের ওপর মেটাতেন।

-আম্মা পড়ে গেছেন। থুতনিতে ছয়টা সেলাই লেগেছে। বলতে বলতে শিশুর মতো রুদ্র কান্না করে উঠল। ভিডিও কলে এ দৃশ্যে এলেন অসহায় বোধ করেন।

-বাবা কাঁদিস না। আব্বু আমার। দুর্ভাগ্য, কী করবি বল?

এর বেশি কথা এলেনের গলা দিয়েও বের হলো না। তারও চোখ দিয়ে পানি ঝরছে।

-ওষুধপত্র সব কিনেছিস? টাকা–পয়সা আছে তোর কাছে?

-হ্যাঁ কিনেছি।

-কিছু লিকুইড খাবার কিনিস। এনসিউর, স্যুপ এসব ব্যবস্থা রাখিস। টাকার জন্য ভাবিস না। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি তোর ছোট চাচাকে ফোন করছি। ভাবিকে একবার দেখি।

চোখ দিয়ে সমানে পানি ঝরছে নিপার। কোনো শব্দ নেই। এলেনও আর চোখের পানি বন্ধ করতে পারছে না। শুধু বলল—

-লক্ষ্মী ভাবি আর কেঁদো না। তাকে বুঝিয়ে এলেন ফোন রাখল।

আবারও গ্রুপ কলে এলেন ও তার ভাই কথা বলে রুদ্রের সঙ্গে। তাঁরা বড় ভাইকে না বলতে নিষেধ করে দিল। টেনশন করবেন। এমনিতেই তার শরীর ভালো না। রিয়ানের ইন্টারভিউ দুপুর বারোটায়। কী একটা ব্যাংকের চাকরির জন্য সে গেছে। তবে তাঁরা দুভাইয়ের মধ্য সহজ–সরল কিছু ব্যাপার আছে, যা এখনো শিশুর মতো। একা ঢাকা যাবে কি করে, এটি রুদ্র ভাবত। রিয়ানের অবস্থা এ রকম কি না? সঙ্গে তাই তাদের বাবাও গেলেন। সোমবার থেকে লকডাউন, আবার রাতে ফিরতে হবে তাদের। দেশের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এই বিপদের সময় মন আরও ছোট হয়ে যায়।

ঘরের এই পরিস্থিতিতে সব দায় গিয়ে পড়ল ছোট বোন ইরিনার ওপর। সে দুপুরে ভাত–তরকারি সব রান্না করল। বেচারি কখনো কিছু তেমন করেনি। তবে রুদ্রের ফোন পেয়ে তাদের ছোট ফুফুও চলে এসেছেন। কিন্তু বিকেলে তাঁকে বিদায় দিতে হলো। লকডাউন পর দিন থেকে। পরে আবার না যেতে পারে। রোববার দিনটা এ রকম চাপা যন্ত্রণার মধ্যে গেল। এলেন এবং তাঁর ছোট ভাই কেউ–ই সে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারল না। একটু পর পর ভাবির খবর নিতে ফোন করে। রুদ্রের কাছে এই একটা দিন যেন অনেক দীর্ঘ। রাতে সে নিজে ভাই ও বাবার জন্য ডিম ভুনা এবং আরও কিছু শর্টকাট খাবার তৈরি করল। যাতে ভোর রাতে এসে খেতে পারে।

এলেন ছোট ভাই পোর জন্য মেসেজ রাখল, যেন ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া–দাওয়া করে কল দেয়। দূর থেকে প্রিয়জনের মাথায় হাত রাখা যায় না সত্য, তবুও মনে মনে রাখতে হয়। মন দিয়ে স্পর্শ করতে হয়। সে স্পর্শে ভালোবাসার কষ্ট। এলেনের মনে পড়ে, নাদুসনুদুস ভাইপোদের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে বলত, ফুপি আমার জন্য ফ্রিজ ভরে কাস্টার্ড বানিয়ে রেখে যাও। এলেন পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে কেঁদে ওঠ। রিয়ান মেসেজের উত্তর দিয়েছিল ‘আচ্ছা’। তবে ভোর ছয়টা বাংলাদেশে তখনো কল দেয়নি। তাকে অনলাইনে দেখে এলেন কল দেয়-

-হ্যালো আব্বু!

-জি ফুপি! কান্না জড়ানো গলা।

-কী করবি বাবা সব আমাদের কপাল!

-আমি কেন গেলাম ফুপি? আমি না গেলে আমার মা এত কষ্ট পেতেন না। তুমি তো জানো না, ঢাকায় পা রাখার পর থেকে আমার মনে হচ্ছিল আমার পা চলছে না। আব্বা থাকাতে আমি শুধু পরীক্ষা দিয়েছি। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমার কেন এমন লাগছে। এতটুকু বলে সে আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। এলেনের চোখে জল ভরে আসে তিনি নিজেকে সামলান। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সব মনই একে অন্যের সঙ্গে জোড়া। এ জন্য দূরত্ব বা আড়াল কোনো ব্যাপার না। মানুষের মন সে স্পর্শ পায়।

-তোরা যদি শক্ত না হোস তখন ভাবি আরও দুর্বল হয়ে যাবেন। তোদের মনের কষ্ট ওনার কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেবে বাবা। তোরা হয়তো জানিস না, আল্লাহ তোদের কোনো বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। ধৈর্য ধর। আমি গতরাতে স্বপ্ন দেখছিলাম, ঝড়ে বড় বড় গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ। তখনই আমি ওঠে বসে তোর আর ভাইয়ের জন্য দোয়া করেছি তোরা যেন নিরাপদে ফিরিস। মানুষের জীবন বড় রহস্যময় রে বাবা। কখন কী হয় কেউ জানে না। মন স্থির রাখ।

-হ্যাঁ রোববার সন্ধ্যা থেকে ঝড় হলো। অনেক কষ্ট হয়েছে ট্রেনে উঠতে। মানুষের ভিড়ও অতিরিক্ত।

আম্মার সব দাঁত পড়ে গেছে (বলে আবারও কান্না জুড়ে দেয়।) একটু সামাল দিতে না দিতে আরও একটা অঘটন! কী হলো আমাদের পরিবারে?

-চিন্তা করিস না বাবা। সব ঠিক হবে। ভাবিকে ভালো কোনো দাঁতের ডাক্তার দেখিয়ে সব লাগাব। এ দেশে ফ্যাশন করার জন্য নারীরা ইচ্ছে করে ফেলে দেয়। তুই ভাবিস না। সব ঠিক হবে আব্বু।

রিয়ান একটু শান্ত হয়, তবে অডিও কলে তার নাক টানার শব্দ তার ফুপির পাঁজরে যেন আঘাত করছিল। এলেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ফরসা মুখের এক যুবকের চোখ থেকে শিশুর মতো পানি ঝরছে। স্বাভাবিক গলা রেখে তাকে ঘুমাতে বলেন। লকডাউনের জন্য তাঁদের যাত্রা পথও কঠিন ছিল। বড় ভাইয়ের সঙ্গে আর কথা বলো না। রিয়ান বলল, তার বাবার শরীরটাও ভালো না। এলেন জানে, ভাই ভাবির প্রতি খুব দুর্বল! নিশ্চয় উনিও কাঁদবেন। কথা না হলেও এলেন যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, তাঁর বড় ভাইয়ের চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। পুরুষ মানুষের মন শক্ত, এসব মিথ্যে কথা। এরা কষ্ট পেলে শিশুর চেয়ে ভঙ্গুর হয়ে যায়। এলেন নিজের চোখ মোছেন। কোন কষ্ট যোগ করতে চান না। নিজের মনকে তাই নিয়ন্ত্রণে রাখেন।