ছায়াময়ী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শওকত দ্বিতীয়বারের মতো উঠে শব্দ করে দরজা লাগাল। অসম্ভব রাগ হচ্ছে তার। ইচ্ছে হচ্ছে সবকিছু ভেঙেচুরে একাকার করে। তবে সাহস হচ্ছে না।

তার মা একরোখা। শওকতের আব্বু তার আম্মুকে বলেন ‘ঝাঁসির রানি’। যেমন সাহসী, তেমন জেদি। খালি হাতে একবার শওকতের আম্মু পাড়ার তিনজন ছেলেকে পিটিয়েছিলেন পাশের বাসার শাওলিকে উত্ত্যক্ত করার জন্য।

শাওলির আম্মু ছেলেগুলো যদি রাগ করে কিছু করে, সেই ভয়ে বাসা বদলে অন্য এলাকায় চলে গেছেন দুই সপ্তাহের মধ্যে।

শওকতের আম্মু পেটানোর পরদিনই রোজকার রুটিন অনুযায়ী কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ছাত্রছাত্রী পড়াতে কলেজে গিয়েছেন। শওকতের আব্বু শুকনো মুখে তাঁকে কলেজে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ভীষণ বকা খেয়েছেন।

শওকতই আতঙ্কে জমে ছিল অনেক দিন। হাড়–জিরজিরে শুকনো শরীর শওকতের। তিনজন তো দূরে, একজন তাকে মারতে এলেও সে হাসপাতালে যাবে।

যদিও তার আম্মুর ধারণা অন্য রকম। শওকতের আম্মু জেসমিন হকের ধারণা, অন্যায়কারীকে থামাতে গায়ের জোরের চেয়ে অনেক বেশি দরকার মনের সাহস। একবার মনে সাহস এসে গেলে নাকি গায়ে এক শ হাতির জোর চলে আসে।

এখনো সেই নিয়ম পরীক্ষা করা শওকতের হয়ে ওঠেনি। মারপিট থেকে দূরে থাকতে সে পছন্দ করে। কেউ তাকে এক গালে চড় দিলে গান্ধী মতবাদ মেনে সে আরেক গালের সঙ্গে পিঠও এগিয়ে দিয়ে কিল–ঘুষি খেয়ে আসে।

সাহসী মায়ের পেটে শওকত হলো কী করে, তা–ই একটা বিস্ময়। শওকতের ধারণা, সে তার বাবার মতো হয়েছে। শওকতের বাবা আহসানুল হক সাহেবের সাহসও সম্ভবত একটু কমতির দিকেই।

শওকতের আম্মুর সবকিছুতেই বড্ড কড়াকড়ি। এই যেমন আজকের ঘটনাই ধরা যাক। তুচ্ছ কারণে তিনি শওকতের ওপর রেগে গিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। প্রথমেই ওয়াই–ফাইয়ের মডেম ফেলেছেন খুলে। আগামী তিন দিন শওকতের ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ। মোবাইলের পয়সারও পাই পাই হিসাব রাখেন জেসমিন। সুতরাং বাড়তি ডেটা কেনারও তেমন উপায় নেই।

তিন দিন ইন্টারনেট ছাড়া থাকলে সম্ভবত শওকতের বন্ধুরা ভুলেই যাবে যে শওকত নামে কোনো ছেলেকে তারা কখনো চিনত। দল বেঁধে ফাইটিং গেমস খেলে তারা নেটে। তাকে দল থেকে বাদ দিতে এক সেকেন্ডও ভাববে না তার বন্ধুরা। সবাই গেমটা নিয়ে বড্ড বেশি সিরিয়াস।

এসব কথা জেসমিনকে বলে কোনোই লাভ নেই। তিনি বলবেন, ‘এতই যখন তোর টেনশন, যা বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আয়।’

এই যুগে কে যাবে রাস্তাঘাটের জাম ঠেলে আরেকজনের বাসায় দেখা করতে? চ্যাটিং, ভিডিও চ্যাটিংয়ের মতো চমৎকার ব্যবস্থা থাকতে কোনো পাগলে এ রকম খুনে গরমে বাইরে যায়?

মায়ের বুদ্ধি শুনে চললে শওকতের সঙ্গে আর কেউ কথাই বলবে না। ষোলো বছরের একটা ছেলের জীবন যে কতটা কঠিন, সে নিয়ে কোনো ধারণা আছে তার আম্মুর?

ভেবে ভেবে শওকত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এত নাটক হবে জানলে নাক চেপে ধরে করলা ভাজিটুকু খেয়েই ফেলত সে। মতির মায়ের হাতের রান্না অতি বিশ্রী। সেই রান্নাই গদগদ মুখে জেসমিন আর আহসান খেয়ে থাকেন আর প্রায়ই মতির মায়ের সঙ্গে আহ্লাদ করেন।

অতি অখাদ্য সেই করলা ভাজি শওকত খেতে রাজি হয়নি বলেই এত বিপত্তি। জেসমিন হুংকার দিয়ে বলেছেন, করলা না খেলে তাকে মাছ দেওয়া হবে না। শওকত তাতেও রাজি ছিল। যে মাছের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সেই মাছও সে দুই চোখে দেখতে পারে না। যে মাছের নাম ট্যাংরা, তাকে খাবার কোনো দরকার আছে মানুষের?

তখন তার আম্মু বলেছেন, তাহলে খেতেই হবে না। শওকত সুড়ুৎ করে উঠে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেসমিনের বজ্রকণ্ঠের গর্জন শোনা গেছে, ‘বাবা-মা এবং খাবার—এই তিনের সঙ্গে বেয়াদবি করার জন্য তোর আগামী তিন দিন ইন্টারনেট বন্ধ।’

সে নিয়েও শওকত কথা বাড়ায়নি। কারণ, সে পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানে, সে যত তর্ক করবে তত নিষেধাজ্ঞার দিন বাড়বে। তার আম্মু কঠিন চিজ। উঠে শব্দ করে দরজা লাগানোর তিন মিনিটের মধ্যে তার আম্মু মডেম খুলে রুমে এসে দেখিয়ে গেছেন। তাতেই এখন শওকতের মেজাজ সপ্তমে।

জুন মাসের দুপুরের ভ্যাপসা গরমে জীবন অতিষ্ঠ। ঘটাং ঘটাং শব্দে পাখা ঘুরলেও গরম কাটছে না। শওকতের ইচ্ছে করছে কুচি কুচি বরফ দিয়ে এক গ্লাস লেবুর শরবত খেতে। তা–ও সম্ভব হবে না। মতির মা ইতিমধ্যেই ভাতঘুম দিতে চলে গেছে। ঘুমন্ত ড্রাগনকে জাগানোর সাহস শওকত কোনোকালে হয়তো অর্জন করতে পারবে, কিন্তু সদ্য ঘুমানো মতির মায়ের ঘুম ভাঙানোর চিন্তাও সে করতে পারে না।

শর্মী থাকলে তাকে বলা যেত। সে যে খুব খুশি মনে করত তা নয়। তবে করে দিত। কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেলেই শর্মী কেঁচো। তখন তার শওকত ছাড়া উপায় থাকে না। এ কারণে ভাইকে হাতে রাখতে এ রকম আবদার সে রাখে। শওকতের দুশ্চিন্তা, শর্মী যদি একবার কম্পিউটারের সহজ ট্রিকসগুলো শিখে যায়, তখন শওকতের কোনো কাজই আর সে করবে না। আজকে শর্মীও বাসায় নেই। সে গিয়েছে মালিবাগে মেজ খালামণির বাসায়। সেখানে শওকতদের সব খালাতো-মামাতো বোনেরা একত্র হয়েছে। আজকে নাকি গার্লস অনলি পার্টি।

আধঘণ্টাতেই শওকত বিরক্ত হয়ে যায়। তাদের স্কুলে পরীক্ষার পর দশ দিনের বন্ধ শুরু হয়েছে মাত্র গতকাল থেকেই। আর আজকেই তার আম্মু নেট বন্ধ করে দিয়েছেন। শওকত মনে মনে ভাবে, এ লেভেল কোনোভাবে শেষ করেই সে বিদেশে চলে যাবে। তখন আর তার আম্মুর এত অত্যাচার সহ্য করতে হবে না।

তার সিনিয়র বড় ভাইদের বেশির ভাগই বিভিন্ন দেশে পড়তে চলে গিয়েছেন। রোমাঞ্চকর সব গল্প শোনা যায় তাদের কাছে। শওকত এখনই মনে মনে দিন গুনছে, কবে তাকে তার মা বড় হওয়ার স্বীকৃতি দেবে। ষোলো বছর বয়সী একটা ছেলের সঙ্গে তার আম্মু এমন ব্যবহারটা করেন, যেন তার বয়স দশ।

স্কুল থেকে ফিরতে একটু দেরি হলে দশ রকম প্রশ্ন। রাতে ঘুমানোর সময় দরজা আটকানো নিষেধ। যাতে রাতে ঘুম ভাঙলে জেসমিন এসে দেখতে পারেন যে শওকত ঘুমোচ্ছে কি না। বন্ধু আবিরের বুদ্ধি শুনে শওকত একবার দরজা আটকিয়েছিল। আরিব বলেছিল, আটকালে আন্টি করবেটা কী? খুব বেশি হলে সকালে বকা-বাদ্য করবে। এক সপ্তাহ কষ্ট করে বকা সহ্য করতে পারলে এরপরে জেসমিন নিজেই হাল ছেড়ে দেবেন।

কার্যক্ষেত্রে ঘটনা মোটেই সে রকম হয়নি। জেসমিন রাত তিনটার সময় দরজায় ধাক্কা দিয়ে শওকতকে ঘুম থেকে তুলে হুংকার দিয়েছেন, দরজা বন্ধ কেন এবং স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যদি দরজা বন্ধ থাকে তাহলে দরকার হলে অ্যালার্ম দিয়ে প্রতিদিন রাত তিনটার সময়ে তিনি ঘুম থেকে উঠে শওকতকে জাগিয়ে এই একই প্রশ্ন করবেন।

শওকত এক ভুল আর দুবার করেনি। শওকতের টেনশন, তার বিয়ে হওয়ার পরেও সম্ভবত তার আম্মু একইভাবে খবরদারি করে যাবেন। এমতাবস্থায় কোনো মেয়ে কি তাকে বিয়ে করতে রাজি হবে?

বিয়ের কথা মাথায় আসতে শওকত আরেকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিয়ে তো ‘দিল্লি বহু দূরের’ মতো ব্যাপার। এখন পর্যন্ত তো তার কোনো গার্লফ্রেন্ডই হলো না। ক্লাসে গার্লফ্রেন্ডবিহীন অবস্থায় সে ছাড়া আর আছে মাত্র দুটি ছেলে। তা সজীব আর রবিনের গার্লফ্রেন্ড হওয়া সম্ভব নয়। সজীবটা এক নম্বরের গুন্ডা আর রবিন অতিরিক্ত ভালো ছাত্র।

অতিরিক্ত কোনো কিছুই মনে হয় মেয়েরা বেশি পছন্দ করে না। শওকতের কোনো কিছুই অতিরিক্ত না। সে দেখতে সাধারণ। কথা বলে সাধারণভাবে। ছাত্র হিসেবে মাঝারি। মানুষ হিসেবেও সাধারণ। দুষ্টুমিতে থাকলেও কখনো সীমা অতিক্রম করে না। আবার অতিরিক্ত ভালো ছেলেদের ধারে কাছেও থাকে না।

মেয়েরা বন্ধু হিসেবে অবশ্যই খুব ভালো। কিন্তু তারপরও একটা গার্লফ্রেন্ড না থাকলে কি আর মান থাকে? শওকতের আব্বু-আম্মু নাকি নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছেন। শওকতের সেটা কোনোভাবেই বিশ্বাস হয় না। তার আব্বুর এত সাহস থাকতেই পারে না। শওকতের দৃঢ়বিশ্বাস, জেসমিনের কোনোভাবে আহসানকে পছন্দ হয়েছিল এবং আহসান ভয়ে ‘না’ বলতে না পেরে বিয়ে করে ফেলেছেন। না বলতে পারার আরেকটা কারণ সম্ভবত হচ্ছে জেসমিনের চেহারা। তার আম্মুর চেহারা খুব মিষ্টি। মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে পারেন না। কী করে এই ভালোমানুষি চেহারার নিচে এ রকম অসুর লুকিয়ে থাকে, খোদায় জানে।

মান অবশ্য এমনিতেও নেই। কারণ হচ্ছে তার নাম। এখনকার ছেলেমেয়েদের খুব সুন্দর সুন্দর নাম হয়। অরণ্য, অঙ্কন, রূপকথা—আরও কত কী! আর তার নাম রেখেছেন তার আম্মু শওকত। কোনো ডাকনাম রাখেননি পর্যন্ত।

জেসমিন তার চাচাতো ভাইয়ের নামে শওকতের নাম রেখেছেন। সেই শওকত আহমেদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি ভয়ংকর সাহসী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে অবিশ্বাস্য কর্ম হচ্ছে, তিনি খালি হাতে পানির নিচে ডুবে থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর সেনাভর্তি নৌকা ডুবিয়ে তার পুরো দলকে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সেটিই ছিল তাঁর শেষ বীরত্ব।

প্রবল গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া দেহটিকে টাঙ্গাইলের কাছের এক বিল তার জল দিয়ে পরম আদরে ঘিরে রেখেছিল। সহযোদ্ধারা ভালোবাসা আর সম্মানে তাদের গ্রামে এক শিউলি গাছের নিচে তাঁকে কবর দিয়েছিলেন। যদিও সেই কবরের চিহ্ন আর নেই। তবুও গ্রামে যাওয়া হলেই শওকতের আব্বু-আম্মু সেই কবর জিয়ারত করতে যান। তারা ধরে নেন, সেই গাছটির আশপাশেই কোথাও ঘুমিয়ে আছে সেই সাহসী মুক্তিযোদ্ধা।

দুপুরে এত বড় ঘটনা ঘটার পর শওকত রাতে ঠিক সময়ে খাবার টেবিলে চলে আসে। ঘাউড়া মানুষদের সঙ্গে ঝামেলা করে লাভ নেই। বরং ক্ষতিই বেশি। টেবিলে খাবারের মেনু দেখে শওকতের পেটে মোচড় দেয়। দুপুরের সেই ভয়ংকর কালো করলা ভাজি এখনো দৃশ্যমান। বেজার মুখে সে প্লেটে খাবার নিতে থাকে। শওকতের আব্বু ফিসফিস করে বলেন, ‘দে করলা পুরোটা আমার প্লেটে দিয়ে দে। তোর আম্মু আসার আগেই খেয়ে ফেলি।’

শওকত তার বাবার প্লেটে খাবার দিচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই জেসমিন খুশি খুশি চেহারায় রুমে ঢোকেন। শওকত আতঙ্কে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে। জেসমিন ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন কি না, বোঝা গেল না। কারণ, তিনি খাবার নিয়ে কিছুই বললেন না। চেয়ারে ধপ করে বসে আনন্দিত গলায় বললেন, ‘শওকত, তোর জন্য গুড নিউজ আছে।’

শওকত গোমড়ামুখে বলে, ‘কী ধরনের গুড নিউজ?’

‘এই যে ছুটিতে বসে বসে তুই এত বোর হচ্ছিস, সেটা থেকে মুক্তির উপায় বের করেছি।’

শওকত বলতে চাইল, মুক্তির উপায় একটাই, তুমি আমার ওয়াই–ফাই খুলে দাও। কিন্তু সে তা না বলে সতর্কভাবে বলল, ‘শুনি কী উপায় বের করেছ?’

‘তুই তো জানিস, মিলিরা গরমের ছুটিতে বান্দরবান যাচ্ছে। আমার কলেজও বন্ধ। তোর আব্বুর কিছু ছুটি জমে আছে। ভাবছি আমরাও কোথাও বেড়াতে যাই?’

আনন্দে শওকত এক সেকেন্ডের জন্য তার আম্মুর আগের সব কৃতকর্ম মাফ করে দেয়। ‘কোথায় যাব আমরা আম্মু? কক্সবাজার, রাঙামাটি, সেন্ট মার্টিন, সুন্দরবন? নাকি মিলি খালাদের সঙ্গেই যাই, বান্দরবান?’

তার আম্মু দাঁত বের করে হাসেন। ‘আরে ধুর, ওসব কী যাওয়ার জায়গা এই গরমে? আরও ভালো, ঠান্ডা জায়গায় যাব!’

শওকতের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে উত্তেজনায়, ‘ভুটান, ইন্ডিয়া? কোথায় যাব?’

‘ধুর, নিজের দেশ থাকতে আরেক দেশে কেন টাকা খরচ করতে যাব? আমরা যাব আমাদের গ্রামে, সাতপাড়ায়! ছোট চাচি ফোন করেছিলেন। গাছে গাছে আম, ছায়াঘেরা ঠান্ডা ঘর। চাচার পুকুরে নাকি এবার এত মাছ হয়েছে যে বলার না! গিয়ে মাছ ধরবি।’

ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায় শওকত। তাদের গ্রামের মতো বোরিং জায়গা আর হয় না। না থাকে প্রতিদিন কারেন্ট, না আছে ওয়াই–ফাই। বিকেল বেলাতেই অন্ধকার হয়ে যায় আর রাতটা এত লম্বা যে শেষ হয় না।

‘গ্রাম? গ্রামে যাব ছুটি কাটাতে? তুমি কি পাগল? সুমন গেছে থাইল্যান্ডে, আরাফাত সেন্ট মার্টিনে, ইরা গেছে সিঙ্গাপুরে। আর তুমি আমাকে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছ? অসম্ভব, আমি যাব না!’

জেসমিন হুংকার দেন, ‘যাবি না মানে? চাচি এত আদর করে যেতে বলেছেন, আর তুই যাবি না?’

শওকত মুখ শক্ত করে বলে, ‘না। তোমার চাচি আদর করে ডেকেছেন, তুমি যাও। আমি নিশ্চিত, শর্মীও যাবে না। আব্বু, তুমি কি যেতে চাও?’

শওকতের আব্বু না শোনার ভান করে চুপচাপ ভাত খেয়ে যেতে থাকেন।

জেসমিন গজগজ করেন, ‘ঢাকায় থেকে থেকে তোরা সব ফার্মের মুরগি হচ্ছিস। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কে নাই, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক নাই। জীবনে গ্রাম দেখেছিস? তার বাতাসে কত মায়া তুই জানিস?’

‘আমার জানার দরকার নাই!’

‘তুই না গেলে তোর এক মাস নেট বন্ধ।’

শওকত প্রচণ্ড রেগে উত্তর দেয়, ‘সারা জীবনের জন্য বন্ধ করে দিলেও আমি গ্রামে যাব না।’

তবে কার্যত শওকত যা হুমকি দেয়, কিছুই কোনো দিন সে বাস্তবায়ন করতে পারে না। তাই দিন দু–এক পরে বেজার মুখে শওকতকে কাঁধে তার প্রিয় ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে বাসার নিচে একটা মাইক্রোবাসের সামনে দেখা যায়। মাইক্রোবাসটির জানালায় কটকটে হলুদ প্রিন্টের পর্দা। পেছনে লাল স্টিকার, ‘তুমি আমার প্রাণের সখী’।

সানগ্লাস পরা ড্রাইভার হাসিমুখে মাথা দুলিয়ে হিন্দি সিনেমার গান শুনছে। ড্রাইভারকে একটু সতর্ক করে দেবে কি না, তা সে ভাবতে ভাবতেই জেসমিন এসে উপস্থিত হন। ভ্রু কুঁচকে তিনি বলেন, ‘এই যে ড্রাইভার সাহেব, মালপত্রগুলো তুলে ফেলেন। আর এই ভ্যাজর ভ্যাজর বন্ধ করে রবীন্দ্রসংগীত ছাড়েন।’

ড্রাইভার থতমত খেয়ে বলে, ‘রবীন্দ্রসংগীত নাই।’

‘তাহলে লালনগীতি?’

‘বাংলা গান আজকাল কাস্টমাররা পছন্দ করে না, তাই হিন্দি ছাড়া কিছুই নাই।’

জেসমিন মুখ শক্ত করে বলেন, ‘তাহলে গান শোনারই দরকার দেখি না।’

শওকত একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল।

জেসমিনদের গ্রামে যেতে হলে প্রথমে মাইক্রো করে শহর পর্যন্ত যেতে হয়। এরপর ভ্যানে করে একটা বিল পর্যন্ত। তারপরে নৌকা দিয়ে বিল পার হয়ে আবার ভ্যানযাত্রা। এখনো বাসা পর্যন্ত রাস্তা বড় করা হয়নি। শেষ দশ মিনিট হাঁটাপথ। মাইক্রোবাসে প্রবল ঝাঁকুনির কবল থেকে কোনো মতো হাড্ডিগুলো বাঁচিয়ে, নৌকায় উঠতে গিয়ে কাদাপানিতে আছাড় খেয়ে কাপড়ের বারোটা বাজিয়ে, ভ্যানে এয়ারফোন হারিয়ে কোনোক্রমে জান বাঁচিয়ে শওকতরা যখন গ্রামে পৌঁছেছে, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। জেসমিনের ছোট চাচিকে শওকত আর শর্মী ডাকে ছোট নানি। তিনি দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন অনেকক্ষণ। শওকতের গায়ের কাদা দিয়ে তাঁর শাড়ি মাখামাখি হয়ে গেল, তিনি মনে হয় খেয়ালও করলেন না।

তাদের কাজে-কর্মে সাহায্য করার ছেলেটির নাম সবুজ। সে কুয়া থেকে পানি তুলে আনল। হাসিমুখে বলল, ‘ভাইয়া, গোসল কইরা নেন। কুয়াপাড়ে পানি তুলছি।’

লজ্জার মাথা খেয়ে শওকত কুয়ার পাড়ে গোসল করতে গেল। ছোট নানি সাবান এনে তার পিঠে ডলতে লাগলেন। শর্মী মুখে হাত চাপা দিয়ে হিহি করে হাসতে লাগল। শওকত আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ভোর হতে না হতেই শওকতের আম্মু দুজনকে ঘুম থেকে তুলে দিলেন। গ্রামে নাকি সবাই সকাল সকাল উঠে পড়ে। সকাল নয়টা নাকি সেখানে বেলা দেড়টার সমান। শওকতের ইচ্ছে হতে থাকে যে সে পালিয়ে ঢাকা চলে যাবে। আবিরের বাসায় দিন চারেক থাকা কোনো ব্যাপারই না। ছোট নানি চার রকমের পিঠা বানিয়েছেন। ছোট নানা জোর করে খাওয়ানোর ব্যাপারে এক্সপার্ট। নাশতার টেবিল থেকে যখন শওকত ছাড়া পেল, তখন তার মনে হলো ওজন একদিনেই অন্তত চার কেজি বেড়ে গেছে।

কাঁদো কাঁদো মুখে সে শেষ চেষ্টা করল, ‘আম্মু ও আম্মু!’

‘কী রে?’

‘আমি কি তোমার ছেলে না? তুমি কি আমাকে ভালোবাস না?’

জেসমিন হেসে ফেললেন, ‘এ আবার কী ধরনের কথা!’

‘তাহলে প্লিজ ঢাকায় চলো। এক রাতেই পাগল হয়ে গিয়েছি। প্লিজ প্লিজ প্লিজ!’

জেসমিন আদর করে ছেলের চুল এলোমেলো করে দেন, ‘ধুর বোকা, এ রকম কথা বলতে আছে? তোর নানি কত আদর করে তোদের, এখন এভাবে চলে গেলে সে মন খারাপ করবে না?’

শওকত মুখ ভার করে বসে থাকে।

‘তুই বরং বাইরে গিয়ে ছেলেপিলেদের সঙ্গে কথা বল। বিকেলে মাঠে ফুটবল খেলা হয়, তুই ওইখানে গিয়ে খেলাধুলা কর!’

শওকত কিছু বলতে গিয়েও বলল না। ষোলো বছর এত যন্ত্রণাদায়ক একটা বয়স কেন? কবে যে বড় হবে ও!
(বাকি অংশ পড়ুন পরবর্তী পর্বে)


সামারা তিন্নি: অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া।