ছায়া মৃত্যু

রাশেদুল হুদার ‘অন্ধকারের কাব্য’। প্রতীকী ছবি
রাশেদুল হুদার ‘অন্ধকারের কাব্য’। প্রতীকী ছবি

বাসায় ফিরেই জানালার কাছে এসে দাঁড়াল ঈমা। মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডের মিনার মসজিদের কাছে এই ভাড়া বাসাতে তারা যেদিন এল সেদিনই ঈমার জানালাতে ঝোলানো হলো ভারী পর্দা। বাইরে থেকে তার ঘরের কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তার ঘরের ভেতর থেকে পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের পৃথিবীটাকে দেখা যায়। এ বাসায় আসার প্রথম থেকেই পাশের বাসার দক্ষিণের জানালাকে ঘিরে ঈমার ঔৎসুক্য।

পাশাপাশি দুটি বিল্ডিং। দুই বিল্ডিংয়েরই প্রবেশদ্বার পূর্বমুখী। দুই বিল্ডিংয়ের মাঝখানের সরু রাস্তা এ অঞ্চলকে একটি সরু গলিতে পরিণত করেছে। ঈমার ঘর তিনতলায়। তার দক্ষিণের জানলার মুখোমুখি ওই বাসার জানলার পর্দা তেমন ভারীও নয়। ঈমার ঘর থেকে অনায়াসেই ওই বাসার ঘরের জানলা দিয়ে মানুষগুলোকে ছায়া ছায়া দেখা যায়। ঈমা যতটা সময় বাসায় থাকে, তার ঘরে ওই জানলার দিকে মুখ করে রাখা পড়ার টেবিলের সঙ্গের চেয়ারটিতে বসে থাকে। রাতের অনেকটা সময় ঈমা তার ঘর অন্ধকার করে রেখে ওই বাসার জানলার পর্দায় চোখ রাখে। এভাবে দিনে-দিনে ঈমার স্মৃতিতে সঞ্চয় হয়েছে কিছু ছায়া চিত্র আর কিছু ছায়া চরিত্র।
একটি ছায়া যুগল আর তাদের একটি ছোট্ট বাচ্চা ছেলেকেও ঘরটিতে প্রায়ই দেখা যায়। ছায়া ছায়া নড়াচড়া দেখেই বোঝা যায় ওই বাড়ির গৃহিণীর বয়স খুব একটা বেশি না। তবে মেয়েটির চলার গতিতে কেমন যেন ক্লান্তি আর অবসন্নতা। ছেলেটি তার মায়ের কাছে খুব কমই থাকে। একটা কাজের বুয়াকেও মাঝে মাঝে ওই ঘরটিতে ঢুকতে দেখা যায়। রাতে ঘুমানোর সময় ছোট্ট ছেলেটিকে নিতে আসে বুয়া। ছেলেটি তার মায়ের কাছে ঘুমাতে চেয়ে কাঁদে কিন্তু ছেলেটিকে জোর করে টেনে নিয়ে যায় বুয়া। কাঁদতে কাঁদতে পাশের কোনো ঘরে বুয়ার সঙ্গে চলে যায় ছেলেটি।

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

প্রায় রাতেই ওই দম্পতিকে দেখা যায় ঝগড়া করতে। মহিলাকে পুরুষ গৃহকর্তা প্রায় রাতেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বিছানায়। কখনো বা দেখা যায় ঠাস ঠাস করে গালে চড় কষছে। আর মহিলা উচ্চ স্বরে কথা বলছে। তর্ক করার সময় মহিলার খোঁপা খুলে গিয়ে তার লম্বা ঘন চুল নিজের মুখটাকে বারবার ঢেকে দেয়। খুব খারাপ লাগে ঈমার। জানতে ইচ্ছে করে মহিলার নাম। ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটির নাম। তার স্বামী তাকে প্রহার করে কেন; তার কারণ। কেনই বা ওই ছোট্ট ছেলেকে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুমাতে দেওয়া হয় না। কাজের বুয়া ওই ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে কোন ঘরে যায়? সেকি একাই এক ঘরে ঘুমায় নাকি ওই কাজের বুয়ার সঙ্গে ঘুমায়? এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে ঈমা। পরদিন খুব সকালে উঠে চলে যায় ইউনিভার্সিটির বাস ধরতে।
আজ নাসিম কোন টি শার্ট পড়েছে? নাসিম আজ ওকে দেখে কি করবে? আজও কি নাসিম বাস ভর্তি মানুষের ভিড়ের মাঝেও অপলক তাকিয়ে দেখবে ঈমাকে? ভাবনার জগতে এমন কল্পনা ভাঁজতে ভাঁজতে ঠিক সময়ে চলে আসে মোহাম্মদপুরে যাতায়াতকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস আনন্দ।
বিকেলে বাসায় ফিরে গোসল সেরে ভাত খেতে গিয়ে ট্যাংরা মাছের কাঁটা বিঁধে ঈমার। কয়েক নলা সাদা ভাত গিলেও কাঁটাটি সরানো যায় না। বার কয়েক আঙুল দিয়ে খোঁচাখুঁচি করে ঈমা। উঁহু! তাও বেরোচ্ছে না কাঁটাটা। এবার বাথরুমের আয়নায় বড় হা করে ঈমা দেখতে পেল কাঁটাটি তার বাম পাশের টনসিলে আটকে আছে। টিউব লাইটের আলোতে গলায় বেঁধা কাঁটাটি চিকচিক করে উঠল। কেন যেন ঈমার মনে হলো ওর গলায় একটা ধারালো ছুরি আটকে আছে। চিন্তাটা মাথায় আসতেই নিজে ভয়ে শিউরে উঠল। দ্রুত বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঈমা তার ভাবির ঘরের দিকে পা বাড়াল।
ঈমার ভাবি-নিদা তখনো বাসায় ফেরেনি। একটা অ্যাডভারটাইজিং ফার্মে চাকরি করে নিদা। তার শৈশব কেটেছে পাকিস্তানের লাহোর শহরে। বেশ আধুনিক আর অতি মাত্রায় পরিপাটি স্বভাবের অহংকারী নিদার সঙ্গে কথা বলতে ঠিক স্বস্তি বোধ করে না ঈমা। নিদাও পারতপক্ষে ঈমাকে এড়িয়েই চলে। দু–একটা টুকটাক কথা ছাড়া তাদের দুজনের মধ্যে তেমন কথাও হয় না।

লেখিকা
লেখিকা

ঈমার বড় ভাইয়া ইমরান বেশ গম্ভীর প্রকৃতির। মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডেই তার অফিস। একটি বিদেশি বায়িং হাউসে চাকরি করে। চার বছর হয়েছে নিদা আর ইমরানের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু তাদের কোনো সন্তান হয়নি। তাদের এই নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুটা ছন্দের সংযোজন ঘটাতে ঈমার আগমণ। ঈমাকে উচ্চশিক্ষিত করার লক্ষ্যে গ্রাম থেকে শহরে আনা। তাই ভাইয়ের উৎসাহে ঈমা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী।
প্রিয় জানালাটির কাছে এসে দাঁড়ায় ঈমা। ওই বাসার বউটি এখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করছে। লম্বা চুলগুলো তার বারবার দুলছে। চুলের পেছনে ক্লিপ দিয়ে ফুলের মালার দুটো ঝুলিয়ে দিল মহিলাটি। ঈমা ভাবে এটা কোন ফুল দিয়ে গাঁথা মালা হতে পারে! রংটা তো সাদা-ই মনে হচ্ছে! ফুলগুলো আকারে খুব বড়ও নয়। জুঁই ফুল নাকি বকুল? কি জানি? ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। বউটিকে এখন নিশ্চয়ই খুব সুন্দর লাগছে। ওর বর বাড়ি ফিরে নিশ্চয়ই ওকে আজ খুব সোহাগ করবে। ছায়া ছায়া দৃশ্য থেকে ঈমা বুঝে নেবে তাদের সোহাগের কারুকাজ।
ঘড়ির দিকে তাকাল ঈমা। রাত পৌনে আটটা। আরেকটু পরই ভাবি বাসায় ফিরবে। বড় ভাইয়া ইমরান প্রায় রাতেই বেশ দেরি করে বাসায় ফিরে। অফিসে ওভারটাইম, বাইয়ারদের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট আর অর্ডার নেওয়া নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি করে বাসায় ফিরতে ফিরতে ইমরান ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়ে। সমস্ত বাসায় ঈমা আজ একা। কিছুক্ষণ এ ঘর ও ঘর ঘোরাঘুরি শেষে নিজের ঘরে ফিরে এল আবার। টনসিল থেকে মাছের কাঁটাটা বেরিয়েছে বটে কিন্তু তখনো চিনচিনে ব্যথাটা রয়েই গেছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল ঈমার। ঈমা আজ আর পড়তে না বসে ঘুমিয়ে গেল অসময়েই। রাতে খেতে ডেকেও ঈমাকে ওঠানো গেল না। ইমরান নিদাকে ডেকে বলল, থাক, ওকে আর ডেকো না। ক্লান্ত বোধ হয় আজ। ও ঘুমাক।
মধ্যরাতের দিকে অস্বাভাবিক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ঈমার। হাত বাড়িয়ে কী যেন খুঁজল ঈমা। চোখ মেলে দেখল ঘরের বাতি জ্বালানোই আছে। ঘরের দরজাও ভেতর দিক থেকে লাগাতে ভুলে গেছে আজ। ঈমা তার আকস্মিক ঘুম ভাঙার কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না।
টয়লেট সেরে বেরোতেই ঘড়ির দিকে নজর গেল ঈমার। রাত ১২টা ৪৭ মিনিট। এত রাত অবধি ঈমা কখনো জেগে থাকে না। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওই বাসার বউটিকে সাজগোজ করতে দেখেছিল ঈমা। তাই তার কৌতূহল হলো এই মধ্যরাতে ওই জানালার ওপাশের ছায়া দম্পতিরা কি করে তা দেখার। ১৯ বছরের যুবতী ঈমা তার তারুণ্যের স্বভাবজাত ঔৎসুক্য নিয়ে দক্ষিণের সেই জানালাটির কাছে এসে দাঁড়াল।
আবছায়া দৃশ্যে ঈমা দেখল ওই বাসার ছায়া পুরুষটি ঢুলছে। টলোমলো পায়ে ছায়া মহিলাকে কাছে টানতে চাইছে আর মহিলাটি ঘৃনা ভরে বারবার তার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। একটু এগিয়ে লোকটি হ্যাঁচকা টানে মহিলাকে তার কাছে টেনে আনল। তারপর লোকটি তার মহিলার গলা টিপে ধরল। মহিলা দুই হাতে তার গলা থেকে লোকটির হাত দুটি সরানোর চেষ্টা করছে। পারছে না। লোকটি তার মহিলার দেহকে এক টানে ঘুরিয়ে এনে দেয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরল। লোকটি মহিলাকে ঢেকে আছে বলে ঈমা আর মহিলাকে দেখতে পাচ্ছে না। তবে পুরুষ লোকটির দেহ প্রচণ্ড ঝাঁকুনিসহ মহিলার গলায় আরও জোরে চাপ দিচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে বেশ।
জানালার ভারী পর্দাটা এক টানে একপাশে সরিয়ে দিল ঈমা। ভালো করে দেখতে চাচ্ছে, কি হচ্ছে ওই দুই ছায়া চরিত্রের মাঝে। লোকটি এক পাশে সরে যেতেই ছায়া নারীর দেহটি মেঝেতে লুটিয়ে যেতে দেখল ঈমা।
মহিলা কি মরে গেল? নাকি এখনো বেঁচে আছে? টেবিলের সামনের চেয়ারটায় পা দিয়ে টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করল ঈমা। নাহ, দেখা যাচ্ছে না। এবার টেবিলের ওপর পা উঁচু করে দাঁড়াল।
মহিলার নিঃসাড় দেহটি মাটিতে পড়ে আছে। ঈমার সমস্ত শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। সে কল্পনাও করেনি; কখনো এমন দৃশ্য সে চোখে দেখতে পাবে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না, এ দৃশ্য কি সে বাস্তবে দেখছে নাকি দুঃস্বপ্নে!
ঈমা এখন কি করবে? কি করা উচিত তার? ভাইয়া ভাবিকে ডেকে বলবে ওই বাসায় গিয়ে খোঁজ নিতে। জেনে আসতে মহিলা বেঁচে আছে কিনা? নাকি পুলিশকে খবরটা দেবে? পুলিশকে জানালে তো আবার বাসায় পুলিশ আসবে; ঈমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। পুলিশ যখন ওই পুরুষ আর মহিলার বর্ণনা দিতে বলবে; তখন তো ঈমা কিছুই বলতে পারবে না! কারণ ঈমা তো ওই বাসার মানুষগুলোকে স্বচক্ষে দেখেনি কোনো দিন। শুধু দেখেছে তাদের ছায়া অবয়ব। ছায়া-ছায়া মানুষগুলোকে দেখেই ঈমার মমত্ব জেগেছে ওই ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটির জন্য। চরম ঘৃণা ও রাগে ক্ষুব্ধ হয়েছে ওই বাসার ছায়া পুরুষটির ওপর। কষ্ট পেয়েছে ওই ছায়া নারীটির অসহায়ত্বে।
আজ রাতে ঈমা তো কোনো মানুষের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেনি, সে শুধু একটি ছায়া চরিত্রের মৃত্যু দেখেছে। ঈমা শুধু এক ছায়া-মৃত্যুর প্রত্যক্ষ সাক্ষী!

*নিবেদিতা পুণ্যি সঞ্চারিণী: সৌদি আরবের দাম্মামপ্রবাসী।