চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে-দুই

টরন্টো শহরের দৃশ্য। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
টরন্টো শহরের দৃশ্য। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

টরন্টোতে মোজাফফর সাহেবের যে পরিচিতি বলয় ছিল ধীরে ধীরে তিনি তাদের সবার থেকেই কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। হয়তো তার প্রতি অবিরাম করুণা বর্ষণে বিরক্ত হয়েই এ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন। তারপরও দু-চারটা পরিবার নিজেদের থেকে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। তেমনি এক সময় আমার সঙ্গে মোজাফফর সাহেবের পরিচয় হয়। তখন ওনার বড় ছেলেটি গ্রেড এইটে আর ছোট ছেলেটি গ্রেড সিক্সে পড়ত।

টরন্টো শহরের দৃশ্য। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
টরন্টো শহরের দৃশ্য। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

প্রথম দিন অন্যান্য লোকজনদের ভিড়ে বাচ্চা দুটিকে খেয়ালই করিনি। পরে যখন মোজাফফর সাহেবের জীবনের বিয়োগান্ত ঘটনার বিস্তারিত শুনলাম, তখন আমার চোখের পানি সংবরণ করতে পারিনি। ছেলে দুটিকে সেদিন ভালো করে না দেখার জন্য মনে মনে অনেক আফসোস করি।
কয়েক দিন পরেই এক সন্ধ্যায় মোজাফফর সাহেবকে ফোন দিলাম। হ্যালো বলে আমার পরিচয় দিয়ে ভাই কেমন আছেন বলার পর আমার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বেরোচ্ছে না। উনি বেশ কয়েকবার হ্যালো বলার পরে আমি যেন সংবিৎ ফিরে পেলাম। সামনের ছুটির দিনে (উইকএন্ড) সপরিবারে আমাদের বাসায় আসার জন্য তাকে আনুষ্ঠানিক দাওয়াত দিলাম। কিন্তু ওনার কী একটা জরুরি কাজের অজুহাতে আসতে পারবেন না বলে ক্ষমা চেয়ে দাওয়াত কবুল করলেন না। আমি বললাম তা হলে এর পরের ছুটির​ দিন আসেন? উনি পরে জানাবেন বললেন। এর পরপরই ভদ্রতার খাতিরেই হোক আর আন্তরিকতার খাতিরেই হোক উনি বললেন, আপনাদের যদি অসুবিধা না থাকে তা হলে পরের ছুটির দিনে আপনারা আসুন না।
আমি তো মনে মনে এই কথাটি শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। মোজাফফর সাহেবের বলতে দেরি হয়েছে কিন্তু আমার দাওয়াত কবুল করতে দেরি হয়নি। আমি খুব উত্তেজিত হয়ে গিন্নিকে ওনার বাসায় দাওয়াত কবুলের কথা বললাম। মোজাফফর সাহেবের বাসার কথা বলাতে দেখলাম গিন্নির মনটা ভারী হয়ে গেল। আমার বড় মেয়ের বয়স তখন দুই বছর হবে। মাতৃত্ববোধের শাশ্বত অনুভবে তার মাতৃহৃদয় হাহাকার করে ওঠে। গিন্নি আমাকে কিছু না বলে চুপচাপ অন্য কাজে মন দেয়।
যথারীতি আমাদের দাওয়াতের ছুটির দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল। আমি মোজাফফর সাহেবকে দুই দিন আগে ফোন করে স্মরণ করিয়ে দিই আমাদের আসার কথা। উনিও দেখলাম আন্তরিকভাবেই আমরা আসব বলে খুশি হলেন। দাওয়াতে যাওয়ার আগের দিন বিকেলে হঠাৎ গিন্নি এসে বলল, চল গ্রোসারি করতে হবে কিছু। আমি বলি কাল বন্ধের দিন, কালকে করা যাবে। গিন্নি বলল, না আজকেই করতে হবে। ইমার্জেন্সি কিছু বাজার আছে, আজকে না করলেই নয়।
ইমার্জেন্সি বাজারগুলো সাধারণত আমরা কানাডীয় ফুড স্টোরগুলো থেকেই করে থাকি। কিন্তু সেদিন গিন্নি গাড়িতে উঠেই আমাকে বলল বাংলাদেশি গ্রোসারিতে যাওয়ার জন্য। আমি আমাদের কাছের বাংলাদেশি গ্রোসারি স্টোরে নিয়ে গেলাম। সেখানে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম গিন্নি বড় একটা রুই মাছসহ চার-পাঁচ রকমের দেশি মাছের ব্লক (এটা তিনি কখনোই করেন না, এটা আমার ডিপার্টমেন্ট), গরু ও মুরগির মাংসসহ যত ধরনের দেশি সবজি পাওয়া যায় তার সবকটি শপিং কার্টে নিলেন।
গিন্নি আমাকে তখন পর্যন্ত তার প্ল্যান সম্পর্কে কিছুই বলেনি। দেশি মাছের প্রতি তার হঠাৎ আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় আমি মনে মনে বেশ খুশি অনুভব করলাম। বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। গ্রোসারি কিচেনে রেখে আমি একটু রিলাক্সিং মুডে টিভিটা অন করি। একটু পরেই কিচেন থেকে ডাক আসে তাকে সাহায্য করার জন্য। আমি ভাবি হয়তো গ্রোসারিগুলো ফ্রিজে তুলে রাখার জন্য ডাকছে।
এটা কানাডায় সংসার শুরুর প্রথম দিককার কথা। তখনো অতটা কিচেন এক্সপার্ট হয়ে উঠিনি। চুলার আশপাশে যাওয়ার প্র্যাকটিস চলছে কেবল। কিচেনে গিয়ে দেখি সমস্ত কিচেন কাউন্টার জুড়েই মাছ, মাংস আর সবজির ছড়াছড়ি। ঘোরলাগা কণ্ঠে আমি জিজ্ঞেস করি, এগুলো কি এখন রান্না করবে? তখনই গিন্নি তার গোপন ইচ্ছাটি আমার কাছে অবমুক্ত করল। সেদিন অনেক রাত অবধি অনেকগুলো আইটেম রান্না করে পরদিন দুপুরের আগেই মোজাফফর সাহেবের বাসায় গিয়ে হাজির হই। দাওয়াতের নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে যাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মোজাফফর সাহেবকে রান্নার ঝামেলা করতে না দেওয়া। আমাদের অপ্রত্যাশিতভাবে দেখে উনি কিছুটা অবাক হলেও বিরক্ত যে হননি সেটা তার আন্তরিকতা দেখেই বুঝতে পারি।
আমরা ঘরে ঢুকেই দেখি মামুন আর মাসুম—দুই ভাই লিভিং রুমে বসে টিভি গেমস খেলছে। আমাদের দেখে বন্ধ করে দিতে চাইলে আমি বলি না বন্ধ করতে হবে না। আমি তোমাদের খেলা দেখব। ভালো লাগলে হয়তো তোমাদের সঙ্গে খেলতেও পারি। ওরা খেলা কনটিনিউ করতে লাগল। আমি ওদের বুঝতে না দিয়ে খুব কাছ থেকে দুই ভাইকে দেখতে লাগলাম। কয়েক মিনিট পরেই দেখি আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। শত চেষ্টা করেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। তাড়াতাড়ি উঠে ওয়াশ রুমে গিয়ে অনেকক্ষণ চোখে মুখে পানি ঢেলে স্বাভাবিক হয়ে তারপর বেরিয়ে আসি।
এদিকে আমরা সঙ্গে করে এত খাবার দাবার নিয়ে যাওয়াতে মোজাফফর সাহেব পড়ে গেলেন বিরাট অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে। আমরা ওনাকে অনেকটা জোর করে বাধ্য করি রান্নাবান্নার আয়োজন থেকে বিরত থাকতে। সেই যে আসা যাওয়ার শুরু তারপর থেকে প্রতি মাসে অন্তত একবার ওনার বাসায় যাওয়া হতো। আর ফোনে তো কথা হতো প্রায় প্রতিদিনই বলা চলে। আমাদের বাসায় যখনই কোনো অনুষ্ঠান কিংবা পার্টি হতো মোজাফফর সাহেব আর তার ছেলেরা হতো আমাদের মাস্ট গেস্ট।
এমনি করে সময়ের হাত ধরে কালের বিবর্তনে দেখতে দেখতে ছেলে দুটি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ইউনিভার্সিটিও শেষ করে ফেলে। স্কুলে পড়াকালে মোজাফফর সাহেব ছেলেদের প্রতিটি অনুষ্ঠানে খুব আগ্রহ নিয়ে উপস্থিত থাকতেন ও তাদের ছবি তুলতেন। এভাবে বিভিন্ন সময়ে ছেলেদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ছবি তুলে বিশাল পুরু এক অ্যালবাম করে ফেলেন। তার পাশাপাশি ছোটবেলায় প্রতিবছর স্কুলে করা বাবা দিবসে ছেলেদের হাতের ছাপ, পায়ের ছাপ আর ড্রয়িং এগুলো খুব যত্ন করে রেখে রেখে একটি বাইন্ডিং খাতা ভরে ফেলেন। মাঝে মাঝেই এগুলো খুলে বসেন আর ফেলে আসা স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। সেই ছোট্ট ছেলেরা এখন পড়াশোনা শেষ করার পর যার যার ফিল্ডে জব করে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। মোজাফফর সাহেব মনে মনে ছেলেদের বিয়ে করানোর কথা ভাবছেন। স্থানীয়ভাবে যেহেতু কোনো মেয়ের সন্ধান পাচ্ছেন না তাই দুই ছেলেকে দেশে নিয়ে গিয়ে একসঙ্গে বিয়ের ঝামেলা সেরে ফেলতে চান। তার আগে অবশ্য ছেলেদেরকে আলাদা আলাদা করে ডেকে নিয়ে তাদের পছন্দের কেউ আছে কিনা জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলেন। এমনি করে মোজাফফর সাহেবের সংসারটি যখন সুখের চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যাচ্ছিল ঠিক তখনই একটি ঘটনা মোজাফফর সাহেবের হৃদয়ে পুরোনো সেই ক্ষত দগদগে ঘা হয়ে ফিরে আসে।
ছেলেরা এখন বড় হয়েছে। তাদের নিজস্ব ভুবন তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে নিজস্ব প্রাইভেসির ব্যাপারেও যথেষ্ট সচেতনতা বোধ হয়েছে। কিন্তু বাবার মন কি এত কিছু নিয়ম নীতি মেনে চলতে পারে? মোজাফফর সাহেবের কাছে তার ছেলেরা এখনো সেই ছোট্টটিই যেন রয়ে গেছে। মনে হবেই বা না কেন? তিনি তো ছেলে দুটিকে একাধারে বাবার আদর আর মায়ের স্নেহ দিয়ে প্রতি মুহূর্ত কাছে রেখে আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। এরাই তো হলো ওনার শরীর মন আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ একেবারে।
যা হোক, যে ঘটনাটি মোজাফফর সাহেবের মনকে দুর্বার ঘূর্ণিপাকে ফেলে দিয়েছিল, সেটি হচ্ছে কোনো একদিন দুপুরবেলায় মোজাফফর সাহেব ভুল করে বড় ছেলের রুমে দরজা নক না করে ঢুকে পড়েছিলেন। ছেলেটি তখন কাপড় চেঞ্জ করছিল। বাবার এই অসাবধানতায় ছেলেটি ব্যক্তিগত প্রাইভেসি নিয়ে বিরক্ত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বাবার অদূরদর্শী প্রাইভেসি ইনভেশনে কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে। সে তার বাবাকে বলে বাবা তুমি রুমে ঢোকার আগে নক করবে না?
হতভম্ব মোজাফফর সাহেবের চোখ মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে নিশ্চল মূর্তির মতো হয়ে যায়। সরি বাবা বলে তিনি নীরবে সেখান থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে আসেন। আলমারি থেকে অনেক দিন আগের সযত্নে সংরক্ষণ করা একটি মোটা ফাইল বের করে আনেন। ঝাপসা চোখে কিছুক্ষণ ফাইলটির ভেতরের কাগজগুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে ধীর পায়ে বড় ছেলের রুমের দরজায় নক করেন। ছেলে কিছুটা অবাক হয়ে দরজা খুললে মোজাফফর সাহেব ভেতরে ঢুকে তার খাটে গিয়ে বসেন। কোমল স্বরে ছেলেকে ডেকে পাশে বসান। এরপর তিনি খাতাটি ছেলের সামনে মেলে ধরে বলেন, বাবা দেখ তো এই ছবিগুলো ও হাতের-পায়ের এই ছাপগুলো চিনতে পার কিনা?
ছেলেটি সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মোজাফফর সাহেবের গণ্ড বেয়ে শ্রাবণের ধারা বইছে তখন। তিনি বললেন, বাবা তোমার স্কুলের প্রথম দিন থেকে তোমার যাবতীয় কর্মকাণ্ড আমি একটা একটা করে জমিয়ে রেখেছি। তোমাদের দুই ভাইকে আমি বাবা ও মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা ও গাইড দিয়ে তিল তিল করে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। তুমি তো বাবা কখনো আমার কাছে সেই ছোট্টটি থেকে বড় হয়েছ বলে মনে হয়নি। তুমি যখন স্কুল থেকে তোমার হাতের ছাপ আর পায়ের ছাপ নিয়ে এসে আমাকে দেখাতে আমি তখন তোমাকে আমার কাঁধে নিয়ে সারা ঘর ঘুরতাম আর সুর করে বলতাম, আমার বাবা স্কুলে যায়, বাবার কাঁধে দোল খায়। সে সব দিনের কথা কি মনে পরে তোমার বাবা? যখন প্রতিদিন তোমাদের দুই ভাইকে গোসল করিয়ে লোশন মেখে ফ্রেশ কাপড় পরিয়ে দিতাম, তারপর তোমাদের দুই ভাইকে এক প্লেটে ভাত মেখে ডিনার করাতাম ও বিছানায় নিয়ে গিয়ে আমার দুই পাশে শোয়াতাম? আমার কাছে কিন্তু মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। তুমি এখনো আমার কাছে ঠিক সেরকমটিই রয়ে গেছো বাবা। আমি জানি তুমি এখন বড় হয়েছ, তোমার একটা নিজস্ব ভুবন আছে। সেখানে প্রাইভেসি একটা বড় কনসার্ন। কিন্তু আমার এত দিনের অভ্যাস হঠাৎ কী করে বদলে ফেলি বাবা?
এ কথা বলেই তিনি তার রুমে চলে গেলেন। সেদিন সন্ধ্যায় ডিনারের টেবিলে দুই ছেলেকে বললেন, তিনি দেশে যাচ্ছেন কিছুদিনের জন্য। তখনই বড় ছেলে তার সারা দিনের আত্মগ্লানি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার লক্ষ্যে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা করে দেবার আকুতিতে পরিবেশ ভারী করে তোলে। অশ্রুধারায় বাবাকে দীর্ঘ আলিঙ্গনের দৃশ্য ছোট ছেলে অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করে নিজের খাওয়া ভুলে।
মোজাফফর সাহেবের ইচ্ছাতেই টরন্টোর কাছে একই রাস্তায় কয়েক বাড়ির দূরত্বে দুই ভাই দুই বাড়ি করে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে তাদের বাবাকে যৌথ সম্পত্তি করে পরম সুখে বসবাস করছে। মোজাফফর সাহেবের এক পরিবার থেকে এখন আমরা ওনার দুই পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। (শেষ)

(লেখকের ইমেইল: [email protected])
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন:-
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে