চেতনায় একুশ: অভিভাবকহীন আমাদের মাতৃভাষা?

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
ছবি: হাসান রাজা

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি! ফেব্রুয়ারিকে ভাষার মাস বলা মানেই বাকি মাসগুলোয় ভাষা নিয়ে না ভাবলেও চলে। ফেব্রুয়ারি এলে মায়াকান্নাটা একটু নড়েচড়ে বসে। ভাষার জন্য নিভৃতে থাকা ভালোবাসা ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে। জাতি হিসেবে আমরা একটু আবেগপ্রবণ বৈকি! এই আবেগ থেকেই প্রেমের উৎসারণ আর প্রেমই দেয় বিপ্লবের জন্ম। পৃথিবীতে বিপ্লব ছাড়া গণমানুষের কোনো অধিকার অর্জিত হয়নি। প্রেম ছাড়া কোনো বিপ্লবও সংঘটিত হয়নি। আমাদের ভাষার অধিকারও তেমনই প্রেমবিপ্লবের ফসল। সুতরাং এক–আধটু আবেগ খুব মন্দ কিছু নয়, সে কথা বলাই যায়।

সভ্যতার মূল উপাদানগুলোর মধ্যে ভাষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যার মাধ্যমে মানবসমাজ যোগাযোগ করে এবং স্বকীয়তায় পরিচিত হয় বিশ্বদরবারে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের জাতিসত্তার লড়াই। সেই লড়াইয়ের ফলে কেবল মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারই অর্জিত হয়নি, আমরা পেয়েছিলাম চেতনার গূঢ় অন্ধকার থেকে মুক্তির দিশা। সাংস্কৃতিক চেতনার সেই সুপ্ত বীজই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে আমাদের জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বিশ্বের বুকে এক নতুন জাতির অভ্যুদয় হয়েছিল।

সুতরাং, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, সাংস্কৃতিক বিকাশে একুশে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব অনবদ্য। চেতনার মানসপটে একুশকে ধারণ করে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গন হয়েছে উত্তরোত্তর ঋদ্ধ। চলচ্চিত্র, নাটক, উপন্যাস, গল্প, কবিতায় ভাষা আন্দোলনের যে প্রেক্ষাপট, যে ইতিহাসের প্রচ্ছায়া অবলোকন করি, তা একাধারে যেমন আমাদের জাতীয় জীবনের ইতিহাসকে ধারণ করে, তেমনি সমৃদ্ধ লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যের কথা বলে।

বাংলা আজ বিশ্বের প্রায় ২৪ কোটি মানুষের মাতৃভাষা। ব্যবহারকারী হিসাবে বাংলা বিশ্বের পঞ্চম ভাষা। আমাদের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট সীমানা পেরিয়ে আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ভূষিত হয়েছে এক অনন্য মর্যাদায়। এ মুহূর্তে পৃথিবীর ৩০টি দেশের অন্তত ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু রয়েছে। যেখানে বাংলা ভাষা পাঠদানসহ চলে গবেষণার কাজ। বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে সিয়েরা লিওন। আব্দুল গাফ্‌ফার চৌধুরী রচিত সেই বিখ্যাত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি ১২টি ভাষায় অনূদিত হয়ে গাওয়া হচ্ছে ভাষা দিবসের স্মরণে।

কিন্তু এত সব অর্জনের সবটুকু ম্লান হয়ে যায়, যখন বাস্তবতা এমন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও শুদ্ধ বাংলা লিখতে ও বলতে আমাদের অজ্ঞতা চোখে পড়ে। এই অজ্ঞতার পেছনে প্রথম ও প্রধান কারণ হলো অবহেলা। ব্যক্তি থেকে সমাজ, জাতি এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় অবহেলায় আজ আমাদের ভাষা হারিয়েছে তার অভিভাবক। ভাষাবিপ্লবের ৭০ বছর পরও আমাদের ভাষা শিক্ষার জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া, পদ্ধতি ও কৌশল বর্ণিত হয়নি আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমে। আমাদের মুখস্থবিদ্যাসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষাও শেখানো হয় মুখস্থ করে। শৈশবে আমাদের যেসব শিক্ষকের কাছে সরল বর্ণপরিচয়ের সহজ পাঠ শুরু হয়, দুর্ভাগ্যবশত তাঁদের অনেকেই সঠিক উচ্চারণ জানেন না, জানেন না শব্দের সঠিক বানান। এ কারণে আমাদের শিখন–শিক্ষণের প্রক্রিয়াটি একটি চক্রের মধ্যে ভুলাবর্তে ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ শিক্ষকেরাও অশুদ্ধ উচ্চারণ কিংবা ভুল বানান শিখেই শিক্ষক হয়েছেন। আমাদের শিক্ষকেরা নিজেরাই যখন জানেন না ভাষা শেখার সহজতর কলাকৌশল, তাঁরা কীভাবে শেখাবেন শিশুদের?

১৯৮৭ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রচলন আইন প্রণীত হওয়ার ফলে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি সব দাপ্তরিক কাজকর্ম বাংলাতেই সম্পন্ন হয়। তবে লজ্জাজনকভাবে সত্য, সরকারি দপ্তরের যেকোনো নথি, পত্র, প্রজ্ঞাপন কিংবা দলিল–দস্তাবেজ ঘাঁটলে নির্ভুল শব্দচয়ন খুঁজে পেতে যথেষ্ট সংকটে পড়তে হয়।

সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের কথা বলা থাকলেও শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারের কথা বলা হয়নি অথবা অশুদ্ধ লেখার ফলে কেউ দণ্ডপ্রাপ্তও হচ্ছে না। এ কারণে যেনতেনভাবেই বাংলা লেখা হচ্ছে হরদম; আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক, সব ক্ষেত্রে। এই অশুদ্ধ বাংলা ব্যবহারের জন্য আমাদের লজ্জাবোধ নেই কোনো। এর অন্তরালে সেই একটি কারণই নিহিত, বাংলা আমাদের জীবনে খানিকটা আটপৌরে যোগাযোগের হাতিয়ার বৈ কিছু নয়।
সমাজে এই আটপৌরে ভাষার মর্যাদা কম। উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে গেলে বাংলা নয়, মোটা মোটা ইংরেজি বইই পড়তে হয়। তাই আমাদের নিজেদের তথা সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষার প্রতি অশেষ গুরুত্ব দিতে হয়। নইলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই রূঢ় কঠিন সত্যের একটি বিপরীত সত্যও আছে; যদিও দিনে দিনে আমরা সেই সত্য থেকে ক্রমে দূরেই সরে যাচ্ছি।

আমাদের এতটাই দুর্ভাগ্য, ইংরেজি শব্দ সংযোজন ছাড়া আমরা শুধু বাংলা শব্দে একটি সম্পূর্ণ বাক্য বলতে পারি না। বাংলার নিজস্ব শব্দভান্ডার যত্সামান্য হলেও ‘প্রচলিত বাংলা’ বিশ্বের অনেক ভাষার থেকে সমৃদ্ধ ও শ্রুতিমধুর। তা সত্ত্বেও ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে বাক্যটিকে ওজনদার বানানোর মাহাত্ম্যে লিপ্ত হই আমরা। বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিলিয়ে (বাংলা + ইংরেজি) ‘বাংরেজিতে’ কথা বলার এই প্রবণতার বাইরে আমাদের সমাজে ‘ক অক্ষর গোমাংস থেকে উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তিদের কেউই আছেন বলে সন্দেহ হয়। বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে ইংরেজি যেমন জানতেই হবে, তেমনি ইংরেজির সঙ্গে মাতৃভাষা শুদ্ধ চর্চায় কোনো বিরোধ নেই।

আজকাল সাহিত্য রচনায়ও ব্যাপকভাবে ‘বাংরেজির’ ব্যবহার বেড়েছে। গল্প কিংবা চরিত্রের প্রয়োজনে ইংরেজি ব্যবহার অযৌক্তিক নয়। তবে যখন অনাহূতভাবে কথ্য (বাংলা + ইংরেজি) ইংরেজি ব্যবহার দেখা যায়, তখন আমাদের দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়। কেবল বাঙালি ছাড়া পৃথিবীতে সম্ভবত আর কোনো জাতি নেই, যারা এহেন জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলে।

ভাষার প্রতি অতি অবহেলা কিংবা ঔদাসীন্যের ফসল হিসেবেই আমাদের লেখ্য ভাষায় শুদ্ধ চর্চা অনুপস্থিত। কথ্য ভাষায়ও আমরা নানামুখী বিকৃতিতে রসানন্দ পাই। আজকাল আরেক নতুন শ্রেণির জন্ম হয়েছে, যাঁরা প্রমিত ও আঞ্চলিক—এই দুইয়ের মাঝামাঝি একধরনের লেখ্য ভাষার আবিষ্কার করেছেন এবং সামাজিক মাধ্যমে যার ছড়াছড়ি অহরহই দেখা যায়। যেমন খাইসি (খেয়েছি), কইসি (বলেছি), আইসি (এসেছি) ...। এ–জাতীয় শব্দের উচ্চারণ বিকৃতকারীদেরকে ‘ভাষাসন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিলে মন্দ কিছু হবে না বোধ করি।

এ কথা সত্য যে যুগে যুগে প্রাকৃতজনদের প্রয়োজনে সময়ের হাত ধরে ভাষা বদলেছে তার বাঁক, গঠনপ্রকৃতি ও ব্যবহারের রীতি। তবে আজকের প্রজন্মের কাছে খেয়েছি, বলেছির স্থলে কেন এই ‘খাইসি-কইসি’–জাতীয় উদ্ভট বানানোচ্চারণ সহজতর মনে হয়েছে, তা আমার বোধগম্য নয়। উপরন্তু খুব শঙ্কা হচ্ছে, একদিন সত্যি সত্যিই এই বিকৃত শব্দগুলো বাংলায় প্রমিত হিসেবে গৃহীত হয়ে যাবে!

সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, এই দৈন্যের দায় কার? এ প্রশ্নের সরল উত্তর—রাষ্ট্রের। একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা যদি বাংলা হয়, দাপ্তরিক যাবতীয় কার্যক্রম যদি বাংলায় পরিচালিত হয়, তবে সেই ভাষার শুদ্ধ চর্চায় কেন জনসাধারণ এতটা উদাসীন হবে? কেন শিক্ষাক্রমেই শুদ্ধ চর্চার ওপর জোর দেওয়া হবে না? ইংরেজি ভাষা শেখার বিষয়ে আমাদের শিক্ষায়তনে অতি গুরুত্বের সঙ্গে বানান মুখস্থ করানো হয়। ভুল ব্যাকরণ, ভুল বানানে ইংরেজি লেখার কোনো সুযোগ নেই। অপর পক্ষে, বাংলায় হাজারটা ভুল বানানও গৃহীত হয় সানন্দে। বাংলা অনেকটা ডালভাত! এক–আধটু ভুলে ক্ষতি কী!
আমাদের মাথার ওপরে বাংলা একাডেমি দাঁড়িয়ে থাকলেও শুদ্ধ ভাষাচর্চা, ভাষা গবেষণা এবং এর তদারকের যতটুকু দায় নেওয়ার কথা ছিল, এ প্রতিষ্ঠানের তার কতটুকু সফল হয়েছে, সেই প্রশ্ন ওঠাও অস্বাভাবিক নয়। যদিও বানান সরলীকরণের জন্য যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে বাংলা একাডেমি, তবু বাংলা একাডেমি প্রণীত অভিধানের বানান বিষয়েও যথেষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে এর আগে। এখানেও কি দক্ষতার ঘাটতি, নাকি মাতৃভাষার প্রতি দায়বদ্ধতাহীন ঔদাসীন্যই মূল ঘাতক, সে প্রশ্ন রেখে গেলাম পাঠকের দরবারে।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, করপোরেট বাণিজ্যের তলায় আমাদের একুশের চেতনার মূল সুর ঢাকা পড়ে গেছে। ভাষাশহীদদের জন্য আমাদের প্রেমাবেগ বিক্রি হয়ে গেছে বর্ণমালাখচিত শাড়ি-পাঞ্জাবি আর ফতুয়ায়। প্রভাতফেরিতে মনোরম সাজে অংশগ্রহণ করেই আমাদের একুশের সকাল শুরু হয়। আর এই দিনটি শেষ হয়ে গেলেই ভাষাশহীদদের প্রতি আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায়।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে নানা ক্ষেত্রে। বিশ্ববাজারে আজ একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হয়েছে। অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জাতিগত সংস্কৃতি, ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস-ঐতিহ্যকেও বিশ্বদরবারে নিজস্ব মানদণ্ডে হাজির করবার সময় এসেছে। আজ যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনায় বিশ্ববাসী উজ্জীবিত, তখন বাঙালির কাছেই সমাদর হারাচ্ছে বাংলা ভাষা! এ বেদনা আপনার-আমার, সবার।

তরুণ প্রজন্মের কাছে আমাদের ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরা এখন সময়ের দাবি। শুধু সাদাকালো পোশাকে একুশ পালন করে মাতৃভাষার প্রতি প্রেম জাগ্রত হয় না; পাঠ্যক্রমে ভাষাবিপ্লব, ভাষাসৈনিকদের জীবন ও অবদান সম্বন্ধে বয়সানুযায়ী রচনা সন্নিবেশিত হওয়া জরুরি। সরল ব্যাকরণ, শুদ্ধ উচ্চারণ বিষয়েও পাঠ্যক্রমে বিষয় সংযুক্ত হতে হবে। সরকারি ছুটি থাকলেও একুশে ফেব্রুয়ারিতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রেখে নানামুখী কার্যক্রমের মাধ্যমে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় উদ্‌যাপন করা উচিত, যাতে শৈশবেই ভাষা শিক্ষা তথা এই দিবসের গুরুত্ব অনুধাবনে শিশুমন আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল হতে পারে।

একুশের সঠিক ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে হবে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতে হবে। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হলে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে। যে জাতি নিজের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, তাদের দেশের প্রতিও প্রেম থাকার কথা নয়।

তাই আসুন, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে একুশের চেতনা ছড়িয়ে দিতে আমরাও শুদ্ধ বাংলার চর্চা করি। রোধ করি ভাষাদূষণ। ভাষাসন্ত্রাসের হাত থেকে মুক্ত করি একুশের চেতনার মূল সুর।

*লেখক: সঙ্গীতা ইয়াসমিন, প্রবাসী লেখক, টরন্টো, কানাডা