চুড়ি চুরি

বাটি চালান হবে। আজমল হক-বিলকিস দম্পতি যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়ির গলিতে কিছুটা ভিড়। একটু হট্টগোলও শোনা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ছে। তাদের মধ্যে অতি বৃদ্ধ এক ভিক্ষুকও উঁকিঝুঁকি মারছে। মরিয়মের মা এই বাটি চালানের উদ্যোক্তা। সকাল থেকে খুঁজে খুঁজে তুলা রাশির জাতক সোহাগকে ধরে নিয়ে এসেছে। তুলা রাশি ছাড়া কেউ বাটি চালান দিতে পারে না। সে থাকে রামপুরা বস্তিতে। বয়স এগারো। পার্টটাইম টেম্পো হেলপার। পার্টটাইম স্কুল। ক্লাস ফোরে পড়ে। সোহাগের মা বাটি চালানের জন্য প্রথমে ছেলেকে দিতে রাজি হয়নি। যদিও সেদিন তার খেপ ছিল না। তবে দর-কষাকষিতে পোষায়নি।
তার কথায়—‘এত কম রেটে পোলারে কি বেইচা দিমু। পুরা ঢাকা শহর ঘোরলেও সোহাগের রাশির কেউ পাইবা না।’ শেষমেশ মরিয়মের মা জোরাজুরি করাতে রাজি হয়। চোর ধরা পড়লে সোহাগ পাবে দু শ। আর ধরা না পড়লে পঞ্চাশ। ধরা পড়া না পড়ার ওপর রেট।
ঘটনা হচ্ছে আজমল হকের নতুন বউ বিলকিসকে নিয়ে। কষ্ট করে টাকা জমিয়ে বেচারা বউয়ের জন্য ইমিটেশনের দুটি চুড়ি কিনে এনেছিল। নকল স্বর্ণ হলেও দাম প্রায় দেড় হাজারের মতো। সেই দুটি চুড়ির মধ্যে একটা গায়েব। এত দিন যত্ন করে সাদা রুমালের ভেতর কাঠের আলমারিতে তুলে রেখেছিল। আজ সকালে গোসলে যাওয়ার আগে একটু বের করে। দোতলায় জানলার পাশে টেবিলের ওপর রেখে সে গোসলে যায়। এসে দেখে একটা হাওয়া। জানালার ওপাশে নারিকেল গাছ ছাড়া বারান্দা বা অন্য কিছুই ঘরের নাগালের মধ্যে নেই। সুতরাং জিনিসটাকে কেউ ঘরের মধ্যে এসে নিয়ে গেছে।
মাত্র দুই মাস হয় বিলকিস এই বাড়িতে এসে উঠেছে। বিয়ের পরেই এখানে আসা। তার স্বামী আজমল হক আগে থেকেই এখানে থাকত। ভাড়া মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার। গার্মেন্টসে চাকরি করে এর চাইতে বেশি ভাড়া বাসা নেওয়া তার সাধ্যের বাইরে। বাড়ি বলতে দোতলায় অনেকগুলো ছোট ছোট রুমের একটা। লম্বাটে স্কুল ঘরের মতো। এক পাশে চারটা কক্ষ। অন্যপাশে ভাড়াটিয়াদের কমন বাথরুম আর রান্নাঘর।
এই দুই মাসে বিলকিসের সঙ্গে সবচে বেশি ভাব হয়েছে পাশের ভাড়াটিয়া তামান্নার সঙ্গে। তামান্নার বয়স নয় বছর। রামপুরায় আদর্শ মা স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ে। তার বাবা আরেক স্ত্রীর সঙ্গে থাকে। কেউ তাকে বাবা কোথায় জিজ্ঞেস করলে খুব স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়, আমার বাবায় জিন্দামরা।
বিলকিস আগে জিন্দা মরার মানে বুঝত না। সে জানত যে পির-ফকিরেরাই নাকি জিন্দামরা হয়। কিন্তু মরিয়মের মা তাকে একদিন ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, জিন্দা মরার মানে হইল যেই ব্যাডা আগের বউরে রাইখ্যা সতিনরে লইয়া ঘর করে। আগের বউ তক্ষন হেরে জিন্দামরা কয়। মানে হইল গিয়া বাঁইচ্যা থাইক্ক্যাও মরা।
তামান্নার জিন্দামরা বাপ ঢাকা-সিলেট রুটে বাস চালায়। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে থাকে গেন্ডারিয়ায়। তামান্নার মা হোটেল খাবার রান্না করে সংসার চালায়। বিলকিস আর তামান্নার অনেক মিল। বয়সের পার্থক্য থাকলেও দুজনের বোঝাপড়া বেশ ভালো। নায়িকা পরী মনি, নায়ক শাকিব খান, শাহরুখ খান থেকে শুরু করে টেলিভিশনের নাটক-সিনেমা সব নায়ক-নায়িকার খবরই ওদের আছে।
চুড়ি হারানোর প্রথম ও একমাত্র সন্দেহের তীর গেল তামান্নার দিকে। কারণ সেদিন তামান্না স্কুলে যায়নি। সকালে চিনি ধার নিতে সে বিলকিসের রুমে ঢুকেছিল। তার মা পাঠিয়েছিল নিজের চায়ের জন্য। তবে সন্দেহের প্রদীপে আরও আগুন জ্বালিয়েছে মরিয়মেরে মা। সে পাশের ভাড়াটিয়া ও চুড়ি চুরির খবর প্রচারক। তার সঙ্গে আবার তামান্নার মায়ের বনিবনা হয় না। প্রায়ই ঝগড়া লাগে। বিষয় গোসলখানা আর রান্না করার সময় ভাগাভাগি নিয়ে। ঝগড়া শুরু হলে মরিয়মের মা উচ্চ স্বরে অনর্গল বাংলায় গালি দেয়। সেই গালির প্রায় সবগুলোই বিলকিসের কানে আসে। কিন্তু অনেক কিছুর অর্থই সে বোঝে না। একবার ‘বেগুন মাগি’ বলে গালি দিয়েছিল। বিলকিস অনেক চিন্তা করেও এর মানে খুঁজে পায়নি। পরে তামান্নার কাছ থেকে এর মানে জেনে নিয়েছিল। মরিয়মের মার দাবি, রুমে যে ঢুকসে হেই তো চুরি করছে। ভূতে আইস্যা তো নিয়া যায় নাই।
আজমল হকের ভাড়া বাড়িটি অনেক পুরোনো। বর্ণহীন, চাঁচাছোলা ফলের মতো। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে নতুন করে বানাবার জন্য বাড়িটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। আসলেই ওটাই আসল রূপ। একপাশে গলি। বিলকিস যে রুমটিতে থাকে তার পাশেই বাঁকা হয়ে উঠে যাওয়া দুটো নারকেল গাছ। সেই গাছে মোট পাঁচটি কাকের বাসা। সময়ে অসময়ে কা-কা করে। শুনতে বিলকিসের ভালো লাগে। মানুষ অন্য সব পাখি এত পছন্দ করে কিন্তু কাক বেশ অবহেলিত। অথচ দেশে কাকের সংখ্যাই বেশি। দোয়েল দেশের জাতীয় পাখি কিন্তু তাকে তো দেখাই যায় না। কাক কেন জাতীয় পাখি হলো না। এই বিষয়টা ভাবতে তার খুব খারাপ লাগে। গায়ের রং কালো বলেই কী এত দোষ। কাকের কথা ভাবতে গিয়ে বিলকিসের ল্যাংড়া কাকের কথা মনে হয়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে প্রায়ই সে কাকটাকে দেখে। গাছের একটা নির্দিষ্ট ডালে এক পায়ে দাঁড়িয়ে দুলতে থাকে। বা হাঁটুর নিচ থেকে বাকি অংশ খালি। ডালে বসতে গেলে প্রথমে একটু ঢেউয়ের মতো ঝাঁকুনি খায়। দুই পাওলা কাকদের মতো কখনো স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না। বাতাস হলে ডানা প্রশস্ত করে ব্যালেন্স করে।
তামান্নার মা দুপুরের দিকে হোটেলের কাজ সেরে বাসার গলিতে ঢুকতেই দেখে হুলুস্থল কাণ্ড। বাটি চালক সোহাগকে তখন রীতিমতো বাটিই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। নিচের গেট থেকে শুরু হয়ে তখন সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিল। উপুড় হয়ে দুই হাতে শক্ত করে পিতলের বাটি ধরে আছে। বাটি সিঁড়ি ভেঙে খুবই ধীর গতিতে ওপরে উঠছে। দেখে মনে হবে বাটি তাকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। শরীরের সমস্ত ভর তার বাটির ওপর। সোহাগের পেছন পেছন মরিয়মের মা, বাটি চালানোর ফকির ও আরও দশ-বারো জন দর্শক। তামান্না ভয়ে নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল। তার কোনো ধারণাও ছিল না যে বাটি তাকে খুঁজে পাবে। সোহাগের হাতে ধরা বাটি। সিঁড়ি ভেঙে আরও একটা রুম পার হয়ে তার হাত এসে থামল তামান্নার বন্ধ দরজায়। ফকির অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল যদি বাটি তার রুট পরিবর্তন করে কিংবা আরও অগ্রসর হয়। কিন্তু তা আর হলো না। সোহাগও উপুড় হয়ে থাকতে না পেরে বাটি ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল।
শেষমেশ মরিয়মের মা ঘোষণা করল, বাটি চোর খুঁইজা পাইসে। আমি আগেই কইছিলাম, হোটেলে কাম করা মাগীর ঘরে চোর হইব না তো মুয়াজ্জিন হইব?
তামান্নার মা নিজের ঘরের দরজায় জটলা দেখে ক্ষেপে গেল। সুযোগ বুঝে মরিয়মের মা গালি আর অকথ্য ভাষায় ঘটনার সারমর্ম তামান্নার মাকে বোঝাল। তামান্নার মা ঘটনা কতটুকু বুঝল তা বোঝা গেল না। তবে লোকজনকে তাড়িয়ে দিল। তার নিজের গালিও খুব যে একটা ভদ্র সমাজে জুতসই তাও না। তবে মরিয়মের মায়ের ধারে কাছেও না। দুজনের মধ্যে গালিগালাজ চলল কিছুক্ষণ। দুজনের স্বামীই জিন্দামরা। পরস্পর গালিগালাজে এই বিষয়টাও বেশ প্রাধান্য পেল। কে, কবে, কতবার, কোন ভাতারের ভাত খেয়েছে, তাদের কপালে কেন আর ভাতার জুটবে না এই সব বিষয়াদি।
পরিস্থিতি একটু হালকা হলে তামান্নার মা রুমে ঢুকে সিটকিনি দিল। পর মুহূর্তেই তামান্নার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। প্রথমত চুড়ি চুরির ঘটনা আর দ্বিতীয়ত মরিয়মের মায়ের ওপর আক্রোশের বলি হলো তামান্না। যদিও চুরির ব্যাপারে নিজের মেয়ের ওপর তার আস্থা আছে। কিন্তু তাতে কী? লোকলজ্জা ও সমজের প্রয়োজনে অনেক কিছুই বলি দিতে হয়। কাউকে না কাউকে তো ভিকটিম হতে হয়। এটাই নিয়ম। মানুষও অনিচ্ছায় এসব নিয়ম মেনে নিয়েছে। যুগে যুগে দেশে দেশে। তা না হলে এতগুলো মানুষ বাটি চালান দেখতে এল। কই, কেউ তো বন্ধ বা অন্য কিছু হওয়ার সন্দেহ করে প্রশ্ন করল না। বিলকিস বেশ কয়েকবার বাধা দিতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু কে শোনে কার কথা। সন্দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা পীড়াদায়ক।
আকাশ কালো করে সেই রাতে ঝড় শুরু হলো। পুরো শহর জুড়ে অন্ধকারে। বিলকিস অন্ধকারে খাটের ওপর গুটিসুটি মেরে বসে আছে। তার স্বামীর গার্মেন্টসে সারা রাত ডিউটি। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই বিদ্যুতের আলোয় জানালার বাইরে সে আচমকা ল্যাংড়া কাকটাকে দেখতে পায়। সেই ডালে বসে ঝড়ের সঙ্গে দুলছে। থেমে থেমে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। যখন বাতাসের শব্দ থামে তখন তামান্নার কুঁ কুঁ কান্নার শব্দ কানে আসে। কাক আর তামান্নার জন্য তার খুব দুঃখ হয়। চুড়ির জন্য তার কোনোই দুঃখ নাই। সে জানে তার স্বামী খুব বুঝবান। কোনো কিছুতেই তার রাগ নাই। খাটে বসে ভাবছিল চুড়ি হারানোর ঘটনাটা সে কীভাবে স্বামীকে জানাবে। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল সত্যি কথাটাই বলবে। সত্যই সুন্দর, সত্যই স্রষ্টা। সত্যম শিভাম সুন্দরম। এই হিন্দি ছবিটা ছোটবেলায় সে দেখেছিল। অনেক কিছুই বুঝে নাই কিন্তু তাও ওই পোড়ামুখী নায়িকার জন্য অনেক খারাপ লেগেছে। মনে মনে মনে বলে দুনিয়াতে সত্যের চাইতে সুন্দর কিছুই নাই। দুই দিনের দুনিয়াতে এত কিছু দিয়া কি হইব। সে স্বামীকে বলবে আপনের দেওয়া দুইটা চুড়ির একটা হারায়ে গেছে। কেমনে গেছে তা বলতে পারব না। তয় আমার কোনো দুঃখ নাই। সকালে কাজ থেকে বাসায় আসলে সে মজা করে গরম খিচুড়ি বানিয়ে তাকে খাওয়াবে। তারপর সে ঘুম দিয়ে বিকেল যখন উঠবে তখন চুরির কথাটা পাড়বে। এই সব সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
খুব ভোরে বিলকিসের ঘুম ভাঙল। ঝড়ের বালাই নেই। সবকিছুই শান্ত ও স্বাভাবিক। যেন ফেলে যাওয়া রাতে কিছুই হয়নি। তখনো শহর, মানুষজন পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। কী মনে করে বিলকিসের ল্যাংড়া কাকের কথা মনে হলো। সে ধীরে ধীরে দরজা খুলে সিঁড়ি ভেঙে নারকেল গাছটার নিচে গেল। রাতের ঝড়ে বেশ কয়েকটা মরা ডাল এদিক-ওদিক পড়ে আছে। একটা ডাল পার হতেই দেখল ঝড়ে ভাঙা একটা কাকের বাসা। তার পাশেই ল্যাংড়া কাকটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বিলকিস অপলক দৃষ্টিতে ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। দেখতে পেল তার হারানো চুড়ি কাকের ভাঙা বাসায়। নতুন দিনের আলো ফুটবার আগেই সে চুড়ি আর চোরকে খুঁজে পেল।
...
জামাল সৈয়দ: মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: <[email protected]>