চুলা, প্লেন ও একটি পরকীয়া

ট্রেন, বাস বা প্লেন ধরতে শেষ সময়ে যাওয়াটা কাওসারের অভ্যাস। বেশি আগে গিয়ে বসে থাকলে নিজেকে ব্যাকডেটেড এবং কিছুটা ‘মফিজ টাইপ’ মনে হয়। তার স্ত্রী মুন্নী সবকিছুতে লেট হওয়া বা সবার শেষে যাওয়াটাকে ভীষণ অপছন্দ করে। আর যাত্রার সময় দেরি হলে তার হার্টবিট বেড়ে যায়।

আজ গাড়ি লং টার্ম পার্কিংয়ে রাখতে হবে। মুন্নী রাগে কথাই বলছিল না। কপাল ভালো হলে তবে ফ্লাইট ধরতে পারবে। কোভিডের পর একটু বড় ভাইয়ার বাসায় বেড়াতে যাবে, ক্যালিফোর্নিয়ায়। দুজনের ছুটি নেওয়া, এত টাকা দিয়ে টিকিট কাটা—এখন একটা দায়িত্বহীন মানুষ সব ভন্ডুল করে ফেলবে! আর আধঘণ্টা আগে রওনা দিলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? শুয়ে-বসেই তো সময় কাটায়! আর আছে মোবাইল টেপাটিপি!

৫৫ মিনিটের মধ্যে বোর্ডিং শুরু হবে। গাড়ি পার্ক করে বাসে গিয়ে, সিকিউরিটি চেক পোস্ট পেরোতে কমসে কম সোয়া ঘণ্টা লাগবে। দেড় ঘণ্টাও লাগতে পারে। ততক্ষণে প্লেনের দরজা লাগিয়ে দেবে। আবার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে মুন্নীর। ওদিকে নবাবজাদার কোনো তাড়া নেই। গাড়িও চালাচ্ছে আস্তে, যেন বিকেলে করার কিছু ছিল না দেখে লং ড্রাইভে বেড়িয়েছে। এই জ্বালাতন সহ্য হয়!

অনেক টাকা গচ্চা দিয়ে ডেইলি পার্কিংয়ে পার্ক করতে হবে, এ ছাড়া কোনো উপায় দেখছে না মুন্নী। এমন মানুষকে কেউ বিয়ে করে? যার সময় জ্ঞান নেই, দায়িত্ব জ্ঞান নেই, তাকে যে ভালোবাসে তার সারাটা জীবন ভাজা ভাজা হয়ে যায়। বিয়ের আগে সেটা আবার কিছুতেই বোঝা যায় না। দেরি হয়ে যাচ্ছে বললেও সে মানবে না, বিরাট তর্ক জুড়ে দেবে। তর্কে ওস্তাদ, টাইমিংয়ে নবাবজাদা বরাবরই ফেল।

তবে কিছুতেই লং টার্ম পার্কিংয়ে যাওয়া যাবে না। সব মাটি হয়ে যাবে। এক সপ্তাহের নেওয়া ভ্যাকেশনটা ঘরে বসে বোরড হতে হবে। মুন্নী মুখ খোলার আগেই কাওসার জিজ্ঞেস করল, ‘চুলা নিভিয়েছ?’

বুকটা ধক করে উঠল মুন্নীর। চুলা! চা করার পরে কেটলিটা চুলার ওপরেই বসানো ছিল। কম আঁচে। কাওসার সকালে দুই তিন কাপ চা খায়, তাই চায়ের কেটলি অনেকক্ষণ আঁচে থাকে। তবে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় চুলা একবার অবশ্যই দেখে নেয় মুন্নী। সেটাতে কোনো ভুল হয় না। মুন্নী আশ্বস্ত হয়ে বলল, ‘হ্যা।’

তারপর মনে করার চেষ্টা করল, কখন নেভাল সে? চা দিয়ে ব্যাগের ভেতরে টুথব্রাশ আর কাওসারের রেজরটা ঢোকাতে গেল। তারপর চার্জার নিল। তারপর কাপটা ধুয়ে রাখল। এর মধ্যে বড় ভাবির ফোন ধরল। কাওসার ব্যাগ নিয়ে নিচে নামল। সে ওর পেছনে ফোনে কথা বলতে বলতে নামল। তাহলে? কখন নেভাল চুলা?

নিশ্চয়ই নিভিয়েছে। এত বড় ভুল মুন্নীর হবেই না। বের হওয়ার আগে একবার দূর থেকে সে দেখে নেয় সব রেগুলেটর ওপরের দিকে, বন্ধ অবস্থানে আছে কিনা। আজ সেটা যে কখন দেখেছে, ঠিক মনে পড়ছে না। তবে নিশ্চয়ই দেখেছে। এ একেবারে অভ্যাস।

এখন ফ্লাইট যে ধরতে পারবে সেটাও মনে হচ্ছে না। যথা সম্ভব রাগ গোপন করে মুন্নী বলল, ‘গাড়ি ডেইলি পার্কিংয়ে রাখো। হাতে সময় নেই। টাকা লাগে লাগুক। নয় তো ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে।’

কাওসার কোনো উত্তর দিল না। যেন কথাটি সে শোনেনি। মুন্নী আরেকবার কড়া গলায় বলতে যাওয়ার আগেই কাওসার শান্ত স্বরে বলল, ‘ঠিক আছে।’

মুন্নী অবাক হলেও তার ভয় কাটল না। আজ নবাবজাদার জন্য ফ্লাইট নির্ঘাত মিস হবে।

আচ্ছা, চুলা যদি সে না নিভিয়ে থাকে, কোনো কারণে হয়তো মনে হয়েছে নেভানো, কিন্তু আসলে নেভেনি, তাহলে? কেটলি গরম হতে হতে সব পানি বাষ্প হয়ে যাবে। তারপর সেটা গনগনে লাল হয়ে উঠবে। এক দিন, দুই দিন, তিন দিনেও চুলা নিভবে না। সেই তাপে পাশের পেপার টাওয়েল, তেলের বোতল, পেছনের কাঠের দেয়াল, কোনো একটা কিছু জ্বলে উঠবে। ইস, রান্না ঘরে একটা ক্যামেরা লাগাল না কেন? তাহলে দূর থেকেই দেখা যেত, চুলা নেভানো না জ্বালানো! তিন/চার/পাঁচ দিন চুলা জ্বলতেই থাকলে উপায় আছে? অগ্নিকাণ্ড! প্রথমে কিচেনে, তারপর দাউ দাউ আগুন চলে যাবে লিভিং রুমে, তারপর বেড রুমে। সোফা, আসবাবপত্র সব পুড়তে থাকবে। মানুষ বুঝে উঠতে উঠতে, ফায়ার সার্ভিস আসতে আসতে, লেলিহান শিখা সব গ্রাস করে নেবে। তারপর পাশের বাসায় আগুন ধরবে। পুরো কমিউনিটিতে আগুন, সব পুড়ে ছাই! শুধু তার চা করতে গিয়ে তাড়াহুড়ায় চুলা না নেভানোর জন্য। সর্বনাশ! পাসপোর্ট পুড়ে যাবে, বিয়ের কাগজ-পত্র, টাকা-পয়সা, দুর্লভ ছবি, শাড়ি-গয়না স্যুট-টাই সব পুড়ে যাবে!

ফ্লাইটের আর ৪৫ মিনিট বাকি। কাওসার গাড়ি স্লো করে ডানে ডেইলি পার্কিংয়ে ঢোকার আগেই মুন্নী বলল, ‘বাসায় চলো।’

—বাসায়!

—হ্যা।

—কেন? তুমি চুলা নেভাওনি?

—মনে করতে পারছি না।

—ফ্লাইট মিস হবে তো?

—হোক।

—আরে না। তুমি নিশ্চয়ই চুলা নিভিয়েছ। আমিও একবার দেখেছি, সব নেভানো ছিল।

মুন্নী ভরসা পেল, কিন্তু কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। কাওসার ডেইলি পার্কিংয়ে ঢুকে পড়ল। বাটন টিপে টিকিট নিতেই সামনের দণ্ডটি ওপরে উঠে গেল। মুন্নীর বুক ধক ধক করছে। ফ্লাইট এখনো মিস হতে পারে-সে কারণে। তবে চুলা নেভানো হয়েছে, সেটা একটা বড় স্বস্তির ব্যাপার। তবুও হার্টবিট বেড়েই চলেছে।

কাওসার ভেতরে ঢুকেই ইউ টার্ন নিয়ে বের হওয়ার জন্য গাড়ি ঘোরালো। মুন্নী বিস্ময় এবং স্বস্তির সঙ্গে তাকে দেখছে। টিকিট ঢোকাতে বের হওয়ার দণ্ডটি উঠে গেল, কোনো টাকা দিতে হলো না। রাস্তায় উঠে কাওসার বলল, ‘আমারও আসলে ঠিক মনে নেই, চলো দেখেই আসি।’ মুন্নী চুপ করে রইল।

গাড়ি থেকে নেমে দুজনে দ্রুত বাসায় ঢুকে পড়ল। কিচেনে সব আগের মতোই আছে। চুলা নেভানো। মুন্নী হাত ব্যাগটা টেবিলে রেখে সোফায় ধপাস করে বসে পড়ল।

কাওসার চুলার কাছে গিয়ে চায়ের কেটলি নেড়ে দেখল। সেখানে এখনো কিছু চা আছে। সেটা কাপে ঢেলে মুন্নীর পাশে এসে বসল। ‘যাক, নিজ চোখে দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল। মন খারাপ কোরো না। এত বড় ঝুঁকি কি নেওয়া যায়?’

অথচ ওরা দুজনে গত শনিবার রফিক ভাইকে বলেছিল, ‘পাপিয়া ভাবি কামাল ভাইয়ের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়েছেন।’ সেটা শুনেছিল রত্না ভাবির কাছে। সেই শোনা কথাটায় তাদের একরত্তি সন্দেহ ছিল না।