চীন-রাশিয়ার নতুন রাজনৈতিক বলয় দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে, হাতিয়ার টিকা
করোনা মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে গণটিকা কর্মসূচি। সাধারণত যেকোনো ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস কিংবা অণুজীবের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিষেধক তৈরি করতে দীর্ঘ সময়ের গবেষণার প্রয়োজন হয়। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ কয়েক মাসের ব্যবধানে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর টিকা তৈরি করতে পেরেছে। বিশেষ করে ফাইজার ও বায়োএনটেক এবং মডার্না উদ্ভাবিত করোনা টিকায় ব্যবহৃত এমআরএনএ প্রযুক্তি আগামী দিনগুলোতে চিকিৎসাব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে অনেকে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলো কোনোভাবে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। সায়েন্সম্যাগ ডটওআরজি কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাজারে আসা টিকার শতকরা ৮৫ ভাগ মজুত রয়েছে মুষ্টিমেয় কয়েকটি ধনী দেশের হাতে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চূড়ান্তভাবে করোনা নির্মূল করতে হলে কোনো একটি পপুলেশনের শতকরা ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ মানুষের শরীরে কার্যকর অ্যান্টিবডির উপস্থিতি থাকতে হবে। তাই তাঁদের মতে, টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে যদি বিশ্বের ১৯৩টি দেশ সমানতালে অগ্রসর হতে না পারে; তাহলে আদতে এ গণটিকাদান কর্মসূচি খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। বিশেষ করে যেসব দেশ ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের দিক থেকে পিছিয়ে থাকবে, সেসব দেশে ডেলটা কিংবা ল্যামডার মতো নতুন নতুন ভেরিয়েন্ট তৈরি হবে, যা পরবর্তী সময়ে গোটা বিশ্বে নতুন করে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে।
সাধারণভাবে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ব্রিটেন, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ইতালি, স্পেন কিংবা আইসল্যান্ডের মতো কয়েকটি দেশকে দেখে ধরে নেয়, ইউরোপ মানে এমন একটি মহাদেশ, যার অধীনে থাকা সব দেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামো সব দিক থেকে উন্নত। তবে এসব দেশের বাইরে ইউরোপ মহাদেশের অধীনে এমন কিছু দেশ আছে, যেগুলোকে কোনোভাবে প্রথম বিশ্বের দেশ বলা যায় না। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত দিক থেকে এখনো যোজন যোজন পিছিয়ে। বিশেষত, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত বলকান নামের উপদ্বীপটিকে ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চল হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
পশ্চিম তুরস্কে ইস্টার্ন থ্রেস থেকে শুরু করে সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এক সুবিশাল অঞ্চলকে সামগ্রিকভাবে বলকান অঞ্চল হিসেবে অভিহিত করা হয়। তুরস্কের ইস্টার্ন থ্রেস, সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়া ছাড়াও বুলগেরিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, গ্রিস, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রো, আলবেনিয়া, কসোভোসহ হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয়েছে এ বলকান অঞ্চল। স্থানীয় বলকান পর্বতমালার নাম অনুসারে অঞ্চলটিকে ‘বলকান’ নামে অভিহিত করা হয়। যদিও স্থানীয় ভাষায় স্লাভরা এসব পর্বতমালাকে ‘স্টারা প্ল্যানিনা’ নামে সম্বোধন করেন। বলকান অঞ্চলকে ইউরোপের প্রবেশদ্বার বলা হয়। এশিয়া থেকে ইউরোপ মহাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি প্রধান রুট হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়। সমগ্র বলকান অঞ্চলটি উত্তর-পশ্চিমে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর, দক্ষিণ-পশ্চিমে আইয়োনিয়ান সাগর, দক্ষিণে ইজিয়ান সাগর ও উত্তর-পূর্বে কৃষ্ণসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত, ফলে অঞ্চলটি কার্যত একটি উপদ্বীপ বা পেনিনসুলায় পরিণত হয়েছে। সুদীর্ঘকাল বলকান পেনিনসুলার দেশগুলো তুরস্কের অটোমান সালতানাতের অধীনে ছিল।
দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের রোমানিয়া, গ্রিস, বুলগেরিয়া ও ক্রোয়েশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। চারটি দেশকে ভ্যাকসিন প্রাপ্তির বিষয়ে তেমন একটা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়নি। ইইউর সঙ্গে ভ্যাকসিন সরবারহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্রিম চুক্তির ফলে অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্রের মতো এসব দেশেও সমভাবে ভ্যাকসিনের বণ্টনের বিষয়ে আগেই নিশ্চিত করেছিলেন ইউরোপিয়ান কমিশনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য দেশের মতো এ চার দেশও সমানতালে টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত, করোনার নতুন স্ট্রেইন ডেলটা ভেরিয়েন্ট মোকাবিলায় ইউরোপের অনেক ধনী দেশ ইতিমধ্যে বুস্টার ডোজ প্রয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। তবে অধুনা এমআরএনএ প্রযুক্তির সাহায্যে নির্মিত ফাইজার ও বায়োএনটেক এবং মডার্না উদ্ভাবিত করোনার টিকা সংরক্ষণ ও বণ্টনের ক্ষেত্রে এ দেশগুলোকে টিকাদান কর্মসূচির শুরুর দিকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল।
অন্যদিকে উত্তর মেসিডোনিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রো, আলবেনিয়া, কসোভো, এমনকি মলদোভা ও ইউক্রেনের মতো দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই করোনার টিকাদান কর্মসূচিতে এসব দেশ এখনো সেভাবে সফলতার মুখ দেখছে না।
দীর্ঘদিন ধরে সার্বিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভের চেষ্টা চালিয়ে আসছে, কিন্তু কসোভোসহ একাধিক ইস্যুতে দেশটির সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর বিরোধ থাকায় সার্বিয়া এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশ করতে পারেনি। আর এ সুযোগে বর্তমানে রাশিয়া ও চীন সার্বিয়াকে পুঁজি করে ইউরোপে তাদের রাজনৈতিক বলয় সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। সার্বিয়ার বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রকল্পে রাশিয়া, তুরস্ক ও চীনের বিনিয়োগ পড়েছে। সার্বিয়ার নাগরিকেরা কোনো ধরনের ভিসা ছাড়া রাশিয়া, তুরস্ক ও চীন ভ্রমণ করতে পারেন। অন্যদিকে রাশিয়া, তুরস্ক ও চীনের নাগরিকেরাও সার্বিয়াতে ভিসা ছাড়া যাতায়াত করতে পারেন।
সার্বিয়া ও রাশিয়া উভয় রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম অর্থোডক্স খ্রিষ্টানিটি, যা এ দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ককে জোরদার করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো টিকাদান কর্মসূচি শুরু করে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বরে, কিন্তু সবাইকে অবাক করে এর চার দিন আগে, অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর থেকে ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম শুরু করে সার্বিয়া। ফাইজার-বায়োএনটেক, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও মডার্না থেকে সার্বিয়া টিকা সংগ্রহ করেছে। তবে দেশটি করোনার টিকার জন্য রাশিয়া ও চীনের ওপর সবচেয়ে বেশিমাত্রায় নির্ভর করেছে। সাম্প্রতিক সময় চীন ও রাশিয়া থেকে প্রাপ্ত ফর্মুলা অনুযায়ী স্পুতনিক ভি, সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের টিকা এখন সার্বিয়াতেও উৎপাদিত হচ্ছে।
অন্যদিকে উত্তর মেসিডোনিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রো, আলবেনিয়া ও কসোভোর মতো দেশগুলো রাজনৈতিকভাবে সার্বিয়ার মতো সে অর্থে প্রভাবশালী নয়। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকার কারণে এসব দেশকে ভ্যাকসিন সরবারহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। পাশাপাশি দক্ষ জনবলের ঘাটতি এবং টিকা সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির অপ্রাচুর্যতা এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বাড়তি উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বিশেষত, ফাইজার ও বায়োএনটেক উদ্ভাবিত করোনার ভ্যাকসিন সংরক্ষণে মাইনাস ৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় এবং এ তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় রেফ্রিজারেটর এসব দেশে যথেষ্ট পরিমাণে নেই।
টিকাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এসব দেশের কাছে সবচেয়ে আস্থার নাম ছিল কোভ্যাক্স। গত বছরের মার্চ মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সুইজারল্যান্ডের গ্যাভি এবং নরওয়েভিত্তিক কোয়ালিশন ফর অ্যাপিডেমিক প্রিপার্ডনেস ইনোভেশনস সম্মিলিতভাবে কোভ্যাক্স নামের বিশেষ প্রকল্প চালুর ঘোষণা দেয়। মূলত সহজ শর্তে কোভিড-১৯–এর ডায়াগনিস্ট থেকে শুরু করে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকরী টিকার উদ্ভাবন এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সহজে সে টিকার বিপণনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কোভ্যাক্স যাত্রা শুরু করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ইতিমধ্যে অর্থসহায়তার পাশাপাশি কোভ্যাক্সের অধীনে তাদের উদ্বৃত্ত টিকার একটি বড় অংশ এসব দেশের মধ্যে বিতরণ করেছে, তবে প্রয়োজনের তুলনায় সেটি ছিল একেবারে অপ্রতুল। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সার্বিয়া দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এসব দেশের মধ্যে টিকা বিতরণ করেছে। এমনকি সার্বিয়ার সরকার দুবাইয়ের অনুকরণে টিকার ট্যুরিজম নামের এক প্রকল্প চালু করে, যার অধীনে উত্তর মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো, আলবেনিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা এমনকি ক্রোয়েশিয়ারও অনেক স্থানীয় অধিবাসী টিকা গ্রহণের জন্য সার্বিয়াতে জড়ো হন। চীন ও রাশিয়াও বৃহত্তর পরিসরে এসব দেশে টিকা সরবরাহ করার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, সার্বিয়াকে ঘিরে আগামী দিনগুলোতে ইউরোপের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হবে, যার মূলে থাকবে চীন, রাশিয়া ও তুরস্ক। টিকাদান কর্মসূচিকে তাঁরা এ রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রথম ধাপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
প্রায় সব ক্ষেত্রেই সার্বিয়ার সঙ্গে আলবেনিয়ার সম্পর্ক সব সময় দা–কুমড়ার মতো, তবে টিকা ইস্যুতে অনেকটা সার্বিয়ার মতো অবস্থান নিয়েছে ইউরোপের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি। আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এদি রামা কয়েক মাস আগে বলকান ইনসাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের করোনা টিকা কার্যক্রমকে সম্পূর্ণভাবে নীতি-নৈতিকতা–বিবর্জিত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেবল তাদের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর কথা চিন্তা করে, ইইউর বাইরে ইউরোপে যেসব দেশ আছে, তাদের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কখনো ভাবে না। আমাদের বিশ্বাস ছিল, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো তাদের উদ্বৃত্ত ভ্যাকসিন মানবতার স্বার্থে অপেক্ষাকৃতভাবে দরিদ্র বলকান দেশগুলোর মধ্যে বিতরণ করবে, যাতে আমরাও তাদের মতো টিকা কার্যক্রম শুরু করতে পারি। তারা আমাদের কথা কখনো সেভাবে বিবেচনায় আনেনি, এদিকে আমাদের জনগণেরও তো করোনা থেকে সুরক্ষার প্রয়োজন আছে। তাই এ রকম পরিস্থিতিতে যদি চীন ও রাশিয়া আমাদের দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহের ঘোষণা দেয়, আমরা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারি না।’
উত্তর মেসিডোনিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রোসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদেরকেও এদি রামার সুরে কথা বলতে শোনা গেছে।
শুধু বলকান দেশগুলো নয়, ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি কর্তৃক চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের অনেক আগে চীন ও রাশিয়ার তৈরি টিকাকে জরুরিভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমতি দেয় হাঙ্গেরি। এ বিষয়ে ইউরো নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার সিজারতো জানান, ‘চূড়ান্তভাবে করোনা নির্মূল করতে আমরা দেশের শতকরা ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। কিন্তু শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর নির্ভর করলে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল, তার থেকে সংস্থাটি অনেকটা দূরে সরে এসেছে, পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। তাই আমরা কঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে রাশিয়া ও চীনের থেকেও করোনার ভ্যাকসিন ক্রয় করতে চাই।’
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ওরবান ভিক্টর নিজেও ফাইজার-বায়ো–এনটেক, মডার্না, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা কিংবা জনসন অ্যান্ড জনসন উদ্ভাবিত করোনা টিকার পরিবর্তে চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের টিকা গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হলো চীন এবং এ কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় করোনাবিষয়ক কোনো গবেষণার ক্ষেত্রে চীন সবার ওপরে। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যেকোনো করোনার টিকার তুলনায় চীনের তৈরি টিকার করোনা প্রতিরোধে অন্য যেকোনো টিকার চেয়ে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু করে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুটি পরাশক্তিধর রাষ্ট্র সমগ্র বিশ্বের ওপর কর্তৃত্ব চালিয়েছে। ইউএসএসআরের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ের পতন ঘটলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি হিসেবে আজও টিকে আছে। তবে ধীরে ধীরে চীন বিশ্বের বুকে নিজেদের সুপার পাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। চীনের সঙ্গে সহযোগী রাষ্ট্র হিসেবে রয়েছে রাশিয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তান। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে কেন্দ্র করে ইউরোপ মহাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক বলয় গড়ে উঠেছিল। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, পূর্ব ইউরোপ, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত বলকান উপদ্বীপকে ঘিরে ইউরোপ মহাদেশে চীন, রাশিয়া ও তুরস্কের প্রভাব সুসংহত হবে।
সার্বিয়ার পাশাপশি উত্তর মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো, আলবেনিয়া ও বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনাতেও চীন, রাশিয়া ও তুরস্কের বিনিয়োগ রয়েছে। করোনাকালে এসব দেশে চীন, রাশিয়া ও তুরস্ক বিভিন্ন আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি মেডিকেল ইকুয়েপমেন্টও পাঠিয়েছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে করোনা ভ্যাকসিন ইস্যু। অন্যদিকে কসোভোর সঙ্গে সার্বিয়ার কূটনৈতিক দূরত্বকে পুঁজি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো কসোভোতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশ কসোভোকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও চীন ও রাশিয়া কসোভোকে সার্বিয়ার অংশ মনে করে। তবে স্থানীয় রাজনীতিতে কসোভো তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ফ্যাক্টর নয়। কাজেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদাসীনতার কারণে ভ্যাকসিন ইস্যুকে কেন্দ্র করে বলকান পেনিনসুলার বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে চীন ও রাশিয়া যেভাবে প্রভাব বিস্তারে সুযোগ লাভ করল, তা আগামী দিনে ইউরোপে পশ্চিমা রাজনৈতিক জোটগুলোর প্রভাব অনেকাংশে হ্রাস করার পাশাপাশি চীন ও রাশিয়াকে সুপার পাওয়ার হিসেবে নতুনভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ প্রদান করবে বলে স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া