চাকা

ছোট মফস্বল শহর। বাবার নাম নিতাই; সাথি আর শিলা দুই মেয়ে। বাবা ছোট এক মুদির দোকানি। ওদের মা সাক্ষাৎ দুর্গা। দুই মেয়ে মায়ের রূপ পেয়েছে। বড়টা ক্লাস এইটে উঠছে। সাথির মায়ের নাম মিনতি; সবাই ডাকে মিনু। পাড়ার শেষ মাথায় ওদের ঘরটা দোচালা টিনে তৈরি। শহরটা গ্রামের মতো। পাওয়ার হাউস আছে। সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। পঁচিশ-চল্লিশ পাওয়ারের টিমটিমে বাতি জ্বলে। মুদির দোকান কুপি দিয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা রাখে। কেরোসিন, চিনি, চা পাতা, বিস্কুট, চানাচুর, লজেন্স, পান-সুপারি, জর্দা—এগুলোই বেশি বেচাকেনা হয়। মাঝেমধ্যে শহরে লোডশেডিং হলে বেজায় কষ্ট হয়। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে রাস্তার পাশে বসে তালের পাখা নিয়ে বাতাস করতে করতে গল্প করে লোকেরা।

-মিনু ও মিনু দেখ দিকি কে এসেছে। নিতাই ডাকতে ডাকতে সামনের বাগানের টিনের গেট খুলে ঢুকল।

-কে? মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে মিনতি দরজায় এসে দাঁড়াল। রমা আর ওর মা এসেছে; দূর সম্পর্কের ননদ মিনতির।

-আসো আসো, ভেতরে চল।

ভেতরের ঘরে এনে ওদের চেয়ার পেতে বসতে দিলে। দুটি কাঠের চেয়ার ঘরে। আর আছে বেতের মোড়া। সাথি আবার মোড়ায় সাদা বালিশের মতো বানিয়ে লাল কুচি কুচি ঝালর দিয়ে বেশ সাজিয়ে দিয়েছে। রমা চলে গেল ভেতরে সাথির কাছে। রমার মা আর নিতাই বসল। মিনু হাতপাখা নিয়ে বসে। এই পাখাটা ঘোরে বেশ, বাঁশের তৈরি।

-দিদি পান খাও। পলা আসেনি? ও কেমন আছে?

-পলাদের বাড়ির একটা গরুর বাচ্চা হয়েছে দুদিন হলো। আজ হঠাৎ গরুটা মরে গেছে।

-আহা কী কষ্ট!

-ও দিদি পান খাও। এই মসলাটা মৌরি ভাজা, তামাকের গুঁড়া দিয়ে বানিয়েছি। তোমার দাদার দোকানে পান খাওয়ার লোকই ভিড় করে বেশি। আর আসে নাড়ু খেতে।

-তোমার হাতের জাদু। তোমার মেয়ে দুটি কই? ওদের ডাকো। বহুদিন দেখি না।

-আদাব কাকি।

দুটি কাপে দুধ চা ও গ্লুকোজ বিস্কুট এনে রাখল সাথি ।

-জল আনব কাকি?

-হ্যাঁ, আন মা। পান আছে মুখে। কুলকুচা করে ফেলতে হবে। চা করতে গেলে কেন?

কাঁসার গ্লাসে জল এনে রেখে রমাকে ডাকে

-দিদি আয় চা খা।

-ও দিদি নাড়ু বের করি? একটা খেয়ে দেখ।

-না না আমি খাব না। রমাকে দাও যদি খায়।

মিনতি একটা পিরিচে তিনটি নাড়ু বের করে রাখে। আরও দুই কাপ চা এনে রাখল সাথি মা-বাবার জন্য।

-তোর ছোট বোনটি কই?

-ওই যে ঠাকুরঘরের পাশে বসে পুতুল খেলছে। মনি...

মায়ের পিঠ ঘেঁষে এসে দাঁড়ায় শিলা। শিলার হাতে বিস্কুট দিল রমার মা; ললিতা কাকি।

-নিতাইদা তোমার কপাল ভালো দুটো মেয়ে দারুণ গড়ন পেয়েছে। এদের বিয়ের চিন্তা করতে হবে না। আমার রমাটার গায়ের রংটা বড় মাজা। দাঁতগুলোও উঁচু।

-ছোটটির কত হলো?

-ও এই বর্ষায় সাত হলো; বড়টি চৌদ্দ। মাঝে যে ছেলে হয়েছিল সে তো দুই দিনের জ্বরে মারা গেল তিন মাস বয়সে। শিবু নাম রেখেছিলাম।

নিতাই উঠে বাইরে গেল। চা শেষ করে পান মুখে পুরতে পুরতে রমার মা বলে—

-শোন বৌঠান মেয়ে তোমার ডাগর হয়েছে। সব সময় চোখে চোখে রাখবে। ওর কি মাসিক হয়েছে?

-হ্যাঁ, এই তো মাস দু-এক হলো শুরু হয়েছে।

-আমি দেখেই বুঝেছি। শোন তুমি সেলাইয়ের সময় না পেলে আমাকে দিয়ো। আমি ওর ফ্রকে কুচি দিয়ে ঝালর লাগিয়ে দেব; বুক ঢেকে থাকবে। বুঝলে কিনা এখন তো পাড়ার ছেলে-বুড়োর চোখ গিয়ে বুকে পড়বে। ফিসফিস করে বলে যেন আর কেউ শুনতে না পায়। কিন্তু রমা আর সাথি দুজনেই শুনতে পায়। ওরা মুখ টিপে হাসে। রমা সাথির চুল বেণি করে দিল।

-আজ আসি।

-আবার এসো কাকিমনি। রমাদি তুই আসবি কিন্তু।

-আসব। দিদি তোমার বাসায় সাথির জামা নিয়ে যাবক্ষণ। খাবার জল আনতে সাথি আর শিলা মোড়ের চাপকলে যায়। মা দাঁড়িয়ে থাকে বাসার দরজায়। দুই বোন গিয়ে দুটো কলসে করে জল নিয়ে আসে। ললিতা কাকি চলে যাওয়ার পর মা ভয় পেয়েছে। মা কখনো আবার বাবাকে পাঠিয়ে দেয় ওদের পিছু পিছু।

সেদিন ভয় সাথিও পেয়েছে। চাপকলে সিলভারের কলসে পানি ভরে শিলার ছোট কলসে পানি নিয়ে ছোট জগে পানি ভরছিল; তখনই কতগুলো ছেলে সাইকেলে করে এসে দাঁড়িয়েছে। একজন ওর জগ নিয়ে নেয় হাত থেকে। সাথি রাগ করলে একটি ছেলে একদম ওর সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে—

-জল দিতে আপত্তি কেন?

-মা দাঁড়িয়ে আছে তাই।

-মা না দেখলে দিতে আপত্তি নাই?

-সেটা কেন? দেরি হলে মা বকবে।

-তোমার পানিটা বেশ মিষ্টি।

-এ রাম আমাদের সব জল ফেলে আবার নেওয়া লাগবে।

-কেন?

-উত্তর না দিয়ে সাথি সব জল ফেলে দেয়। আবার কলস-জগ ভর্তি করে বাড়ির দরজায় আসতেই মা বকুনি দেয়।

-আজ কী তোরা মিউনিসিপ্যালটির পুকুর থেকে জল আনতে গিয়েছিলি?

-না মা। কতগুলো মুসলিম ছেলে আমাদের জল ছুঁয়ে দিল। সব জল ফেলে আনতে হলো বলেই তো দেরি।

-অন্য পাড়ার ছেলে নিশ্চয়ই?

পরদিন মা দু-একজন পাড়ার মাসিসহ দাঁড়িয়ে রইল। ছেলেগুলো এসে সাইকেল রেখে দূরে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা পানি নিয়ে হেঁটে বাড়ির গেটে ঢুকতেই ওরা চাপকল চেপে পানি খেতে শুরু করল। তিন দিন পর মা আর গেল না।

-মা জল নিতে যাচ্ছি।

চাপকল চাপ দেয়। স্বচ্ছ জলে পিতলের কলস কানায় কানায় ভরে ওঠে। তারপর শিলার জারমনীর কলস ভরল।

-আমার জল কই?

-তোমার জল কলে আছে। চেপে খাওগে।

-না, তুমি জল দিলে তবেই খাব।

ওর হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দেয়।

-আমি এ শহরের ছেলে। সবাই চেনে আমাকে। তুমি কেন চিনলে না?

তাড়াতাড়ি ঘরে এসে পড়তে বসে। বইয়ের ফাঁকে চিরকুট রেখে পড়ে—‘আমি মামুন। তোমাকে খুব ভালো লাগে। ভালোবাসি তোমায়। তুমি বাসবে কী ভালো? কাল সকালে স্কুলের কাছে উত্তর দিও।

বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে। এটাই ওর প্রথম পাওয়া প্রেমপত্র। বইয়ের ভেতর রেখে দেয়। একটু পরপর বের করে পড়ে। বাবার কাশির শব্দ শুনল। বাবা ফিরল, বাবার জন্য জল ঢেলে গ্লাস নিয়ে এগিয়ে গেল।

-বাবা জলটা খাও। কাশছ যে।

-আমার ময়না মা। সিগারেটে টানটা দিতেই পানের রস চলে গেছে শ্বাসনালিতে। জলের গেলাসটা দে দিকি। জল খেলে ঠিক হয়ে যাবে।

জল খেয়ে বাবা কুয়াতলায় গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসে। সবাই রাতের খাবার খেয়ে নেয়। তখনই সাইকেলে ক্রিং ক্রিং ঘণ্টা বাজে। ও জানে এই সাইকেলের ঘণ্টা কার! বুকের ঢিপঢিপ শব্দ এত জোরে হচ্ছে যে ভয় পায় সাথি, কেউ শুনে ফেলে পাছে। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে দুই বোন। টিনের ফুটো দিয়ে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ে ঘরে। শিলার মুখে চাঁদের একফালি আলো। মনে হয় ও যেন এক চন্দ্রালোকের রাজকন্যা। কাল সকালে কী হবে ভেবে লজ্জা পায়।

সম্পর্কগুলো যেন পাটিগণিতের সরল অঙ্ক। রেখা বন্ধনী, প্রথম বন্ধনী, দ্বিতীয় বন্ধনী, তৃতীয় বন্ধনী, ভগ্নাংশ, যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ ইত্যাকার নিয়ম মেনে কষে সমাধান কর। একটুও অনিয়ম করা যাবে না। ভাগের আগে গুণ করা যাবে না, আবার রেখা বন্ধনীর আগে ব্রাকেটের কাজ নয়। একটু গরমিল হলে সব তালগোল পাকিয়ে মাকড়সার জাল হয়ে ঝুলে থাকবে। যতই ছাড়াতে চাও, ততই জড়াবে। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমনই সরল অঙ্কের ধাঁধায় প্রতিটা সম্পর্ক জড়ানো। প্রতি বাঁকে সম্পর্কের বদল হতে হতে জীবনের শেষ বাঁকে যখন পৌঁছায়, তখন চারপাশে ঘিরে থাকা শূন্যতার মধ্যে সে একা দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদের একফালি আলোয় উজ্জ্বল শিলার মুখ। শিলার বয়স আট বছর। খুব রূপবতী; মায়াবতীও। একদম সোনার পুতুল। এই পাড়ায় ওদের মতো গায়ের রং একজনেরও নেই; যাকে বলে কাঁচা হলুদ। ওদের মাও খুব সুন্দরী। সিঁদুর দিয়ে গোসলের পরপর মা যখন উঠোনে দাঁড়িয়ে কাপড় শুকাতে দেয় তারে, তখন লালপেড়ে শাড়ির আভা মার সারা মুখে ঝলক দেয়। মাকে মনে হয় পরির মেয়ে, নাকি সাক্ষাৎ দুর্গা।

সাথি যখন ছয়-সাত বছরের, তখন এক দাদু ওর চেহারা দেখে বলেছিলেন আরে দিদিভাই তুই তো সাক্ষাৎ পরির মেয়ে। তখন থেকে ও আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। বাবা-মা দুজনই সুন্দর। তবে মা বেশি সুন্দরী। মার চুল কালো। ওর চুল কালো। কিন্তু শিলার চুল সোনালি; আর হালকা ঢেউ তোলা। পাড়ার মেয়েরা ওদের ঈর্ষা করে। তবে ছেলেরা অযথাই বেশি আদর করতে চায়। সে কারণে মা ওদের বেশি বাইরে যেতে দিতে চায় না। ওদের খাওয়ার জল বীণা মাসি এনে দেয়। বীণা মাসি ওর মেয়েকে দেখতে ইন্ডিয়া গেছে, এক মাস পর আসবে। আর তাই ওরা জল আনতে যাচ্ছে।

ভোরে পাখির কিচিরমিচির আর আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। বুকের ভেতর অজানা শঙ্কা। কী হবে আজ! তাড়াতাড়ি ফুল তুলে এনে ঠাকুরকে দিল। চা আর মুড়ি বাবা-মাকে দিয়ে বোন আর নিজের জন্য কলা-দুধ-মুড়ি মাখল। শিলা উঠে মুখ ধুয়ে নাশতা খেয়ে পড়তে বসে। মা বারান্দায় খড়ির চুলায় ভাত বসায়। আতপ চালের ভাতের ঘ্রাণ উঠেছে। পড়ায় মন বসে না। শিলা পড়ে—

‘উড়ানির চর

ধুলায় ধূসর।

যোজন জুড়ে বালির উপর ভাসিছে ধুলি।’

আনমনা সাথি। কুয়ার পানি তুলে গোসল করে আসে। স্কুলের সাদা পায়জামা, নীল জামা, সাদা ওড়না। চুল মুছে রাবার দিয়ে বেঁধে দেখে মা কাঁসার থালায় ডিম মামলেট আর আলুভর্তা, সঙ্গে ঘি দিয়ে ভাত দিয়েছে।

রাস্তায় হেঁটে যায় দ্রুত। শিলার প্রাইমারি স্কুল আগে পড়ল। ও চলে গেল। নাসিমা আর ও হাঁটছে। এমন সময় সাইকেলে এসে পাশেই নামল মামুন। ভয় পেয়ে কেঁপে উঠল সাথি।

-কেমন আছ?

-ভালো।

-এই বইটা তোমার।

একটা বই ওর হাতে দিয়ে চলে গেল। চোখে চোখ পড়তেই মিষ্টি হেসে চোখে টিপ দিয়ে চলে গেল। বইয়ের ভাঁজে ভালোবাসার খাম। খামটা নিয়ে স্কুলের বাথরুমে গিয়ে চিঠি পড়ে সাথি।

‘সোনালি মেয়ে,

অতঃপর আমি তোমাকেই ভালোবাসি। এক আকাশছোয়াঁ ভালোবাসার বর্ষায় ভিজে আমি তোমার কাছে এসেছি। আমার শূন্য মনের আঙিনায় একটু একটু করে আলো-ঝলমল এক নতুন সকাল তুমি। তুমি এখন আমার স্বপ্ন রাজ্যজুড়ে। কেমন করে তুমি আমার এ জীবনে এলে জানি না। শুধু জানি, তুমি আমার; শুধুই আমার। আমারই থাকবে অনন্তকাল।’

চিঠিটা জামার ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে আসে। মনটা কেমন উদাসী হয়ে ওঠে। ক্লাসে মন বসে না। জানালা দিয়ে দেখে বাতাবীলেবুর গাছে দুটি বুলবুলী খুনসুটি করছে। দীপালি দিদিমণির বাংলা ব্যাকরণ ক্লাস। পড়া ধরলেন। স্বভাবতই মন না দেওয়ায় পারল না। মুখটা লাল হয়ে গেল; কানসহ। দিদিমণি বললেন—

-তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে? বাড়ি যেতে চাও? একটা কাগজে সই দিয়ে একজন দাইয়ের সঙ্গে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।

অবেলায় ওকে ফিরতে দেখে মা উতলা।

‘?

আমার সারা পৃথিবীজুড়ে কে যেন সুরের ঝরনাধারা নিয়ে এসেছে। আমি কী ‘হ্যাঁ’ বলব? ‘হ্যাঁ’ বললে তোমাকে পাব। বাবা-মা-বোনকে ছেড়ে দিতে হবে। আর যদি ‘না’ বলি তোমাকে পাব না। বাবা-মা আমারই থাকবে। হা ভগবান। কেন এত বড় পরীক্ষায় আমাকে ফেললে! আমার এত সাহস নেই। ক্ষমা করে দিয়ো।

সাথি’

পরদিন স্কুলে যাওয়ার সময় বইটা ফেরত দিয়ে স্কুলে গেল সাথি। তার পরদিন মনোরমা নামের পাড়ার এক দিদি ওকে বাসা থেকে ওদের বাড়ি ডেকে নিয়ে গেল। একটু পর সে বাসায় একটি সাইকেল থামল। মনো তুমি একটু চা করে আনো। মনোর হাতে শিঙারার ঠোঙা দিয়ে বলল। মনোরমা চা বানাতে গেল। মামুন মুহূর্তে ওর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বলে—‘সোনালি তুমি শুধুই আমার। তোমার বাবা-মাকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেব। আমাকে কেউ না বলতে পারবে না। বলেই বালিকাকে দুহাতে বুকে টেনে নেয়। অবলীলায় ঠোঁট আবদ্ধ হয় ঠোঁটে। বুকের ভেতর শুধু ভীরু হরিণ শাবকের মতো থরোথরো করে বালিকা।

চা নিয়ে আসে মনোরমা। শিঙারার কোণ ভেঙে মুখে নিয়ে বলে

-মনোদিদি তুমি চা খাসা বানিয়েছ। চা না খেয়েই সাথি বলে

-আমি বাসায় যাব। ওর মুখ এত ফরসা যে মুখ রক্তাভ হয়ে আছে।

-দিদি আমি আসি, বলে চলে যায় সে।

মামুন ভাবে লজ্জা পেলে এত সুন্দর কাউকে লাগে! সিনেমায় সুচিত্রা সেনকেই দেখেছে। এই মেয়েকে তার চেয়েও ঢের সুন্দর লাগছে দেখতে।

জীবন এক জটিল ও রহস্যময় উপাদানের সংমিশ্রণ যেন, যার ধর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় সময়ের হাতে। কখনো সে সম্পর্কগুলো জড়িয়ে থাকে স্বর্ণলতার মতো, আবার কখনো হয়ে যায় জলবিছুটি। সময়ের কাটাছেঁড়ায় একই সম্পর্ক হয়ে যায় আনন্দ-বেদনার, অভিমানের কারণ। একই সময়ের গায়ে গা লাগিয়ে জড়িয়ে থাকা সম্পর্কগুলোই কেমন দলছুট হয়ে ছিটকে পড়ে এদিক-সেদিক। আপন বলয়ে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সেখানে পুরোনো সম্পর্কগুলো মরে যায়। একসময় হারিয়ে যায় সময়ের চোরা স্রোতে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ চলল। যুবক এতই উদ্ধত যে কেমন যেন কখনোই না বলতে পারে না। কাছে এলে জাপটে ধরে। কোন দ্বিধা নেই। থরোথরো শুধু কাঁপে। ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। মেট্রিক পরীক্ষার আগেই পুজোর কাপড় ফলমূল মিষ্টি মণ্ডা নিয়ে বাসায় এসে হাজির হলো। মা-বাবা কিছু বুঝতে পারে না। ঠিকাদারি শুরু করেছে ওদের পাড়ার রাস্তায়। সে জন্য নাকি উপহার নিয়ে পরিচিত হতে এসেছে। সাথি স্কুল থেকে ফিরে খেতে বসবে—এমন সময় বাবা হন্তদন্ত হয়ে এলেন।

-কী রান্না করেছ সাথির মা? বাবাজি খেতে এসেছেন। মা সেদিন বেগুন ভাজা ডাল আর বোয়াল মাছ রান্না করেছেন। এসে কলপাড়ে হাতমুখ ধুয়ে বেশ খেতে বসে গেল। মা যেন লজ্জা পাচ্ছেন।এমন সাদামাটা খাবার। দুটো হাঁসের ডিম পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে অমলেট করে দিল পাতে। সে তো মহানন্দে খেয়ে উঠল।

-মাসিমা আপনার রান্নায় জাদু আছে। কাকা এই রাস্তার কাজ বর্ষা শুরুর আগে শেষ করতে হবে। সে জন্য বেশি শ্রমিক লাগিয়ে কাজ শেষ করছি।

এমনই সহজ অনুপ্রবেশ। আগে এদিকটায় রিকশা বেশি আসত না। এখন রাস্তা পিচঢালাই হওয়ায় এই রাস্তা ধরে আরেক পাড়ায় চলে যায় গাড়ি-রিকশা-সাইকেল। ওদের পাড়ার এক দিদির বিয়ে হচ্ছে। বরযাত্রীর গাড়ির বহর বেশ চলে এল। রাস্তাটা হওয়ার পর কোনো এক জাদুবলে বাবার ব্যবসাও জমজমাট হয়ে গেল। বাবা খুশি। শিবানীদির বিয়ের আসরে বরপক্ষের এক আত্মীয় পছন্দ করে বসল সাথিকে। সেই মাসিমা মায়ের সঙ্গে এসে বাড়িঘর দেখে গেলেন। তাঁর ছেলে ওকালতি করে নেত্রকোনা শহরে। বিয়েবাড়ির মরিচাবাতির আলো আর সাজন গানের সানাই শুনতে শুনতে পাগল পাগল লাগে সাথির। শিবানির ছোট বোন রীমির সঙ্গে বর দেখতে গিয়েছিল। এমন সময় মামুনের বন্ধু একটা কাগজ ওর হাতে দিল। পরদিন এক বাসায় ওর সাথে দেখা করতে বলেছে। সেই বাসার সামনে রিকশা থামতেই ভাড়া দিয়ে বিদায় দিল। নেত্রকোনার বিবাহ সম্বন্ধে সব জানে।

-দেখো আমার নিজস্ব কিছুতে কারও হাত বাড়িয়ে দেওয়া আমি অপছন্দ করি খুব। আমি শিগগিরই বিয়ের কথা ভাবছি।

মার মুখ থমথমে। যেন কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। বাবা শজনে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। কী হলো কিছু বোঝার আগেই দেখল ওকে দেখে বাবা এসে ঘরে ঢুকলেন। ওকে কাছে ডেকে পাশে বসালেন। বললেন—

-বুঝলিরে মা এই গরিবের ঘরে এত রূপবতী মেয়ে হতে নেই।

মা এসে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।

-তোমার মেয়েকে আশকারা দিতে কে বলছে বল? সে যে মুসলিম এটা বুঝবে না? এখন আমাদের কী জাত-ধর্ম সব যাবে? ছোট আরেক মেয়ে আছে। তার কী হবে? বল?

বাবা ওকে রাতভর বোঝালেন হিন্দুর মেয়ে হিন্দুর ছেলেকে বিয়ে করবে—এটাই রীতি। তারপর বাবা বললেন ওরা দূরের শহরে বেড়াতে চলে যাবেন কয়েক দিনের জন্য। সারাটা রাত এক ফোঁটাও ঘুম হলো না। সূর্যের আলো ঘরের বেড়ার ফাঁক গলে শিলার মুখে পড়ে। শিলার গোলাপি ঠোঁট আর কালো কোঁকড়ানো চুল কী মায়া ছড়াচ্ছে। বাবার কথাটা মনে মনে আওড়ায়। গরিবের ঘরে এত রূপবতী মেয়ে হয়ে না জন্মানো ভালো।

-আজ তোমাকে স্কুলে যেতে হবে না। ঝাঁঝিয়ে ওঠে মা।

-মা আজ পরীক্ষার ফি জমা দেওয়ার কথা।

-তোর বাবা দিয়ে আসবে।

-কেন? তোমরা মনে করেছ আমাকে ঘরে আটকাতে পারলে সমস্যা শেষ? হবে না মা। পারবে না। তার ভালোবাসার শক্তি ভিন্ন রকম।

এগারোটার দিকে সদর দরজায় খটখট শব্দ। মা দরজা খুলতেই মামুন—

-আদাব মাসিমা, বলে ঢুকে পড়ল। আচ্ছা তোমরা কী সাথিকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছ? ও পরীক্ষা দেবে না? শোন কেউ কিছু করবে না। আমি ওর পরীক্ষার ফিস জমা দিয়ে আসছি। বাবাকে বাসায় ডেকে আন। আজ রাতেই আমি ওকে বিয়ে করব।

বাবা আর মা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল।

-সাথি বাবা-মার পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নাও। একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। মাসিমা আমি আমার মায়ের কাছে ওকে নিয়ে যাচ্ছি। মায়ের নির্দেশ মেনে যা করব আপনাদের জানাব।

-বাবারে এত বড় অনর্থ করো না। মা বিলাপ করে উঠলেন। মিনতি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। মিনতির ১৯৭১ সালের কথা মনে পড়ছে। মুসলমান যুবক সামাদ ঘোর জ্বর গায়ে ওদের ডেরায় আশ্রয় নেয়। আসলে ভর সন্ধ্যা তখন। ওদের ডেরায় এসে পড়ে গেল যুবক। বালাটের এক মাটির ঘরের একটা ঘরে ওরা আশ্রিত। রাতভর মাথায় জলপট্টি আর তোয়ালে দিয়ে মুছে দিয়ে দিয়ে ভোরের দিকে যুবক চোখ মেলে। প্রায় চার দিন টানা সেবা করে জ্বর নামল। সেদিন কামরাঙার গাছের ফাঁকে সোনালি আলো গলে পড়ে মিনতির মুখে। বাবার শাল জড়িয়ে বসেছিল বারান্দায়। একটু নরম করে ভাত রান্না করে পেঁপের তরকারি দিয়ে খেতে দিয়েছিল।

-জন্মের জন্য ঋণী করে রাখলে আমাকে তুমি। বলতে গেলে নতুন জন্ম দিলে। যদি বেঁচে থাকি স্বাধীন দেশে লাল-সবুজ পতাকা ওড়াব একসঙ্গে। ভাত খেয়ে সেদিন বলেছিল সামাদ মৃধা বাংলাদেশের মেয়েকে সাথি করবে। হিন্দু কী মুসলিম তার ধার ধারে না। চার দিন জীবনের অমূল্য এক সময়। সতেরো বছরের মেয়েটি যেন হঠাৎ নারী হয়ে ওঠে। পরিপূর্ণ এক স্বত্বা তার। সেও বলেছিল—

-তুমি দেশ স্বাধীন করে ফিরে এসো। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব সামাদ। আমার কাছে ভালোবাসাই বড়; জাত-ধর্ম মানি না।

গভীর অন্ধকার। দুদিন থেকে বৃষ্টি হচ্ছে লাগাতার। এই এলাকাটা পাহাড়ি। পানি পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে। তাই রক্ষা। সামাদ এসেছে। সঙ্গে আরেকজন। সামাদ আর মিঠু। দুজনেই নাকি এক ইউনিটে যুদ্ধ করছে। তাদের কমান্ডারের বাড়ি বরিশাল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন ছিলেন। যশোর সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহী অফিসারদের নিয়ে অস্ত্র লুট করে বের হয়ে আসেন। রাতে ওরা খেয়ে দাওয়ায় বাবার খাটিয়ায় বসে বলে এসব কথা। তন্ময় হয়ে শোনে ওরা। ভোরের আলো ফুটছে যখন, তখন কুয়াশার মতো ঝাপসা চারদিক। বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছিল কিছু সময়। তারপর আস্তে করে বলে—

-আমি ফিরব। শুধু তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়েই ফিরব। স্বাধীন দেশে সোনার চুড়ি না হোক হাতভর্তি লাল সবুজ রেশমি চুড়ি পরবে তুমি; আর লাল ডুরে শাড়ি। কপালে সিঁদুর পরে আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকবে। আর আমি কাজ থেকে ফিরলে দুজন একসঙ্গে পিঁড়ি পেতে খেতে বসব।

-আমি চাই দেশ স্বাধীন হোক তাড়াতাড়ি। আমাদের বাড়ির ঠিকানা কী জানো?

-সব জানি।

-কীভাবে?

-বাবার কাছে বসে জেনে নিয়েছি। তোমরা সাবধানে থেকো। দেশ স্বাধীন হলো। বালাট থেকে সবাই ফিরে এল। মিনতিরাও ফিরে এল। প্রতীক্ষা বড় নির্মম। গাছের পাতা ঝরলেও দৌড়াত; ভাবত বুঝি সে এল। কিন্তু এক বছর অপেক্ষায়ও যখন আর ফিরল না সামাদ; খবর পেল সে আর কোনো দিন ফিরবে না। তারপর বিয়ে দিয়ে দিলেন বাবা। মিনতি ঝাপসা চোখে দেখে সাথি মামুনের হাত ধরে গাড়িতে উঠে বসল।

মিনতির চোখে জল। তবু বুকভরে উচ্চারণ করে—‘সুখী হ মা। খুব সুখী হ।’