ছয় বছরের মেয়ে চেলসি মায়ের হাত ধরে ঘন ও ছোট্ট পা ফেলে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। চোখেমুখে আনন্দের ঢেউ। দুই পা যাচ্ছে আর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলছে, থ্যাক ইউ মাম, থ্যাক ইউ। মেয়ের দেওয়া থ্যাক ইউ হুমড়ি খেয়ে উপভোগ করছেন মা। দক্ষিণ আফ্রিকায় ছোট থেকেই মা–বাবা বা অন্যদের প্রতি থ্যাক ইউ অভ্যাসটা করানো হয় শিশুদের।
মায়ের হাতে দারুণ দেখতে একটা কেক। সি থ্রো অর্থাৎ এপাশ দিয়ে ওপাশ দেখা যায় এমন একটা প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা সেটি। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে যত যত্ন করে আলতো হাত কোলে তুলতে হয়, ঠিক তেমনই সেই মা নরম হাতে আগলে রেখেছেন কেকটা।
রাস্তায় যখন তাঁদের মুখোমুখি হলাম, তখন মা–মেয়ের চলাচল বেশ বিনোদনে ভরপুর ছিল। তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। হাই হ্যালো বলে কেন এত পেটভর্তি আনন্দ, তা জানার আবেদন জানালাম মায়ের প্রতি। ছোট্ট মেয়ে বুঝতে চেষ্টা করেনি, আবেদনের উত্তর দেবে কে।
বরং অচেনা মোটা বুড়ো মানুষটিকে দেখে মেয়ের স্ফুলিঙ্গের মতো চটাচট উত্তর—আই এম সিক্স টুডে। দিস ইজ মাই নিউ বার্থডে কেক। ডোন্ট ইট নাও। মাই ফ্রেন্ডস লিজ, সিনা, সাননি, ক্রিমা, এন্থনি অ্যান্ড কাজুল আর কামিং টু মি।
আচ্ছা, বাবা আমি খামু না এখন, এই বলে মেয়েটিকে থামিয়ে দিলাম। কেকটা কিন্তু দেখতে দারুণ সুন্দর লাগছিল। সুতরাং কে বানিয়েছে জানতে চাইলাম। ১০ নম্বর বাসা। বেশি দূরে নয়। পঞ্চাশ বছরের এক ভদ্রমহিলা এ সুন্দর কেকটির কারিগর।
‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ বলে বিদায় নিলাম। মেয়েটির মুখ ফোলানো ভাব দেখে মনে হলো, তার জন্মদিনের সময় থেকে দু–চার মিনিট আমার জন্য কেন কর্তন হলো, তার জবাব চাইছে আমার কাছে।
চলে গেলাম ১০ নম্বরে। ঠকঠক করে কাঠের দরজায় নক করি। দরজা খুলে দিলেন বেশি ধবধবে একজন ফরসা মহিলা। আমিও ফরসা মন্দ নয়। হিংসা করে কে যেন আমাকে ফরসা করে ডাকত, তা ঠিক মনে করতে পারছি না।
ভেতরে যাওয়ার একটু অনুমতি চাইতেই পাস পেয়ে গেলাম। এ দেশের বাড়িঘর বাইরে থেকে দেখতে যা–ই মনে হোক না কেন, ভেতরে কিন্তু বেশি ছিমছাম। সবকিছু একদম পরিপাটি করে গোছানো থাকে। রাস্তায় যেমন গাড়ির দাপুটে হর্ন নেই, তেমনি বাড়ির ভেতরেও ধুলাবালির বালাই নেই।
যথাস্থানে জুতা রেখে ভেতরে গেলাম। স্বামী বসে আছেন সোফায়। স্বামী কিন্তু ফরসা নন, কালোর দিকেই ভারী বেশি। আলাপে বুঝতে পারলাম, প্রেম্পত্য জীবন। জানা গেল, ইতিমধ্যে প্রেমের পরে বিবাহ জীবন পার হয়েছে সাঁইত্রিশ বছর! যেহেতু প্রেমের পর বিয়ে হয়ে দাম্পত্য জীবন চলছে, তাই তাঁদের জন্য প্রেম্পত্য শব্দটি যথাযথ।
হঠাৎ তাঁদের বাসায় যাওয়ার মতলব সম্পর্কে চানতে চাইলেন আমার কাছে। কেক সম্পর্কে জানার কিছু হেতু ছিল বলে জানিয়ে দিলাম তাঁদের।
বেশ কয়েকটি বানানো আছে। সেগুলো তাঁদের অনুমতি নিয়ে দেখলাম। কেউ অর্ডার দিলে বাসাতেই চাহিদামাফিক কেক বানান এই ভদ্রমহিলা। বিবাহ, বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন, বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানের কেক বানান তিনি।
দেখে বোঝা যায়, বিভিন্ন মডেলের কেক বানাতে পারদর্শী তিনি। হাতি, পুল বোর্ড, ফুটবল, বিল্ডিং, বিছানা, জাহাজ, হেলিকপ্টার, ফুল—এ রকম বিভিন্ন ধরনের কেক বানাতে পারেন তিনি। অনেক অর্ডার আসে, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সবার মন রক্ষা করতে পারেন না।
চাকরির পাশাপাশি এই শিল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এখান থেকে প্রতি মাসে ভালো টাকা ইনকাম করেন। তবে সৃজনশীল এই ভদ্রমহিলা জানালেন, একটি কেক থেকে টাকা পেলে ভালো লাগলেও কেক বানিয়ে বেশি তৃপ্তি পাই। ত্রিশ বছর ধরে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত তিনি। মনের আনন্দে গড়ে থাকেন বাহারি স্বাদ ও মডেলের কেক।
‘সূর্য যেমন চাঁদকে আলোকিত করে, তেমন আমার ফরসা স্ত্রী কালোকে আলোকিত করে’ এই বলে স্বামী অট্টহাসি দিয়ে বিদায় জানালেন আমাকে।