গ্রাম থেকে শহরে এসে ভাগ্যের চাকা কতটুকু ঘোরে

কড়াইল বস্তিপ্রথম আলো ফাইল ছবি

জব্বার মিয়া তাঁর ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় গাইবান্ধার একটি নিরাপদ, শান্ত, কিন্তু দরিদ্র গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন ২০১১ সালের দিকে। স্ট্রিট লাইটের গল্প, অর্থ উপার্জনের সুযোগ ও তাঁর সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর সুযোগ ইত্যাদি কারণে তিনি ঢাকা শহরের প্রতি আকৃষ্ট হন। বর্তমানে তিনি কড়াইল বস্তিতে থাকেন, যেখানে তাঁর নিজ গ্রামের তুলনায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, গাদাগাদি অবস্থা, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের অভাব প্রকট। তারপরও তিনি গ্রামে ফিরে না গিয়ে এ বস্তিতেই আবাস গড়েছেন। কারণ, ঢাকায় তাঁর আয় গ্রামে যা ছিল, তার চেয়ে বেশি। কিন্তু ঢাকায় তাঁর বর্তমান আয় পরিবারকে পুষ্টিকর খাবার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। খাবার ও আশ্রয়ের খরচ ঢাকায় অনেক বেশি। উন্নতির আশায় গ্রাম ছেড়ে আসা জব্বার মিয়া ঢাকায় আছেন প্রায় ১১ বছর হলো, কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষিত উন্নতি তাঁর আর হলো কই? তবে কেন গ্রামের এ সহজ-সরল জীবন ফেলে ঢাকার নির্মম বাস্তবতায় দিনযাপন জব্বার মিয়ার মতো লাখো নিম্ন আয়ের মানুষের?

এমন অনেক জব্বার মিয়ার ভাগ্য উন্নয়নশীল দেশের শহরগুলোর একটি নিম্ন-অর্থনৈতিক বিকাশের ফাঁদে আটকে আছে। তবুও ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে বসবাস ও কাজ করলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে, বিশেষ করে গরিব ও উন্নয়নশীল বিশ্বে, এটাও গবেষণায় প্রমাণিত। যদি জনবসতির ঘনত্বের সঙ্গে মজুরির স্থিতিস্থাপকতা হিসাব করা হয়, তখন দেখা যায়, ঘনত্বের উৎপাদনশীলতা উন্নত দেশের শহরগুলোতে কম (আমেরিকায় ০.০৪৩,  ফ্রান্সে ০.০৩, চীনে ০.১৯) আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বহুগুণ বেশি (ভারতে ০.১২ ও আফ্রিকায় ০.১৭)। এ সংখ্যাগুলো দিয়ে আসলে কী বোঝায়? তার মানে আমেরিকার নিউইয়র্কে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১০ শতাংশ বাড়লে উৎপাদন বাড়ে মাত্র ০.৪ শতাংশ আর আফ্রিকা কিংবা বাংলাদেশে সেটা ১.৭ শতাংশ (প্রায় ৪ গুণ)। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসা এই মানুষেরা যদিও জনবসতির ঘনত্ব আরও বাড়াচ্ছে, কিন্তু অপর দিকে অর্থনীতিতে উত্পাদনশীলতায় বিরাট অবদান রাখছে। প্রতি ঈদে জব্বার মিয়ারা গ্রামে ফিরে গেলে ঢাকায় যাঁরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন, তাঁরা অন্তত একবার জব্বার মিয়াদের অবদানটুকুও মনে রাখবেন।

কিন্তু যদি আমরা জব্বার মিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করি, তাহলে ওপরের এ সংখ্যাগুলোকে অমূলক বলে মনে হয়। কারণ, আরও বিস্তৃতভাবে বললে, আফ্রিকার শহুরে জনসংখ্যার প্রায় ৫৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশে তদুপরি দক্ষিণ এশিয়ায় ৩৮ শতাংশই বস্তিতে বাস করে। এত বিশাল একটি জনগোষ্ঠী এত বছর ধরে যদি নিম্নমানের জীবন যাপন করে, তাহলে ঘনত্বের উৎপাদনশীলতার আসল সুবিধা কোথায়?
তাহলে কীভাবে আমরা এ স্থিতিস্থাপকতার (ইলাস্টিসিটি) অনুমান বাস্তবতার সঙ্গে সমন্বয় করব? আর্তি গ্রোভারসহ একদল গবেষক সম্প্রতি ১৯৭৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩টি দেশের শহুরে উৎপাদনশীলতার ১ হাজার ২০০-এর বেশি নমুনা পরীক্ষা করেছেন। এ গবেষণার জন্য তাঁরা উন্নয়নশীল দেশের বেশ কয়েকটিসহ বিশ্বের শত শত শহর থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। উপরন্তু জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ, যানজট, পরিবেশদূষণ, শহুরে থাকা-খাওয়ার খরচ কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, সেটাও তাঁরা নির্ণয় করে দেখিয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো, তাঁদের গবেষণায় দেখা যায়, জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়লে উৎপাদনের গতি উন্নত দেশগুলোর থেকে অনুন্নত দেশগুলোতে গড়ে ৫ শতাংশের বেশি। তাহলে গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে উন্নয়নশীল দেশের লোকেরা শহরে বসবাস করে বেশি উপকৃত হয়।

ফাইল ছবি

কিন্তু গভীর ও বিস্তৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষা একটি ভিন্ন চিত্র বলে। উদাহরণস্বরূপ, নামমাত্র মজুরি বা শ্রম উত্পাদনশীলতা ব্যবহার করে সমষ্টিগত সুবিধার যে অনুমান করা হয় গবেষণায়, সে সম্ভবত মজুরির একটি অংশ উচ্চ মূলধনের কারণে হয়। সম্ভবত শহরাঞ্চলে অধিক পুঁজির ফলস্বরূপ, দক্ষতা বা বাড়তি ঘনবসতির জন্য নয়। কিছু গবেষণায় এটাও প্রমাণিত হয় যে দক্ষ কর্মীরা ঘনবসতিপূর্ণ শহরের প্রতি আকৃষ্ট হন, যা তাঁদের আরও উৎপাদনশীল করে তোলে। কিন্তু জব্বার মিয়ার মতো মানুষেরা প্রচলিত সমাজে দক্ষ বলে বিবেচিত হন না। সুতরাং পরিসংখ্যানের সংখ্যার সুবিধাগুলো তাঁরা ঠিকভাবে পান না। আবার শহরে অতিরিক্ত খরচের চাপে পড়ে উৎপাদনের যে সুবিধার কথা বলা হয়, সেটাও প্রায় শূন্যের কোটায় চলে যায়। তাই বছরের পর বছর জব্বার মিয়াদের ভাগ্য আর পরিবর্তিত হয় না। পরিসংখ্যানে শুধু অর্থনৈতিক সংখ্যাই দেখানো হয়। কিন্তু বাদ পড়ে যায় উচ্চ আবাসন খরচ বা পরিবহনে হারিয়ে যাওয়া সময় কিংবা দূষণ এবং অপরাধের মতো শহুরে অসামঞ্জস্যতাগুলো। এগুলোর জন্যও তো ক্ষতিপূরণ গণনা করা উচিত।

দূষণ, যানজট ও অপরাধের ক্ষেত্রে শহুরে অসামঞ্জস্যতা সম্পর্কে গ্রোভারের গবেষণা প্রমাণ করে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শহুরে বৈষম্য বেশি। শহরের গড় জনঘনত্বের জন্য উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে ১৯ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কম সময় যানজটে অপচয় হয়, দূষণ ১৬-২৮ শতাংশ কম এবং হত্যার হার প্রায় চার গুণ কম। বিশেষ করে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের হার উন্নয়নশীল দেশে খুব বেশি (২৪ শতাংশ) আর উন্নত দেশে সেটা নেতিবাচক (-৫৬ শতাংশ)। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, যদি অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত শহুরে খরচগুলো হিসাব করা হয়, উন্নয়নশীল দেশে সমষ্টিগত স্থিতিস্থাপকতার মাত্রা অনেক কম, এমনকি নেতিবাচক হবে। এতেই বোঝা যাচ্ছে, উন্নত দেশে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষদের উন্নতি অল্প পরিমাণে হলেও গরিব দেশগুলোতে কার্যত তাঁদের জীবনযাত্রার তেমন কোনো উন্নতি নেই। আবার অতি ঘনবসতির কারণে শহরগুলোতে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং এতে অনেক জব্বার মিয়া জড়িয়ে পড়ছেন। নগর উন্নয়নের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘অকাল নগরায়ণ’।

ছবি: লেখক

এ ফলাফলগুলো থেকে আমরা কি সত্যিই আশা করতে পারি যে গ্রাম থেকে ঢাকার মতো অকার্যকর শহরে জব্বার মিয়ার মতো মানুষের আগমন তাঁদের দারিদ্র্য থেকে বের করে আনবে? চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, একটি শহর তখনই উৎপাদনশীল হয়ে ওঠে, যখন নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের গতিশীলতা ও জাতীয় অর্থনীতির ব্যাপক কাঠামোগত রূপান্তর হয়। এ কাঠামোগত রূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করে, এমন সমস্যাগুলো দূর করার দিকে আমাদের এখনই মনোনিবেশ করা উচিত। তবেই ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো শহরগুলো অর্থনৈতিক ঘনত্ব অর্জন করবে, উচ্চতর উত্পাদনশীলতা অর্জন করবে। আর এতে আরও অনেক জব্বার মিয়ার গ্রাম ছেড়ে আসার স্বপ্নপূরণ হবে, সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক দৈন্য কিছুটা হলেও লাঘব হবে। আর সেটা না হলে একসময়ের কার্যকর শহর অকার্যকর আর নৈরাজ্যের শহরে পরিণত হবে।

*লেখক: মিরাজ আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ; গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকস। ([email protected])