গৌরবের সমাবর্তন

বক্তব্য রাখছেন ভাইস চ্যান্সেলর স্যুজান ফর্টিয়ার
ছবি: সংগৃহীত

বিষয়টি আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের, আবেগেরও। শ্রম আর মেধার স্বীকৃতি পাচ্ছে তারা। তাদের প্রত্যেকের অর্জন জ্বলজ্বল করে জানান দিচ্ছে, তুমি সত্যিই সেরা। তোমাকে নিয়ে সে জন্যই গর্ব করা যায়। সমাবর্তনে আজ শামিল হয়েছে সেরা শিক্ষার্থীরা। তাদের আত্মীয়স্বজন আছেন এই কাতারে। আমি এদের মধ্যেই একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আমার কন্যা পূর্বা নিমন্ত্রণ জানিয়েছে।

সেভাবেই এখানে আসা। আমন্ত্রিত ছিলাম পরিবারের আরও দুজন। ছোট কন্যা দূর্বা এবং আমার সহধর্মিণী লাকি হালদার উল্কা। কিন্তু প্রথমজনের পরীক্ষার কারণে আমরা ভাগ হয়ে গেছি। তা হোক, সমাবর্তনের আনন্দ থেকে বিযুক্ত থাকতে পারে না অন্যরা। তাই তো নির্দিষ্ট সময় পরপরই যোগাযোগ হচ্ছে তাদের সঙ্গে।

শিক্ষার বিষয় নিয়ে এক জায়গায় হওয়ার নামই সমাবর্তন। ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির এ ক্যাম্পাসে আমরাও তাই। দলে দলে কম হইনি। কন্যাভাগ্য আমার। যেখানে যাই, সেখানেই কন্যাযোগ হয়। এখানেও আরও তিন কন্যা। মাহারু রহমান, লেয়া কাসাব আর রোদসী রহমান। মাহারু ঢাকার মেয়ে। কয়েক দিন ও ছিল চুপচাপ। আকাশে তখন মেঘ জমেছে।

গাউন পরা মাহারু ও পূর্বা
ছবি: সংগৃহীত

ওর মা-বাবা আসতে পারেননি এই অনুষ্ঠানে। ভিসা জটিলতার কারণে আরও এমন ঘটনা আছে। হঠাৎ করেই দৃশ্যপট বদলে যায়। আয়োজন অনুষ্ঠানের কাছাকাছি সময়ে চকচকে চোখে পূর্বার দিকে তাকিয়েছিল সে। মাহারু বলেছিল, আমরা অভিভাবক থেকে বঞ্চিত হইনি। মূলত আমাকে নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল।

২ জুন ২০২২। বিশ্ববিদ্যালয় যেন নতুন করে সেজেছে। জয় হে আলোর পথযাত্রী। তোমার অগ্রযাত্রা সফল হোক। ইউনিভার্সিটির সংগীত গাওয়া হচ্ছিল। ঈশ্বরের প্রশংসা করছি। শ্রদ্ধায় আমাদের মাথানত হয়ে আসছে। আমরা তোমাদের জয়গান গাই। ঈশ্বরের কৃপায় ম্যাকগিল বেঁচে থাকবে যুগের পর যুগ। কী বিস্ময়কর কথামালা! আমরা গান শুনি আর এর সুর এবং আবেদনের সঙ্গে একাত্ম হই।

পূর্বা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক। মাহারু সফটওয়্যার আর রোদসীর সমাবর্তন হয়েছে এক বছর আগে। সে আজ এদের তীর্থসারথি। গাউন সংগ্রহ থেকে সাজসজ্জা—সবকিছুর সঙ্গেই আছে। তবে এখন এখানে এ গ্যালারিতে আমরা এই দলের দুজন। ভালোই হয়েছে, রোদসীর কাছে আমি অনেক কিছুই জানতে পারছি। গতকালও বাসপথে অনেক শিখেছি ওদের কাছে।

কথা–গল্প, সবই মিষ্টিমধুর আমেজ সৃষ্টি করেছে। আমি টরন্টোতে আসার আগেই ওরা বাসের টিকিট একসঙ্গে কেটেছে। মনে করছি, আগামীকাল যাওয়ার সময়ও অনেক শিখব।

আজ স্নাতক হচ্ছে যে শিক্ষার্থী, তার জন্য দিনটি সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু স্কুল-কলেজের পরবর্তী ধাপ নয়; বরং জ্ঞান আহরণের মধ্য দিয়ে ঐশ্বর্যে সাহসে আলাদাভাবে গড়ে ওঠার জন্য অন্য এক তীর্থস্থান।

লেয়া এসেছে লেবানন থেকে। সেও ইলেকট্রিক্যালের। প্রায় একই সঙ্গে চলাফেরা আরও আরও বন্ধুদের। আমির শাহ আবুধাবির মেরিল্যান্ড স্কুলের ছাত্র ছিল। তারও ছোট বোন পড়ে দূর্বার সঙ্গে। রসায়নকৌশল থেকে স্নাতক হলো সে। ওরা মূলত জম্মু কাশ্মীরের। বন্ধুত্বের নবায়ন হলো তাদের।

অতিথিরা
ছবি: সংগৃহীত

দেখা হলো সুধীর নায়ারের সঙ্গে। ভ্যাঙ্কুভার তাঁদের আবাসস্থল। গোটা পরিবার নিয়ে দক্ষিণ ভারতের এই ভদ্রলোক ঘুরছেন এই অঙ্গন। তাঁর কন্যা শ্রুতি নায়ার আজকের স্নাতক। উল্লেখ্য, পূর্বা এবং শ্রুতি ‘প্রমোটিং অপরচিউনিটি ফর উইমেন ইন ইঞ্জিনিয়ারিং’–এর সদস্য। সংক্ষেপে লেখা হয় ‘পিওডব্লিউই’। প্রকৌশলবিদ্যায় মেয়েদের সুযোগ সৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত এ সংগঠন। তারা ১১ সদস্যের দুই সহসভাপতি। এখন বিদায় নিল। দুজনের পরিবারের কাছেই এই দুই নাম বড় পরিচিত। শ্রুতি পুরকৌশল থেকে পাস করল।

সংগঠনের সভাপতিও দুজন। একজন যুক্তরাষ্ট্রের জুলিয়া স্ট্রাউস। অন্যজন লক্ষ্মী রায়। বাংলাদেশে জন্ম না হলেও বাঙালি পরিবারেরই সন্তান। নায়ার পরিবারের সঙ্গে এই নিয়ে আন্তরিক আলাপ হলো।

কথাগুলো মিলে যায়। মঞ্চে পণ্ডিতজনেরা তরুণদের ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, এখানে বৈচিত্র্যের মধ্যে কাজ করে তাদের অনেক অনেক অর্জন। ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ আর জাতিগত বৈচিত্র্যের শক্তি আছে। এ শক্তিকে নিজের মধ্যে ধারণ করার শিক্ষা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। দৃঢ় ইচ্ছা আর ক্ষিপ্রতা নিয়ে এখন এগিয়ে যাওয়ার পালা। তারা আরও জোর দিয়ে বললেন, নেতৃত্বে এদের বড় প্রয়োজন।

বিশ্বকে উৎকৃষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য এ প্রাঙ্গণ তার প্রেরণা। এদের সাফল্যে পরিবেশ আজ উচ্ছ্বসিত। লেয়া তার মা–বাবার সঙ্গেই দাঁড়ানো। পরিচয় হলো। মন্ট্রিয়েল শহরের অন্য প্রান্তে তাঁরা থাকেন। এই দলের সঙ্গে এই পরিবারের সখ্য খুব শক্তিশালী। গত ক্রিসমাস ডেতে ওরা তাদের বাসায় গিয়েছিল।

আগের মতোই আজও সন্তানের আদরে সিক্ত হলো ওরা। তাদের যোগ যেমন আজ এই ক্যাম্পাসের সঙ্গে, তেমনি তারা সম্পৃক্ত নিজের দেশে ও সমগ্র বিশ্বে। মাহারু ঢাকার মাস্টারমাইন্ডের মান রেখেছে। ম্যাকগিল ডিবেটিং ইউনিয়নের হয়ে বিতর্ক করেছে টানা সময়। সম্মান এনেছে বাঙালির।

সমাবর্তনে পূর্বা ও রোদসী।
ছবি: সংগৃহীত

স্যুজান ফর্টিয়ার এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ এবং উপাচার্য। বললেন দৃঢ়তার সঙ্গে। দেয়াল নয় কোনো রকম। এসব প্রশ্রয় পাবে না, পেতে পারে না! কণ্ঠ আরও কঠিন হয়ে আসে, এসব ভেঙে ফেলতে হবে। বলেন, সীমানাপ্রাচীর থাকা কোনো অর্থেই ঠিক নয়।
লড়াইয়ের স্পৃহা আর প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি করে দিয়েছে এ বিদ্যাকেন্দ্র। পরিবেশ যেন আহ্বান করছে, মোকাবিলা কর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।’ এক হয়ে এক সূত্রে যুদ্ধ করার তাগিদ বিশ্ববিদ্যালয়েরই। আমরা প্রতিধ্বনি শুনছি, লড়াই করো। যৌবনে লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই। বলছে, জটিলতা থাকবে, তবে জিতবে। মা, মাটি, মানুষের ভালোবাসা স্বর্গীয়। সে কারণে মায়ের জন্য প্রাণ দিতেও দ্বিধা করে না তার সন্তান। বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনীও যায় না খসে। যুদ্ধ, ভালোবাসা, পরীক্ষা এক হয়ে যায়।

নায়ার পরিবারের সঙ্গে আমরা
ছবি: সংগৃহীত

সক্রেটিসের কথা, অপরীক্ষিত জীবন অর্থহীন। আশাবাদী মানসিকতা জাগাতে হবে। অন্ধকার সময়ে সেটাই জীবন। আমাদের সৌন্দর্য ঐক্যের মধ্যে। তবে এটাও ঠিক। কোনো কোনো সময়ে একাই পাড়ি দিতে হবে সুদীর্ঘ পথ। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’

অভিভাবক শিক্ষকদের আশীর্বাদ নিয়ে তারা এগোচ্ছে। সুবিস্তৃত হল। আমরা দেখছি দীর্ঘ পর্বটি। গাউন পরে ক্যাপ হাতে কিংবা মাথায় নিয়ে সামনে আসছে তারা বীরদর্পে। হাতের সরু একটি দণ্ড দিয়ে স্নাতকদের স্কন্ধে স্নেহের মৃদু স্পর্শ বুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাফল্যের স্বীকৃতি নিয়ে তারা সামনে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে।

হাততালি আর মুক্তকণ্ঠের অভিনন্দন জানাচ্ছে বন্ধুরা। স্নাতকেরা আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভরে দিচ্ছে গোটা চরাচর। দেখিয়ে দিচ্ছে, এই তো যৌবন, এই তো বাধাবন্ধনহীন জীবন।

পূর্বার লেবানিজ বন্ধু লেয়া কাসাব
ছবি: সংগৃহীত

আরও আরও বিদগ্ধ পণ্ডিত বক্তব্য রাখলেন অনুষ্ঠানে। কী দরদ আর মহানুভবতা! বিদ্বান মানে এমনই। বললেন, দুর্বলদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে দেবে না। কানাডার জাতীয় সংগীত বাজল, ‘ও কানাডা! ও আমার নিজ আবাসভূমি!’ প্রকৃত দেশপ্রেমিক চলে আলোকিত চিত্তে। আমরা সেটাই দেখতে পাই।

কেমন লাগে এ মুহূর্তে, প্রশ্নটি বাড়ি খায় মাথা ও মগজে। ওদের কাছে শোনা হয়ে ওঠে না। বিশ্বাস করি, শিক্ষার্থীর মনের এ অনুভূতি জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখানুভূতিরই একটি। শুধু কি তার? না, সমাবর্তনের এ আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়ছে মা-বাবার অন্তর পর্যন্ত। এ ঢেউয়ের অনুভূতি আবেশের, আনন্দের, গৌরবেরও।