গোল্ডকোস্টে নববর্ষের অনুষ্ঠানে বাংলা ও বাঙালিত্ব

অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন অতিথি শিল্পী সুচরিতা ভট্টাচার্য
অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন অতিথি শিল্পী সুচরিতা ভট্টাচার্য

আমার সৌভাগ্য, এ বছর বাংলা নববর্ষ দুই দেশে পালন করলাম। নিজের দেশ বাংলাদেশ ও দূর পরবাস অস্ট্রেলিয়ায়। যেদিন যথার্থ অর্থে পয়লা বৈশাখ, তখন আমি বাংলাদেশে ছিলাম। নববর্ষের একদিন আগে-পরে আমি আমাদের গ্রাম মুরাদনগর ও ঢাকা শহরে ছিলাম।

আর ২৮ এপ্রিল (১৫ বৈশাখ) গোল্ডকোস্টের বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন নেরাংগ বাইসেন্টিনিয়াল হলে খুব ঘটা করে বাংলা নববর্ষ পালন করল। আমার সহধর্মিণী জলি ও আমাদের ছেলেমেয়েরা সাদা-লাল রঙের শাড়ি ও পাঞ্জাবি পরে সময়ের আগেই অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছেছিল। আমার যথারীতি ডিউটি থাকায় অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছতে একটু দেরি হয়েছিল। কিন্তু অনুষ্ঠানসূচি ছিল বেশ দীর্ঘ। সেই বিকেল ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ব্যাপ্তি ছিল।

অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন নিক্সন ফয়সাল
অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন নিক্সন ফয়সাল

কী ছিল না অনুষ্ঠানে। বাচ্চাদের নাচ, যেমন খুশি তেমন সাজ, নাটক এবং একক ও দলীয় গান। বড়দের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল স্থানীয় শিল্পীদের একক ও দলীয় গান দিয়ে। স্থানীয় শিল্পীদের মধ্যে নিক্সন ফয়সালের গান তো বরাবরই আমাদের মুগ্ধ করে। আমাদের সৌভাগ্য, তার মতো একজন গুণী শিল্পী গোল্ডকোস্টে আমাদের বাঙালি কমিউনিটিতে আছেন। তবে এবারের বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে বিশেষ চমক ছিল টুউম্বা শহর থেকে আসা অতিথি শিল্পী সুচরিতা কর্মকারের গান। কী অসাধারণ গলা তাঁর, সুরের কী দারুণ কারুকাজ। তিনি গ্রামবাংলার পল্লিগীতি, বৈষ্ণবী ও ভাটিয়ালি গান গেয়ে আমাদের মাত করে রেখেছিলেন। তার গানের উদ্দামতায় উদ্বেলিত হয়নি হলের এমন কেউ নেই। ছোটবড় সবাই গানের তালে তালে যথাস্থানে বসে বা স্টেজের কাছে গিয়ে নেচেছে। সহধর্মিণীরা একপাশে তো, অন্যপাশেই স্বামীরা আবেগে ভালোবাসায় নেচে উঠেছেন। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, আমাদের বিখ্যাত তরুণ বিজ্ঞানী, ক্যানসার নির্ণয়ের যন্ত্র আবিষ্কারক ড. মুহাম্মদ এ জে সিদ্দিকী যখন স্টেজের কাছে গিয়ে গানের তালে তালে নেচেছেন। এই বিখ্যাত মানুষটা বাংলা নববর্ষ ও বাঙালি আবেগের প্রশ্নে কীভাবে একটা ছোট্ট শিশু হয়ে উঠেছিলেন।

বাচ্চাদের নাটক হীরক রাজার দেশে
বাচ্চাদের নাটক হীরক রাজার দেশে

শুধু মুহাম্মদ এ জে সিদ্দিকীই নন, আমরা বিভিন্ন বয়সী সবাই কি গোল্ডকোস্টের এই বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে গিয়ে বাংলা ও বাঙালিত্বর প্রশ্নে সত্যি ছোট্ট শিশুটি হয়ে উঠিনি? হ্যাঁ, হয়ে উঠেছি। যথার্থ হয়ে উঠেছি। তৎক্ষণাৎ সেই ছোট্ট শিশু বয়সটায় ফিরে গেছি। ২৫ পয়সার ভেঁপু বাঁশি, ৩০ পয়সার বাঁশের বাঁশি, ৫০ পয়সার মাটির ঘোড়া বা এক টাকার একটা ছোট্ট ঢোলক। ১০ পয়সায় একটা ঝুনঝুনি কিনতাম। ৪০ পয়সার বেলের শরবত। মেলায় ২৫ পয়সার সকাল-বিকাল আইসক্রিমটা ছিল আমাদের খুব পছন্দের। আসলে সেটা আইসক্রিম ছিল না, ছিল লাল-সাদায় দুই রঙের আইস ব্লক।
মনে পড়ে, একবার আমার মা মেলায় আইসক্রিম কিনে খাওয়ার জন্য আমাদের দুই ভাইকে এক টাকার একটা নোট আলাদা করে দিয়েছিলেন। সেই হরিণের মাথা মার্কা নোট। শুধুমাত্র মেলায় আইসক্রিম খাওয়ার জন্য মা কখনো আলাদা করে এক টাকা দিতেন না। আমরা পয়সা বাঁচিয়ে ২৫ পয়সা দামের সকাল-বিকাল আইসক্রিম খেতাম। কিন্তু সেবার মা আলাদা করে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য এক টাকা দেওয়ায় আমরা পিঠাপিঠি দুই ভাই এটন ও আমি সেকী খুশিতে আঁটখানা। পুনোয়ারার মেলায় গিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, আলাদা করে ৫০ পয়সা দামের প্যাকেটের আইসক্রিম না খেয়ে দুই ভাই মিলে এক টাকা দিয়ে একটা প্যাকেটের মালাই আইসক্রিম খাব।...সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক টাকা দিয়ে একটা মালাই আইসক্রিম কিনি। কিন্তু খেতে গিয়ে একটা বিপত্তি ঘটে। সেটা হলো, কে আগে খাবে ও কে পরে খাবে। পরে সমঝোতায় আসি, আমরা দুজন আইসক্রিমটা হাতে নিয়ে পালাক্রমে দুবার কিংবা তিনবার করে চুষব। তারপর হাত বদল হবে। আমরা তাই করছিলাম।

বড়দের কাব্যনাটক টিকাটুলির মোড়
বড়দের কাব্যনাটক টিকাটুলির মোড়

কিন্তু আইসক্রিম চুষতে গিয়ে নতুন সমস্যা দেখা দেয়। যখন একজন আমরা আইসক্রিম চুষছিলাম, আইসক্রিমের নিচ দিয়ে টুপটুপ করে বরফগলা ঝুল পড়ে যাচ্ছিল। আমরা উভয়েই ভাবি, এক টাকা দামের মালাই আইসক্রিমের ঝুল মাটিতে পড়ে যাবে! হতেই পারে না। তাই আমরা একজন যখন আইসক্রিমটা চুষছিলাম, অন্যজন নিচ দিয়ে হাঁ করছিলাম যাতে আইসক্রিমের ঝুল আমাদের মুখের ভেতর গিয়ে পড়ে।
আইসক্রিমটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাই করেছিলাম। তখন আমাদের বয়স কত ছিল? ১১ কী ১২। সেই সত্তর দশকের শেষ বা আশির দশকের প্রথমদিকের ঘটনা।
আমি আমাদের বাল্যকালের অমূল্য স্মৃতিটুকু এ জন্যই লিখলাম যে, এবার বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের কিছু ঘটনায় আমার ভেতর বেশ ক্ষোভ বা আক্ষেপের জন্ম দিয়েছে। গ্রামে বা শহরে মানুষজনের বাংলা নববর্ষ পালনের যে ছিরি দেখলাম!...ঢাকাকেন্দ্রিক মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনার মেলা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মোড়ে পান্তা ভাত, কাঁচা মরিচ বা ইলিশ মাছ ভাজা—এসব না হয় ঠিক আছে। ঢাকা শহরটাকেও রংবেরঙের সাজানো হয়েছে। এ তো নাগরিক জীবনের বাংলা নববর্ষ। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে বা ছোট্ট শহরগুলোতে সেই বাংলা নববর্ষ কোথায়? আমাদের সেই গ্রাম, যেখানে বৈশাখ মাসের এক-দুই সপ্তাহ মুখর হয়ে থাকত আমাদের ভেঁপু বাঁশি, বাঁশের বাঁশি বা ঝুনঝুনির শব্দে। সারাক্ষণ অসংখ্য ছোট্ট ঢোলকের শব্দ হতো—টাক-ডুমা-ডুম-টাক-টাক, টাক-ডুমা-ডুম! সেই যোগেশ বা নরেশ পোদ্দারের মুদি দোকানের হালখাতা, পিরিচ ভর্তি জিলাপি-রসগোল্লা।...বদির স্যারের সেই আদর্শ বাণী-‘...শোন, বছরের প্রথম দিন মিথ্যা কথা বললে কিন্তু সারা বছর শুধু মিথ্যা বলবি। তাই কোনো মিথ্যা কথা নয়, কোনো দুষ্টামি নয় বা কারও গাছের ফল চুরি নয়...।’ আমরা সারাটা দিন চেষ্টা করতাম আদর্শ ছেলে হয়ে থাকতে। এমনও হয়েছে, সারা দিন আমাদের অশীতিপর বৃদ্ধ অদন দাদার পাশে বসে ভালো থাকার জন্য তসবি জপতাম।
দীর্ঘদিন পর এবার আমাদের গ্রামে গিয়ে বাংলা নববর্ষের সময়টায় একবারের জন্য তো একটা বাঁশির শব্দ বা ছোট্ট ঢোলকের শব্দ শুনিনি। আমাদের সেই পুনোয়ারার মেলা আজ আর বসে কিনা জানি না। গোমতীর আইল ধরে বহুদূর হেঁটে গিয়েও কারও মুখে শুনিনি—‘শুভ নববর্ষ’। কিংবা বদির স্যারের মতো কোনো শিক্ষক এসে ১১-১২ বছরের কোনো ছেলেকে বলতে শুনিনি, ‘...শোন, আজ কিন্তু বাংলা নববর্ষ। কোনো মিথ্যা কথা বলবি না। সৎ কাজ করবি...।’

অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাহমুদুল হাসান পলাশ ও মণিকা শবনম
অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাহমুদুল হাসান পলাশ ও মণিকা শবনম

তাহলে আমাদের গ্রামগুলো থেকে কি সেই শিল্প-সংস্কৃতি উঠে গেছে? সেই ঐতিহ্য? জানি না। হয়তো। হয়তো বলছি এ জন্য, আমার ও আমার ছোট ভাইয়ের মালাই আইসক্রিম খাওয়ার গল্পটা তো মাত্রই তিন-সাড়ে তিন দশক আগের ঘটনা। আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, বর্তমানে বাংলাদেশের কোনো গ্রামের ১১-১২ বছরের কোনো ছেলের মুখ থেকে এমন করে মালাই আইসক্রিম খাওয়ার গল্প শোনা যাবে না। আমরা যে কোনো গরিব ঘরের সন্তান ছিলাম, তা নয়। বরং আমরা গ্রামে কাজীবাড়ির সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানই ছিলাম। আশির দশকের শুরুতে যখন পুরো মুরাদনগর উপজেলায় দুইটা কী তিনটা টেলিভিশন ছিল, তখন আমাদের ঘরে উনত্রিশ ইঞ্চি ফিলিপস সাদাকালো টেলিভিশন ছিল। এটা কোনো গল্প নয়। কিন্তু আমাদের বাবা-মা আমাদের জন্য মেলায় আইসক্রিম খাওয়ার জন্য এক টাকাই বরাদ্দ দিয়েছিলেন।

সপরিবারে নববর্ষের পোশাকে লেখক
সপরিবারে নববর্ষের পোশাকে লেখক

প্রায় আড়াই দশক ধরে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করছি। এখানে তো ওদের সেই শিল্প, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের এমন দ্রুত পরিবর্তন দেখিনি? বলা যায়, ওদের শিল্প, সংস্কৃতি ঐতিহ্য একরকম অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। কিন্তু আমাদের দেশে এসবের এত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে কেন? এটা কীসের লক্ষণ? জানি না।...বাংলাদেশে গিয়ে যখন দেখি, গ্রামের ১১-১২ বছরের ছেলেরা লুঙ্গি ছেড়ে ব্রাশ জিনস পরে, হাতে দামি চ্যাপ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, তখন ব্যাপারটা অপরিচিত মনে হয়। হয়তো বলবেন, যুগ পাল্টাচ্ছে। টেকনোলোজির যুগ। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডে কি টেকনোলোজির যুগ আসেনি? এখানে কেন সেই পরিবর্তন চোখে পড়ে না? আচ্ছা, না হয় মানলাম যে টেকনোলোজির যুগ। কিন্তু এটা কী কষ্টের ব্যাপার নয় যে, গ্রামের সেই ১১-১২ বছরের ছেলেরা বাংলা নববর্ষের দিন কোথায় মেলায় যাবে, তা নয়। ওরা ব্রাশ জিনস পরে গোমতীর আইল ধরে চ্যাপ্টা মোবাইলে লাউড ভলিউমে লেটেস্ট হিন্দি গান বাজাতে বাজাতে যায় ‘...বাম চিকি চিকি বাম বাম, চিকি বাম বাম...।’ চিকি মানে যুবতী মেয়ে। আর বাম মানে যুবতী মেয়ের পেছন!...বাংলা নববর্ষে আমাদের সেই গ্রামের একজন ১১-১২ বছরের ছেলের এসব গান শুনতে দেখে সত্যি শঙ্কিত না হয়ে পারি না।

মেলায় ঝালমুড়ি ও মিষ্টির দোকান
মেলায় ঝালমুড়ি ও মিষ্টির দোকান

লেখাটা শুরু করেছিলাম এই গোল্ডকোস্টে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে আমাদের বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান উদ্‌যাপন নিয়ে। গোল্ডকোস্ট শহরে আমাদের বাঙালি কমিউনিটির ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো বৈশাখী মেলা হলো। মেলায় স্টলগুলোও বেশ সুন্দর সাজিয়েছিল। পিন্টু ভাই ও জাকিয়ার ‘লাইলি-মজনুর ঝালমুড়ি’ ও মিষ্টির দোকান, ঈশানের টক-ঝাল-মিষ্টি চটপটির দোকান, শাড়িঘর, মেহেদি, সানাউল্লাহ ভাইয়ের হালিম, ছোট্ট আফ্রিদার আর্টের দোকান এবং আরও কত কী!
মাহমুদুল হাসান পলাশ ও মণিকা শবনমের চমৎকার উপস্থাপনায় বাচ্চা ছেলেমেয়েদের যেমন খুশি তেমন সাজ। ‘হীরক রাজার দেশে’ নামে একাঙ্কিকা নাটক। বাঙালি ঢঙে লুঙ্গি-গামছা পরে ফ্যাশন শো ও নাচ-গান। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরিফ সাঈদের শুভেচ্ছা বক্তব্য। বড়দের-‘টিকাটুলির মোড়’ নামে কাওয়ালির ঢঙে একাঙ্কিকা কাব্যনাটক। দলীয় ও একক গান। বাংলা সিনেমার গানের তালে তালে কপোত-কপোতদের নাচ, টুউম্বা ও ব্রিসবেনের অতিথি শিল্পীদের গান এবং স্থানীয় শিল্পীদের গানে গানে কখন যে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা চলে গিয়েছিল, টেরই পাইনি। রাত ১১টায় যখন অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল, তখন মনে হলো, আহা, অনুষ্ঠান এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল!

মহিবুল আলম: গোল্ডকোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>