গৃহকাজে নারীর নিজস্ব মূল্যায়ন
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী দিবসকে সামনে রেখে বিশ্বের সব নারীকে শুভেচ্ছা। ব্যক্তিগতভাবে আমি নারীবাদে বিশ্বাসী নই, তবে নারীর যথার্থ সম্মানে বিশ্বাসী।
নারীর গৃহস্থালির কাজ নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা-সমালোচনা হয়ে আসছে। নারীর গৃহকাজকে অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করে আর্থিকভাবে মূল্যায়ন করার জন্য বা স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য নারী অধিকারকর্মীরা সর্বদাই সোচ্চার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁরা এই গৃহস্থালির কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, তাঁরা এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন!
আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীর কাজকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে—ঘরের কাজ ও বাইরের কাজ। কারণ, অনেক নারীই এখন ঘরের কাজের পাশাপাশি বাইরে গিয়ে কাজ করে অর্থ উপার্জন করছেন। এ শ্রমবিভাজন আবার পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। পুরুষদের ‘ঘরের কাজ’ শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত নই, বরং আমাদের সমাজে কেমন যেন বেমানান শব্দটি। যা-ই হোক, নারী-পুরুষের সমঅধিকার আমার লেখার বিষয় নয়। আমার আলোচ্য বিষয় নারীর গৃহকাজ নিয়ে তাঁর নিজস্ব ভাবনা।
সব নারীর বাইরে গিয়ে কাজ করার বাধ্যবাধকতা, সুযোগ বা ইচ্ছা না থাকলেও যাঁরা গৃহস্থালির কাজ করেন, তাঁদের সর্বক্ষণ গৃহকাজের চাপে ব্যস্ত থাকতে হয়। এই নারীরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গৃহকাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে করে যান। আর যেসব নারী বাইরে গিয়ে কাজ করেন, তাঁদের কাজের চাপ অনেক ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হয়ে যায়। গৃহস্থালির কাজে যে নারীরা নিয়োজিত, তাঁদের কাজ কম নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক গুণ বেশি; বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের ক্ষেত্রে। আবার সমাজে এমন কিছুসংখ্যক নারীও আছেন, যাঁরা ঘরে বা বাইরে কোথাও উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু করেন না, যাঁরা গৃহকর্মীর সহযোগিতা নিয়ে থাকেন অর্থের বিনিময়ে।
নারীর স্বকীয়তা, আর্থিক ক্ষমতায়ন, পারিবারিক সচ্ছলতার খাতিরে বাইরে কাজ করার প্রয়োজন যেমন আছে, তেমনি পরিবার ও সমাজ গঠনে একজন গৃহিণীর গৃহকাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিসংখ্যান বলে, কর্মজীবী নারীদের তুলনায় গৃহকর্মে নিয়োজিত নারীদের সংখ্যাই মূলত বেশি। গৃহস্থালির এই সেবামূলক কাজে নারী তাঁর শ্রম, মেধা, সময়—সবই দিচ্ছেন। কিন্তু পরিমাপবিহীন নারীর এ অদৃশ্য কাজগুলো অগোচরেই থাকে। কাজগুলো আর্থিক মানদণ্ডে নিরূপণ করাও সহজসাধ্য নয়।
নারী যদি গৃহস্থালির কাজ না করতেন, তাহলে কিন্তু পরিবারের পুরো কাঠামোই ভেঙে যেত। গতানুগতিক ধারণায় আবদ্ধ আমাদের আগের প্রজন্মের নারীরাও যুগ যুগ ধরে পরিবারকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন। গৃহস্থালির কাজ পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও ‘ঘরের কাজ’ বলে এর কোনো মূল্যায়ন করা হয় না; বরং যাঁরা এ কাজ করছেন, সেই নারীদেরই অবমূল্যায়ন করা হয়। এ নারী যদি ঘরের কাজ না করে বাইরে কাজ করতেন, তাহলে কিন্তু তিনি একটা আর্থিক মূল্য পেতেন। আর সে ক্ষেত্রে ঘরের কাজ করানোর জন্য অর্থের বিনিময়ে তাঁকে একজন নিয়োগ করতে হতো। এ অর্থটাই কিন্তু নারীরা নিজে না নিয়ে পরিবারে কাজে লাগাচ্ছে।
এ অবস্থায় যুক্তি বা প্রশ্ন উঠতে পারে, গৃহিণীদের ভরণপোষণ নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হয় না, আর এর বিনিময়েই তিনি গৃহস্থালির কাজ করছেন। কারও কারও দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে হতে পারে, একজন গৃহিণী নিজ গৃহে আপনজনদের জন্য শ্রম দিচ্ছেন, আর সে কাজ আলাদা করে ভাবার মতো কিছু নয়। সব কটি যুক্তিই সত্যি, কিন্তু একজন গৃহিণীও যে বসে, নেই বরং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশাল ভূমিকা রাখছেন, সেটা প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। কারণ, আপাতদৃষ্টিতে ধরেই নেওয়া হয়, একজন গৃহিণী পরিবারের জন্য কিছু করেন না। যেখানে নারীরা শুধু গৃহকর্মই করেন, তাঁদের কাজটাও যে বাইরের উপার্জনক্ষম অন্য কোনো পুরুষ বা নারীর কাজের চেয়ে কম প্রয়োজনীয় নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে সন্তান লালনপালনের ক্ষেত্রে, সেটার গুরুত্ব অপরিহার্য। সিদ্ধহস্তে নারী ঘর তদারকির মাধ্যমে পুরুষকে নির্ঝঞ্ঝাটভাবে বাইরে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করে দেন, কিন্তু বিষয়টি সেভাবে উল্লেখ করা হয় না। প্রকৃত অর্থে একজন গৃহিণী বা নারী একাধারে নানাবিধ কার্যক্রম করে থাকেন।
এখন আসা যাক গৃহকাজ নিয়ে একজন গৃহিণী বা নারীর নিজস্ব মূল্যায়নের দিক প্রসঙ্গে। নারীর এ গুরুত্বপূর্ণ গৃহকর্ম অবমূল্যায়নের পেছনে নারীরাই অনেকটা দায়ী! কথাটা অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সত্যি। ‘গৃহস্থালির কাজ’ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যেখানে নারী সরাসরি জড়িত থাকলেও কাজটির গুরুত্ব নিয়ে নারীর আত্মোপলব্ধির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। নারী ধরেই নিয়েছেন কাজটি আবহমান কাল থেকে এভাবেই হয়ে আসছে, যা আলাদা করে ভাবার বা দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। এ সেবামূলক কাজে নারীরা দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করলেও নারী তাঁর নিজস্ব চেতনায় কাজটিকে অবজ্ঞা করেন। অধিকাংশ নারী অদ্যাবধি কাজটিকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে পারেনি বা স্বীকৃতি দিতে দ্বিধাবোধ করে। কারণ, একজন গৃহিণীকে যখন কেউ জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কী করেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরে বেশির ভাগ গৃহিণী সংশয়, দ্বিধা ও খানিকটা লজ্জা নিয়ে বলে থাকেন, ‘আমি কিছু করি না।’ এ উত্তরের সারমর্ম হলো রোজগার বা অর্থ উপার্জন করেন না। এক নিমেষে একজন গৃহিণী তাঁর কায়িক শ্রম, মেধা, সময়—সবকিছুকেই অতি সহজে অস্বীকার করে ফেলেন; আসলে নারীরা নিজেই তাঁদের গৃহকাজটিকে ছোট করে দেখেন, যা সত্যিই দুঃখজনক। যখন কেউ নিজের কাজের স্বীকৃতি বা মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন, সেখানে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের ভূমিকা আসবে পরে। প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে তাঁকে, যিনি গৃহকাজে সরাসরি সম্পৃক্ত। তাঁর মনোজগতে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে তিনিও অবদান রাখছেন। এই আত্মোপলব্ধির অনেক প্রয়োজন।
পরিবার বা সমাজে কোনো অধিকার বা ন্যায্য প্রাপ্তি প্রতিষ্ঠিত করা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। এ জন্য নারীকে সংকীর্ণ মানসিকতার আক্রমণ বা কটু বাক্যবাণে জর্জরিত হতে হবে পদে পদে। সেই সঙ্গে কিছু উদারতারও প্রমাণ মিলবে। সে উদারতা পরিবার থেকে এলে নারীর পথচলা কয়েক গুণ সহজ হবে। একজন গৃহিণীর নিজ পরিবার যদি পরিবারে তাঁর ভূমিকা নিয়ে গৌরবান্বিত থাকেন, তাহলে ধীরে ধীরে গৃহকাজ নিয়ে নারীর মনোজগতে পরিবর্তন আসবে; তাঁর কাজের সঠিক মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে শিখবেন।
সাম্প্রতিক একটি টিভি বিজ্ঞাপনে একজন গৃহিণীকে হাউসওয়াইফের পরিবর্তে হোমওয়ার্কার হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে, যা সত্যিই আশাব্যঞ্জক। কারণ, হাউসওয়াইফ শব্দটিতে নেতিবাচক অভিব্যক্তি মিশে আছে, সে ক্ষেত্রে হোমওয়ার্কার শব্দটি যথার্থ অর্থ বহন করে।
নিজ শক্তি নিয়ে নারী এগিয়ে চলুক।
*লেখক: সুরাইয়া সিদ্দিকী, ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র।