
হুড়মুড়িয়ে দুইয়ের ঘাড়ে পাড়া দিয়ে তিন নম্বর দিনটা চলে এল। শহুরে যান্ত্রিকতা আমাদের গেলার অপেক্ষায় হা করে পথ চেয়ে বসে আছে। আজকে দুপুরেই ফেরত যাব। ঘোরাঘুরির জন্য হাতে সময় কম। অল্প সময়কে টেনে চুইংগামের মতো লম্বার করার ধান্দায় গতি কমিয়ে শামুক হয়ে গিয়েছি। এই মুহূর্তে জুতার তলি ঘষে বিরক্তিকর শব্দ তুলে গা ছাড়াভাবে হাঁটছি। কাছেপিঠে বেঞ্চি দেখলে মোক্ষম একটা গড়ানিও দিয়ে ফেলতে পারি।
পার্কটা বিশাল। গার্মিশের একেবারে পেটের ভেতর। সবুজে ঘেরা সমান্তরাল এক ভিন্ন জগৎ। ভিড়ভাট্টার খুব কাছে থেকেও বহু দূরে। কে বলবে বেড়ার ওপাশেই চক্করবক্কর হাওয়াই শার্ট চাপানো পর্যটকের দল হই হই করে বেড়াচ্ছে। দূরে বসার একটা জায়গা দেখলাম। কিন্তু বাদ সেধেছে তাফসু মিয়া। অভিভূতের মতো লাল-সাদা গোল্ডফিশের মিছিল দেখছে গোল পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে। পুকুরটা গোলও না, পুকুরও না। আয়তাকার চৌবাচ্চা। কিন্তু গোল পুকুর বলতে ভালো লাগে কেন যেন।
ছেলেকে তার বাবার জিম্মায় রেখে বসার জায়গা বরাবর এগোলাম। ছোট্ট পুরোনো এম্ফিথিয়েটার। আহামরি কিছু না। এই পোড়ো এম্ফিথিয়েটারে বাস করে মমো নামের অদ্ভুত ছোট্ট মেয়ে। শতেক তালির মলিন জামা পরে সে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়। কেউ জানে না কোথায় তার বাবা-মা। তার সঙ্গী শুধু কাসিওপিয়া নামের এক কাছিম। কুরপার্ক নামের এই পার্কটা আসলে জার্মান লেখক মিখাইল-এন্ডের বিখ্যাত শিশুতোষ বই ‘মমো’র আদলে সাজানো।
এম্ফিথিয়েটারের সিঁড়িতে পরিকল্পনামাফিক গড়ানিটা দিয়ে দুই পা হাঁটতেই দেখি কাসিওপিয়া নিঃশব্দে ঘাপটি মেরে আছে। কিন্তু শান্ত কচ্ছপটার শান্তি বরবাদ করে দিল আমাদের ছানাপোনা। একজন কংক্রিট নাক ধরে যথেচ্ছ দোল খেল। আরেকজন তার পিঠে সওয়ার হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দেওয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চালাল।

মমোর গল্পটা অল্প করে বলেই ফেলি। হঠাৎ শহরে ভিন জগতের একদল ধূসর মানব এসে বলে, ‘অ্যাই বেআক্কেল মানুষ, তোমরা দেখি গড়িয়ে, ঘুমিয়ে আর আড্ডা দিয়ে প্রচুর সময় নষ্ট করো। তার চেয়ে আমাদের এই নতুন ব্যাংকে সময় জমা দিয়ে যাও না। সুদে-আসলে ফেরত পাবে।’ সুদের লোভে লোকে আসল সময়টুকু জমা দিয়ে এল। এখন অলস সময় নেই কারও হাতে। কিন্তু জীবন হয়ে গেল গল্প-আড্ডা-ঘুমহীন একঘেয়ে, ম্যাড়ম্যাড়ে। তখন ছোট্ট মমো ধূসর মানবের সঙ্গে লড়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সময়-ব্যাংকের কুঠুরি ভেঙে ফেলে। সবাই যার যার চুরি যাওয়া সময় বুঝে পেল। শুকিয়ে যাওয়া হলদেটে জীবন আবার গল্প-আড্ডায়-গানে সবুজ হয়ে উঠল।
মমোর গল্পটা নুরের বইপোকা বাবা আমাদের হাদি ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা। তাফসুর বাবাকে বলতে গেলাম, ‘এ জন্যেই তো আমি গড়িয়ে চলি, অলস ঘুমিয়ে থাকি, অনর্থক আড্ডা দিই। সময় নষ্ট করাটাও জরুরি, বুঝলেন?’ বেখাপ্পা উত্তর এল, ‘ফিরে গিয়ে বাজারের লিস্টে ডিম লিখতে হবে কিন্তু। ঘরে মাত্র দুইটা ডিম।’ বেড়াতে এসেও নিউরনে বাজারের লিস্টি! হতাশ কাঁধ ঝুলিয়ে ক্যাসিওপিয়ার পিঠ থেকে ছেলেকে নামাতে গেলাম। এই ছেলে মায়ের মতো হয়েছে। অগোছালো আর হাবাগোবা। তবে বলা যায় না, কোনো অতি সংসারী বাঙালি কালো কেশী কী জার্মান স্বর্ণকেশীর পাল্লায় পড়ে তাকেও অদূর ভবিষ্যতে বাজারের লিস্টে আধ ডজন ডিম যোগ করতে হতে পারে। সবই তকদির!
সবুজ ফেলে শহরের ভিড়ে ঢুকে পড়েছি আবার। অল্প বয়সীরা হয় তুমুল কেনাকাটায় ব্যস্ত, নয় ছবি তুলতে মগ্ন। বুড়োরা কৌতূহলী চোখে তা-ই দেখছে ছড়ানো ছিটানো রেস্তোরাঁগুলোতে আসন গেঁড়ে বসে। তাদের টেবিলে স্বাস্থ্যকর সালাদের বাটি আর অস্বাস্থ্যকর বিয়ারের বোতল। আঙুলের ফাঁকে ধূমায়িত দামি সিগারেট। আরও শৌখিন হলে হাভানা চুরুট। বিয়ার-বিড়ির প্রতি ভালোবাসা না থাকলেও সময় নষ্ট করার এই জাঁকালো আয়োজন দেখতে বেশ লাগছে।
এ রকম চমৎকার জায়গায় হারিয়ে গেলে মন্দ হতো না। তবে হারানোর পাঁয়তারা না করাই ভালো। তখন দেখা যাবে পারিবারিক চাকরিটা থেকে ছেলের বাবা আমাকে ছাঁটাই করে দিয়েছে। একটু আগে তার মাথার ভেতর ঢুকেছিলাম। দেখি সেখানে চাপা গজগজ চলছে। কে একজন নাকি তার কলিজা চিবিয়ে খাচ্ছে। গত সপ্তাহে দামি হেডফোন হারিয়েছে। এ সপ্তাহে ভালো ছাতাটা। এখানে এসে প্রথম দিনেই ১০ ইউরোর টিকিটও। চিজ বটে! এইখানে গরম কান নিয়ে আস্তে করে তার মাথা থেকে বেরিয়ে এলাম। অভিযোগ সব কটাই সত্য। তবে ছেলে হারিয়ে ফেলিনি যে এ পর্যন্ত, এটাই বড় কথা।

আজকের আবহাওয়া একেবারে নিখুঁত। নীল আকাশের পুরোটায় সোনা কুঁচি রোদ্দুর। সাদা মেঘ পাহাড়ের কোলে কুণ্ডলী পাকিয়ে অলস ঘুমে ব্যস্ত। বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার কোনো তাড়া নেই তাদের ক্যালেন্ডারে। পাহাড়ের আঁচলে বিছানো অপরূপ গার্মিশ শহরতলির কোবাল্ট পাথরের পথ ধরে ভিড়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে আমাদের ছোট্ট দলটা হাঁটছে। এখানে সেখানে কবুতরের উৎসুক আনাগোনা। ছানাপোনারা কবুতর ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে স্বভাবসুলভ উঁচু লয়ের ভ্যাক কান্না কিংবা নিচু লয়ের ফ্যাঁচ কান্না মারফত হতাশা জানান দিতে ভুলছে না। এই দুই দিনে এদের ঘ্যাও ম্যাও সয়ে এসেছে। আজকে তাই হাউ কাউ কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না।
গার্মিশ নাকি জার্মানির গয়া-কাশী। এটা অবশ্য মৌরি আপুর কথা। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য লোকে নাকি খুব আসে এখানে। কথাটা দেখলাম মিথ্যে না। প্রচুর ষাটোর্ধ্ব পক্বকেশ বুড়োবুড়ি মনে বেজায় আনন্দ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পথের ধারের বেঞ্চগুলো সব তাঁদের দখলে। হাতে কফির কাগজের কাপ, আইসক্রিম কিংবা এক টুকরো কেক। এই খেয়ে তো স্বাস্থ্যের উন্নতি হওয়ার কথা না। কিন্তু খাক না একটু। জীবন কয় দিনের। কাকভূশণ্ডি হয়ে কেয়ামত অবধি বেঁচে থাকার চেয়ে দুনিয়াটার রং-রূপ-রস দেখে আর পেট পুরে কেকটা, কফিটা খেয়ে শান্তিতে পটল তোলা হাজার গুণে ভালো। নিজেও তাই করব ঠিক করেছি।
সূর্যটা মাথার ওপর ঝুলছে। ঠিক দুপুর। কিছু পেটে পড়লে মন্দ হতো না। সবকিছু ছাপিয়ে খালি মনে হচ্ছে আহা, একটু ভাত খাওয়া যেত। জানা গেল, মৌরি আপুর কাছে নাকি ভালো জাতের ভারতীয় রেস্তোরাঁর খোঁজ আছে। অতএব, তার পিছু পিছু চললাম সবাই। শহুরে হট্টগোল পেছনে ফেলে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছি। এলোপাতাড়ি অনেক হেঁটে পৌঁছালাম সেখানে। রেস্তোরাঁ ঠিক রেস্তোরাঁর মতো না। লোকজনের কোলাহল নেই। তার বদলে পাহাড়ি ঝরনার একটা সরু ধারা স্রোত হয়ে বয়ে যাচ্ছে কলকল রবে। নুর আর তাফসু মিয়াও কলধ্বনি তুলে সেদিকে ছুটল। তারা যে হারে নুড়ি পাথর ছুড়ছে, তাতে আর এক ঘণ্টার ভেতরেই জলের বুকে চর জেগে উঠবে, কোনো সন্দেহ নেই।
অবাক করে দিয়ে স্নিগ্ধ চেহারার বছর পঞ্চাশের এক জার্মান ভদ্রমহিলা এলেন খাবারের মেন্যু নিয়ে। তাঁর আপ্যায়নের ব্যস্ততা আর চেহারার অদ্ভুত স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ আমরা ধরেই নিলাম ভদ্রমহিলার ভদ্রলোকটা নির্ঘাত ভারতীয়। এই রেস্তোরাঁ পারিবারিক ব্যবসা। জামাই-বউ মিলে চালান। এখানে হাদি ভাই তাঁর কল্পনার দোয়াত উল্টে অদৃশ্য কালিতে এক কাহিনি ফেঁদে বসলেন। নান-পরোটা আর ভাতের অর্ডার দিয়ে আমরা গালে হাত দিয়ে তাঁর কেচ্ছা শুনতে লাগলাম।

তরুণ বয়সে বিরাট কোনো এক হতাশা কাটাতে এই মহিলা পাড়ি জমান ভারতে। উদ্দেশ্য, হতাশা থেকে মুক্তি। সেখানে কলকাতা গঙ্গার পাড়ে এক বাবার সঙ্গে তাঁর হঠাৎ দেখা। দুঃখের কাহিনি শুনে বাবা তাঁকে ডেরায় নিয়ে প্রচুর দীক্ষাটিক্ষা দিয়ে বলেন, ‘যাহ মা, এবার দেশে ফিরে গিয়ে বাবার নামে একটা ভাতের হোটেল দে। ভাতের হোটেলেই তোর মোক্ষ। তবে যাওয়ার আগে ভারতবর্ষটা ঘুরে দেখে যাবি কিন্তু।’ তারপর জার্মান তরুণী বাবার কথামতো কলকাতা থেকে কৈলাস, বৃন্দাবন থেকে বেনারস সমস্তটা চষে বেড়ালেন। ঘুরতে ঘুরতে পাঞ্জাবি এক ভালো মানুষের সঙ্গে তাঁর দেখা। তার সঙ্গে সাতপাকে গেরো বেঁধে দুজনে জার্মানিতে এসে ভাতের হোটেল খুলে বসলেন। অরবিন্দর, গোবিন্দর চেহারার বিশাল মোছওয়ালা লোকগুলো সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটু পর পর, এরা আসলে এঁদেরই ছেলে। বোঝো নাই ব্যাপারটা?’ হাদি ভাই আয়নাবাজি কায়দায় দুর্দান্ত গল্পটার ইতি টানল।
থালা উপচানো বাটার নান চলে এলে গল্পটা মিলিয়ে নেওয়ার কৌতূহলে ভদ্রমহিলাকে একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, ‘তা, ইন্ডিয়া কেমন লেগেছে আপনার?’ উত্তর এল, ‘অ্যাঁ? ইন্ডিয়া তো যাইনি কোনো দিন। ইতালি আর ইস্ট ইউরোপ বাদে আর কোথাও যাই না তেমন। ইন্ডিয়া তো বহুত দূর। আর কী গরম রে বাবা। একা মানুষ আমি অদ্দুর যাব কী করতে?’ এবার বোঝা গেল ব্যাপারটা। হাদি ভাই দারুণ এক গুল মেরে প্রায় পার পেয়ে যাচ্ছিলেন।
মেঘে মেঘে বেলা ঘনিয়ে এল। ট্রেন ধরতে ছুটলাম। তার আগে হোটেল থেকে স্যুটকেস তুলে নিতে ভুললাম না। কেয়ারটেকার ধরনের লোকটা উলকি আঁকা হাত নেড়ে হাসিমুখে বিদায় দিল। ইন্টারনেটে হোটেলের রিভিউতে এই লোকের নামে অনেক গালমন্দ করা আছে। কিন্তু কই, তাকে তো মন্দ লোক মনে হয়নি এক কয় দিনে। আমরা ইচ্ছেমতো জ্বালিয়েছি আর সে সাধ্যমতো সাহায্য করেছে। তবে রান্নাঘরের চুলা জ্বলছিল না দেখে তাকে ডেকে আনা হয়েছিল। তখন চুলা আর ডেকচি-পাতিলের চৌদ্দগুষ্টিকে সে যে গালিটা দিয়েছিল সেটা লেখার বাইরে।
ট্রেন ছুটে চলছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাচ্চারা গলা সপ্তমে চড়িয়ে দিয়েছে। এই ফরজ কাজটা না করলে চলেই না তাদের। জানালার বাইরে তাকালাম। পাহাড়ের সবুজ ঘোলাটে হয়ে আসছে। গার্মিশের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বাড়ছে। কিন্তু ঘ্যাও ম্যাও আঠার মতো গায়ে লেগে রয়েছে। রাগ করতে গিয়ে ফিক করে হেসে ফেললাম সবাই। কারণ, এই ঘ্যাও ম্যাওয়ের দল হই-হুল্লোড় দিয়ে জীবনটা যেভাবে মাতিয়ে রাখে, সেখানে হাজার গার্মিশও তুচ্ছ। (সমাপ্ত)
ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: গবেষক ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।
ধারাবাহিক এ ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন