গাছের কাছে ফুলের সঙ্গে

মোহনীয় রোডেনডেনড্রন
মোহনীয় রোডেনডেনড্রন

ফুল প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর অলংকার। সজ্জিত বাগান, গোছানো টব, বাড়ির আঙিনা, অধুনা ছাদ বা ব্যালকনি কিংবা বন-বাদাড় ও ঝোপ-জঙ্গল যেখানেই হোক না কেন, এই অলংকার মনোযোগ আকর্ষণ করবেই। প্রতিটি ফুলই তার স্বতন্ত্র রূপ, রং ও গন্ধে অতুলনীয়; দৃষ্টি ফেরানো যায় না। তাই রুচিশীল ও সৌন্দর্য পিপাসুরা ফুলের সৌন্দর্য শুধু বনে-বাদাড়ে দেখেই তৃপ্ত হননি; শহর–লোকালয়ে পরিকল্পিত বাগানে একে স্থান দিয়ে আরও সজ্জিত ও নন্দিত করার চেষ্টা করেছেন। এবার এ রকমই দুটো সুসজ্জিত ও পরিকল্পিত বাগান নেইম্যান গার্ডেন ও শেফিল্ড পার্ক গার্ডেন দেখার সুযোগ হয়েছে।

দৃষ্টিনন্দন এজেলিয়া
দৃষ্টিনন্দন এজেলিয়া

আমাদের দেশের মতোই এ দেশে বসন্ত ফুল, রং ও রূপের ঋতু। যুক্তরাজ্যে শীতের পরই বসন্ত ঋতু। তখন সাজানো-গোছানো নগরে যেন এই ঋতুর আগমনী বার্তা আরও বেশি দৃশ্যমান হয়। রাস্তার আইল্যান্ড ও ফুটপাতের পাশে সারি করে কিংবা বাড়ির সামনে লাগানো প্রতিটি গাছ ফুল ফুটিয়ে নিজেকে জাগিয়ে তোলে আর ঋতু পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়। এমনই সময়ে পূর্ব নির্ধারিত ব্যক্তিগত কাজে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে আচমকাই নেইম্যান গার্ডেন যাই। কর্মব্যস্ত দিনেও বাইরে পার্কিংয়ে গাড়ির ভিড় দেখে যথারীতি অবাক হই। একদম সাদামাটা রিসেপশন পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে আসল বিষয়টি টের পাই। এত রডোডেনড্রনের ভুবন। এ ফুল কত রঙের হতে পারে—লাল, সাদা, গোলাপি, হলুদ, বেগুনি, মিক্সড আরও কত কি। আর এর অদ্ভুত সুগন্ধে-মাদকতায় চারপাশে এক ঘোরের সৃষ্টি হয়েছে।

নেইম্যান গার্ডেনে শতবর্ষী গাছ
নেইম্যান গার্ডেনে শতবর্ষী গাছ

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নেপালের জাতীয় ফুল (নেপালে লালি-গোরান নামে পরিচিত) রডোডেনড্রনের নাম এতদিন গল্প-উপন্যাসে পড়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবে আমার এবারই প্রথম দেখা ও ভালোবেসে ফেলা। কারণ এর মোহনীয়তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই যেন নেই। রডোডেনড্রনের ঘোর কিছুটা কাটতে পুরো বাগান ঘুরে দেখি। এখানে রয়েছে বাহারি টিউলিপ, ক্যামেলিয়া, ম্যাগনোলিয়া, উয়েস্টেরিয়া, লুপিন ও এস্টারসিয়া ইত্যাদিসহ আরও কত ফুল; যাদের নাম আমার জানা নেই। এদের রোজ কর্নার তখনো পূর্ণতা পায়নি, সবে পাতা আর কুঁড়ি মেলছে। আর বাগান জুড়ে শতবর্ষী গাছ; আমার কথা নয় লিফলেটে গাছের বর্ণনা লেখা রয়েছে।
লডউইজ মিশাল ১৮৯০ সালে নেইম্যান এস্টেট প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্থানকে বাগানে রূপান্তর করার জন্য প্রথমে টপিয়ারি করা হয় এবং নানাবিধ গাছ লাগানো হয়। পরবর্তীতে তার উত্তরাধিকারীরা এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তারা আরও উদ্যোগী হয়ে নেপালের হিমালয় ও দক্ষিণ আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে গাছ ও বীজ সংগ্রহ করেন। বাগানের বিভিন্ন প্রজাতির রডোডেনড্রন যেন আজও এই স্মারক বহন করে চলছে। ১৯৩০ সালে এ বাগান জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এ বাগানের গাছের বৈচিত্র্য যেন এর দর্শনার্থীদের মাঝেও ছড়িয়ে গিয়েছে। রৌদ্রোজ্জ্বল সেদিন নবজাতককেও দর্শনার্থীদের তালিকায় দেখেছি। যেন মায়ের চেষ্টা, প্রকৃতির মাঝে ফুলের সৌরভই হোক নবজাতকের বাইরের পৃথিবীর প্রথম নিশ্বাস। এ ছাড়া বাগান জুড়ে শিশুদের খেলা-আনন্দ, অল্পবয়সীদের বাগানের সৌন্দর্য অবলোকনের মাঝেও উদাস দৃষ্টি ও মোবাইল ফোনে ফিরে যাওয়া, মাঝবয়সীদের একটু হাঁপ ছেড়ে স্বস্তি খোঁজা সবই ছিল। আর বয়োবৃদ্ধরাও বাদ নন; যারা হাঁটতে অপারগ আদের জন্য ছিল সুন্দর হালকা গাড়ি ‘ক্লাব কার’–এর মাধ্যমে বাগান পরিভ্রমণ। সত্যিই, এ দেশে এসব সচেতনতা, সহানুভূতি আর সুন্দর ব্যবস্থাপনা এদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দেয়।
ইতিমধ্যে বাগান ঘুরে দেখার সময় একজন কর্মীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি আমাকে বিভিন্ন গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, যাদের অনেকগুলো সুদূর জাপান, মেক্সিকো থেকে আনা হয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে এনে রোপিত গাছগুলো নিজের মনকে উচাটন করে দেয়। ভাবছিলাম, এই সব সৌন্দর্য পিপাসুদের যদি আমার দেশের গন্ধ মাতোয়ারা কামিনী, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, বেলি কিংবা হাসনাহেনার সঙ্গে পরিচয় হতো তাহলে নিশ্চয়ই এসব ফুলও এ বাগানে গন্ধ বিলিয়ে যেত। বাগান দেখায় আমার মুগ্ধতা, আনন্দ আর আগ্রহ দেখে সেই কর্মী আমাকে কাছেই শেফিল্ড পার্ক গার্ডেনে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন।

শেফিল্ড পার্কের লেক
শেফিল্ড পার্কের লেক

সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্ধারিত কাজ শেষে প্রায় চারটায় শেফিল্ড পার্ক গার্ডেনে পৌঁছাই। যেহেতু এটা বাগান নয় পার্ক, তাই স্বভাবতই অনেক বিশাল। এর বাইরেও আকাশ ছোঁয়া গাছ। রিসেপশন থেকে সময় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে; পাঁচটায় বাগান বন্ধ হয়ে যাবে। ভেতরে ঢুকে খানিকটা মন খারাপ; কারণ মাঠের ড্যাফোডিলগুলো শুকিয়ে রুগ্‌ণ ও শ্রীহীন। কিন্তু তারপর যা দেখলাম; আলহামদুলিল্লাহ এ রকম সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য আল্লাহ তালা আমাদের দিয়েছেন! এত ফুল নয়, ফুলের পাহাড় পার্কের একটি অংশ আলোকিত করে রেখেছে। দেখে একদম হতবিহ্বল; কী করা যেতে পারে—হাসি, আনন্দ, চিৎকার বা চোখের কোনায় আনন্দাশ্রু আর আল্লাহ তালার তাসবিহ্। এর ছবি তুলতেও খুব অস্বস্তি লাগছিল; কারণ এ বিপুল সৌন্দর্যের সামনে আমরা ধূলিকণা বা তৃণসম। এই অনুভূতি ঠিক বলে বা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মনে হচ্ছিল যেন এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো আমরা ফুল দিয়ে গড়া কোনো স্বপ্নরাজ্যে এসেছি। কিন্তু স্বপ্ন নয় বাস্তবেই এ ফুলের রাজ্য আমাদের দেখা হয়েছে। এ ফুলগুলো রডোডেনড্রন জেনেসিসের একটি প্রজাতি; এদের এজেলিয়া বলা হয়।

হাঁসের দিবানিদ্রা
হাঁসের দিবানিদ্রা

আঠারো শতকে শেফিল্ড পার্ক হাউস নামে একটি গোথিক কাউন্টি হাউসের মাধ্যমে এই বাগানের গোড়াপত্তন। মালিকানার হাত-বদলে ১৯১০ সালে আর্থার গিলস্ট্রাপ সোমেস এটি ক্রয় করেন। তিনি বিভিন্ন গাছ রোপণ ও বাগান শুরু করেন। বর্তমানে এটি এজেলিয়ার জাতীয় সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত। সময় স্বল্পতায় এই ফুলের ভুবন ছেড়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পার্কের অন্য অংশ দেখতে যাই। এখানে রয়েছে বিশাল লেক, আর লেকে রয়েছে শাপলা। যদিও প্রস্ফুটিত নয় তবুও দেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। আরও একটি মজার জিনিস দেখলাম; লেকের পাশে মাঠে শেষ বিকেলে হাঁসেরা সারি বেঁধে দিবানিদ্রা যাচ্ছে। আমাদের পদচারণায় তাদের কোনো ভ্রুকুটি নেই। কারণ এ পার্ক-লেক তাদেরই, আর এরা এভাবেই অভ্যস্ত।
একটি বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়, প্রবাসীরা প্রবাসে কোনো কিছুই ষোলো আনা উপভোগ করতে পারেন না। সুস্বাদু খাবার, আরামদায়ক যাতায়াত ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন যেকোনো কিছু মনের হাহাকার বাড়িয়ে দেয়—আহা! আমাদের দেশেও যদি এটা থাকত। কিন্তু আমাদের দেশেও বলধা গার্ডেন নামে এ রকম বাগান রয়েছে; জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ১৯০৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রকৃতিপ্রেমী এই ব্যক্তি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গাছ সংগ্রহ করে একে সমৃদ্ধ করেছিলেন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অদূরদর্শী পরিকল্পনায় এর চারপাশে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ এবং সর্বোপরি সঠিক যত্ন ও পরিচর্যার অভাবে এটি প্রতিদিন তার জৌলুশ হারাচ্ছে। নেইম্যান গার্ডেন ও শেফিল্ড পার্ক দেখার অভিজ্ঞতা নিজেকে আনন্দে উদ্বেলিত করেছে বটে, কিন্তু একই সঙ্গে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর কাছে নিজেকে অপরাধীও করেছে। কারণ তার রেখে যাওয়া এ অমূল্য বাগানের বর্তমান দৈন্য ও ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার দায়ভার আমরা কেউই এড়াতে পারি না। তারপরও প্রবাসের এই বসন্ত দিনে গাছের কাছে, ফুল ও পাখির সঙ্গে কাটানো সময় ব্যক্তিগত সুখস্মৃতির পাতায় একটি অন্যতম সংযোজন হয়ে থাকবে।

রাজিয়া সুলতানা: ব্যারিস্টার-এট-ল, রেডব্রিজ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।