করোনায় পাল্টে গেছে ইরানের পর্যটন ও তীর্থ নগরী মাশহাদ

চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়ার পর যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্য অন্যতম ইরান। দীর্ঘদিন থেকে আমেরিকার অবরোধের কারণে জর্জরিত খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশটি গত কয়েক মাসে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধি কেন্দ্র করে দেশটির বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ, আমেরিকা ড্রোনের সাহায্যে ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাশেম সোলায়মানিকে ইরাকের বাগদাদে হত্যা, ইরানের সেনাবাহিনী কর্তৃক ইউক্রেনের বিমান ভূপাতিত করাসহ সর্বশেষ সম্প্রতি সময়ে দেশটিতে নেমে এসেছে করোনার প্রাদুর্ভাব।
ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খোরাসানে রাজাভি প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর মাশহাদ। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কারণে শহরটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ৩৪ লাখ মানুষ মাশহাদ শহরে বসবাস করে। ওআইসির সঙ্গে সম্পৃক্ত মুসলিম দেশগুলো নিয়ে গঠিত ‘ইসলামিক এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন—আইইএসকো’ ২০১৭ সালের জন্য ইরানে আাধ্যাত্মিক রাজধানী পবিত্র মাশহাদ শহরকে মুসলিম বিশ্বের সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণা করে। করোনার প্রভাবে গত দেড় মাসে ইরানের অন্য শহরগুলোর মতো এ শহরেও নেমে এসেছে স্থবিরতা, থেমে গেছে প্রাণচাঞ্চল্য।

ইরানে প্রতিবছর ৬ থেকে ৮ মিলিয়ন বিদেশি পর্যটক-তীর্থযাত্রীর আসেন। ইরানে বিদেশিরা মূলত ধর্মীয় স্থান, ঐতিহাসিক স্থাপনা, প্রাকৃতিক স্থান এবং চিকিৎসার জন্য আসেন। বিদেশি পর্যটক-তীর্থযাত্রীদের অধিকাংশের মূল আকর্ষণ থাকে মাশহাদ শহরে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ ও বৃহত্তম ইসলামি ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান রাজাভি কমপ্লেক্স। নবী বংশের অষ্টম ইমাম হজরত আলী রেজা (আ.)-এর মাজারকে কেন্দ্র করে এ সুবিশাল কমপ্লেক্সটি গড়ে উঠেছে। কমপ্লেক্সের সর্বত্রই দেখা মিলবে দৃষ্টিনন্দন ও শৈল্পিক কারুকাজ। রাজাভি কমপ্লেক্সের আয়তন ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫৭ বর্গমিটার এবং ধারণক্ষমতা ১৫ লাখ। মসজিদ, মাজার, গ্রন্থাগার, জাদুঘর, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, অতিথিশালা, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, প্রকাশনী, সম্মেলনকেন্দ্রসহ রাজাভি কমপ্লেক্সের অধীনে রয়েছে আরও অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান। আর এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ। কমপ্লেক্সের বার্ষিক আয় ২১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্রতিবছর মাশহাদে বিদেশি ছাড়াও ২৫ মিলিয়ন ইরানি পর্যটক-তীর্থযাত্রী আসেন। খোরাসানে রাজাভি প্রদেশে হজরত আলী রেজার মাজার ছাড়াও ইরানের জাতীয় কবি ও মহাকাব্য ‘শাহনামা’র রচয়িতা মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসি, কবি ওমর খৈয়াম, কবি ফরিদ উদ্দীন আত্তার, দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি, খাজা আবা সালত, খাজা মুরাদ, খাজা রাব্বিহ, সম্রাট নাদের শাহসহ আরও বিখ্যাত ব্যক্তিদের সমাধি রয়েছে।

মাশহাদ শহরের অর্থনীতির একটা বড় অংশ পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভ্রমণকারীদের জন্য রাজাভি কমপ্লেক্সের চারপাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বহু বিশ্বমানের আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, স্যুভিনিয়রের দোকানসহ শপিং মল। বিদেশি ভ্রমণকারীদের সুবিধার্থে নির্মিত হয়েছে শহীদ হাশেমী নেজাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। রয়েছে ট্রেন, বাসসহ হাজারো ট্যাক্সি সার্ভিস। রয়েছে চিড়িয়াখানাসহ বহু পার্ক। করোনা ভাইরাসের কারণে মাশহাদ শহরে পর্যটকদের আনাগোনা নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। বন্ধ হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক বিমানসহ সব দূরপাল্লার বাস। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান ছাড়া অন্য সব বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। করোনায় বদলে গেছে প্রিয় মাশহাদ শহরের চিরচেনা চিত্র।

*লেখক: শিক্ষার্থী, আল-মোস্তফা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, মাশহাদ, ইরান। [email protected]