কোরিয়াগামী ইপিএস কর্মীদের ভাগ্য কেন অনিশ্চিত

ছবি: সংগৃীত

১৮ হাজার বাংলাদেশির বসবাস দক্ষিণ কোরিয়ায়। সংখ্যার হিসাবে এটি কম হলেও শিক্ষার মান ও উচ্চ বেতনের কারণে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছেন এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম (ইপিএস) কর্মীরা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই ভিসা জটিলতা আর পরপর দুবার নিষেধাজ্ঞার কবলে আটকে পড়ে আছে দুই হাজারেরও বেশি কর্মী। বন্ধ রয়েছে কমিটেড এবং নতুন ইপিএস কর্মীদের প্রবেশ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি সমাধান না হলে আগের চেয়ে আরও খারাপ হতে পারে। এতে শ্রমবাজার হারানোর আশঙ্কাও থেকে যায়। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

কোরিয়ার শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো ইপিএস কর্মী একই কোম্পানিতে ৪ বছর ১০ মাস কাজ করলে তাঁরা কমিটেড হিসেবে দেশে গিয়ে আবার কোরিয়ায় আসতে পারবেন। সেই কমিটেডের নিয়ম অনুযায়ী ৩ মাসের জন্য দেশে গিয়েছিলেন যায়েদ হোসাইন। ১৪ মাস পার হয়ে গেলও এখনো কোরিয়ায় আসতে পারেননি।

যায়েদ হোসাইন বলেন, ‘একই কোম্পানিতে বেসিক বেতনে কষ্টের কাজ করেছি শুধু কমিটেড ওয়ার্কার হিসেবে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা আর কোরিয়াতে আবার ফিরব বলে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিগত দেড় বছর আমাদের অপেক্ষা করার পরামর্শই দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো কোনো আশার বাণী পেলাম না।’ এ অবস্থায় এক থেকে দেড় বছর আটকে পড়া কর্মীরা অনেকটাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। যায়েদের মতো একই সারিতে ৮৬২ জন ইপিএস কমিটেড কর্মী আবার কোরিয়ায় প্রবেশের প্রহর গুনছেন। আর ভিসা ইস্যু হওয়া এক হাজারেরও বেশি কর্মী দেড় বছর ধরে আটকে আছেন। তবে এর পেছনে কূটনৈতিক দুর্বল প্রচেষ্টাকে দায়ী করছেন অনেক ইপিএস কর্মীরা।

অপেক্ষার পর অপেক্ষা! কিন্তু কোরিয়ান মালিকেরা তাঁদের নিজেদের স্বার্থে অপেক্ষার জায়গাটা খালি রাখেন না। যেমন অবশেষে অপেক্ষার ফল বিষাদময় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইপিএস কর্মী নাজমুল ইসলামের। দেশ থেকে আর না নিয়ে আসার অপারগতা প্রকাশ করে কোরিয়ান মালিকপক্ষ। পাজুতে একটি কারখানায় কাজ করতেন তিনি।

বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটির সরকার
ছবি: সংগৃহীত

নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘কমিটেড কর্মী হয়ে কোরিয়ায় ফেরার প্রত্যাশায় ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে দেশে এসেছিলাম। দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার এই আশায় দেশেও কোনো কিছু শুরু করার সুযোগ পাচ্ছি না। এমন অনিশ্চিত ভাগ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে হচ্ছে। হঠাৎ গত দুই মাস আগে মালিক ফোন করে বলে দিল, তুমি না আসতে পারলে কিছু করার নেই। আমি অন্য দেশ থেকে লোক নিয়ে নিচ্ছি।’
ইপিএস কর্মীরা মনে করেন, সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্তের অভাব, জাল করোনা সার্টিফিকেট এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আটকে পড়ে আছেন ইপিএস কমিটেড কর্মীরা।

একটু পেছনের ঘটনা অনুসন্ধানে জানা যায়, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে প্রায় প্রতিটি ইপিএসভিত্তিক দেশ সঠিকভাবে পরীক্ষা করে কর্মীদের কোরিয়ায় পাঠায়। কিন্তু বাংলাদেশি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্রমিকদের করোনা পরীক্ষা সঠিকভাবে করানোর তাগিদ দেয়, যেন করোনায় আক্রান্ত কোনো শ্রমিক দেশটিতে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু তারপরও ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়নি। গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেশটিতে প্রবেশ করা ৩৩ জন কর্মীর শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ এপ্রিল থেকে আবারও বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের জন্য কোরিয়ার দরজা। কপাল পুড়ল ইপিএস কর্মীদের বাংলাদেশের জন্য কোরিয়া সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার। কোরিয়ার কোম্পানিগুলো বাংলাদেশি কর্মীদের পছন্দ করে। নিরুপায় না হলে বাংলাদেশি শ্রমিকরাও কোম্পানি ছাড়েন না। করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশে এসে আটকা পড়েছেন কমিডেটসহ দুই হাজারেরও বেশি কর্মী। তাঁদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে এখনো দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অনেক কর্মী তাঁদের পুরোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চান, কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।

প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোরিয়ান মালিকেরা বাংলাদেশিদের নিয়োগ দিতে আগ্রহী। কিন্তু বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনে দূতাবাস। কিন্তু সেটাও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। হতাশ ইপিএস কর্মীরা জানান, সমস্যা নিয়ে সবাই আলোচনা করেন কিন্তু সমাধান কিছু হয় না। অথচ এই একটি বাজার সক্রিয়ভাবে ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমবাজারে নেপাল, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। কেন বাংলাদেশ থেকে কর্মী যেতে পারছেন না, দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার পেছনের কারণ কী? এ রকম হাজারো প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় আসা যাত্রীদের মধ্যে কোভিড-১৯ পজিটিভ হিসেবে শনাক্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে
ছবি: সংগৃহীত

এ প্রসঙ্গে কেবিজের বাংলাদেশি শিক্ষক, যিনি কোরিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন, শেখ মুরাদ হোসেন বলেন, ‘যারা কমিটেড মালিক, চাইলে আজ না হয় কাল, যেকোনো সময় কোরিয়ান অথোরিটি অনুমতি দিলেই তারা কোরিয়াতে প্রবেশ করতে পারবে। আর মালিক যদি অপেক্ষা না করে, তাহলে ভাগ্য খারাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিচক্ষণ কোরীয়রা জরিপ করে কোন দেশে সবচেয়ে নিরাপদ বেশি, স্বাস্থ্যসচেতন এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ। তারা জরিপের ফলাফল অনুসারে সেসব দেশের লোকদের মালিকদের চাহিদা অনুযায়ী আগে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আশা করি, বাংলাদেশের ওপর সব অশুভ আঁধার কেটে যাবে।’

বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একমাত্র জনশক্তি রপ্তানিকারক। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাটির ওপরই কোরিয়ায় ইপিএস কর্মী প্রেরণ-কল্যাণের পুরো দায়ভার। করোনাকালে দেশে আটকে থাকা ব্যক্তিদের ফেরত আর ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলতে বেশ উদ্যোগী ছিল বোয়েসেল। তাই নতুন আশঙ্কায় তারাও উদ্বিগ্ন হলেও এর পেছনে সরকারি উদাসীনতার অভিযোগটি মানতে নারাজ সংস্থার দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা।
কোরিয়ায় প্রবেশের জন্য প্রতিটি ইপিএস কর্মীকে কোভিডের টিকা প্রয়োগ, বাংলাদেশে কোয়ারেন্টিন এবং কোরিয়ায় প্রবেশ করার পরও কোয়ারেন্টিন করার মাধ্যমে কোরিয়া প্রবেশের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বোয়েসেল ও এইচআরডিকে অনুরোধ করেছেন ইপিএস কর্মীরা। জানা গেছে, সে উপলক্ষে বেশির ভাগ ইপিএস কর্মী কোভিড টিকা প্রথম-দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করেছে এবং অনেকেই অপেক্ষায় আছেন। পাশাপাশি আটকে পড়া ইপিএস কর্মীদের মধ্য থেকে কিছু প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। তাঁরা মনে করেন, প্রস্তাবগুলো শর্ত হিসেবে মেনে নিয়ে হলেও কোরিয়া প্রবেশ করতে আগ্রহী।

প্রস্তাবগুলো হলো—

*কোভিড টিকা দিয়ে কর্মীদের প্রেরণ করা;
*ফ্লাইটের আগে ৭ দিন কোয়ারেন্টিন করা;
*দক্ষিণ কোরিয়ায় গমনের পর যদি ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন করতে হয়, তাহলে সেই খরচ শ্রমিক বহন করবেন
*কোনো কর্মী যদি কোভিড পজিটিভ হয়, তাঁর চিকিৎসার খরচ কর্মী নিজে বহন করবেন
*প্রত্যেক কর্মী স্বাস্থ্যবিমা করবেন
*বিশেষ চার্টার্ড ফ্লাইটের মাধ্যমে কর্মী প্রেরণ করা।

কর্তৃপক্ষ যদি আরও কোনো শর্ত যুক্ত করতে চায়, তাতেও ইপিএস কর্মীরা রাজি হয়ে কোরিয়ায় নিজ কর্মস্থলে যোগদান করতে প্রস্তুত রয়েছেন বলেও তাঁরা জানান। এ জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, প্রবাসী =কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয় ও আন্তরিকতার ওপর জোর দিয়েছেন তাঁরা।