নিশ্চয়ই আরেকটি যুদ্ধ দেখতে চাই না বলেই এই ভাবনায় লিখছি। যদিও পরিস্থিতি ও রণসজ্জা এতটাই প্রবল, যেকোনো সময় হয়তো আরেকটি প্রাণঘাতী যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতে পারে। কী ধরনের রণসজ্জা, সেটা নিয়ে একটু পরে বলছি। তবে তার আগে বলে নিই, মে মাসের ১ তারিখ থেকে বেশ কিছু ইঙ্গিত মিলেছে মার্কিন প্রশাসন, রাশিয়া, চীন এমনকি উত্তর কোরিয়ার তরফে, যারা যুদ্ধ না হওয়ার সম্ভাবনার কথাই বলছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর খুব বেশি দিন সময় নেননি বিশ্বকে নতুন একটি বার্তা দিতে যে আমেরিকা আবার ‘গায়ের জোর’ নীতি প্রয়োগে ফিরে এসেছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর শাসনামলে যুদ্ধ আর আক্রমণের চেয়ে দ্বিপক্ষীয় ও স্ট্র্যাটেজিক পেশেনস বা কৌশলগত ধৈর্যধারণের নীতিতে এগিয়েছিলেন। সেই প্রক্রিয়ায় কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, ইরানের পারমাণবিন অস্ত্র কর্মসূচির রাশ টেনে ধরা গিয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে চাপে রেখেছিল ওবামা প্রশাসন। আর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে খুব বেশি ঝামেলা পাকায়নি। তবে তাঁর এই দ্বিপক্ষীয় পথে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বড় রকম দুর্বলতা দেখেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্পের কৌশল ছিল বলপ্রয়োগ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা। ‘পিস থ্রু পাওয়ার’ বলে একটি কথা তিনি প্রায়ই বলতেন। সে সময়ে করা ইরানের সঙ্গে চুক্তি, কিউবার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নসহ নানা বিষয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করে বলতেন, আমেরিকাকে দুর্বল করেছেন ওবামা। তবে দায়িত্ব নেওয়ার বেশ কিছুদিনের মধ্যে তিনি বুঝে ওঠেন যে যতটা সহজ তিনি ভাবছেন, সব এত সহজ নয়। বিশ্বের অস্বস্তিপূর্ণ স্থানগুলো ট্রাম্পের জয়ে সতর্ক হয়নি, তাই খ্যাপে গিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাঁর শক্তি দেখিয়েছেন সিরিয়ার একটি বিমানঘাঁটি ধ্বংস করে দিয়ে। বাশার-আল আসাদকে ক্ষমতায় রাখা হবে না বলে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন, যদিও এরপর এ নিয়ে কোনো কৌশলগত পন্থার দিকে মনোযোগ দিতে দেখিনি আমরা।
এরপর আফগানিস্তানের একটি দুর্গম এলাকায় আইএস জঙ্গিদের দ্বারা একজন মার্কিন সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার দুই দিন পরই প্রায় এক যুগ ধরে অব্যবহৃত একটি শক্তিশালী বোমা যেটাকে বলা হয় মাদার অব অল বোম, সেটা নিক্ষেপ করেছে। আর ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই যখন জাপানের প্রধানমন্ত্রী জাপান-আমেরিকা সম্পর্কোন্নয়নের জন্য ওয়াশিংটন সফর করছিলেন ঠিক সে সময়ই জাপান সাগরে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক কিম জং উন চটিয়ে দেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। সে কারণেই ট্রাম্প প্রশাসন হুমকি দিয়ে রেখেছে আর একটি আন্তমহাদেশীয় বা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালালে আক্রমণ করা হবে পিয়ংইয়ংকে। সেই হুমকির মধ্যেই কেটেছে গেল তিন সপ্তাহ। এর মধ্যে একটি মাঝারি ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে সেটি ব্যর্থ হলেও, আমেরিকার সবচেয়ে বড় রণতরি ইউএসএস কার্ল ভিনসন আর দ্বিতীয় বৃহৎ সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কোরীয় উপসাগরে। ওই সাবমেরিনে প্রায় সাড়ে ৬০০ টমহ্যাক ক্ষেপণাস্ত্র মজুত আছে। আর কার্ল ভিনসনের সামরিক প্রস্তুতিতে পারমাণবিক অস্ত্র সংযুক্ত আছে। এমনিতে জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়াতে বর্তমানে ৬২ হাজার মার্কিন সেনা আছে। সঙ্গে কার্ল ভিনসনের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে আরও বেশ কয়েক হাজার। সব মিলিয়ে পেন্টাগন তৈরি উত্তর কোরিয়া আক্রমণে। এমনকি ২ মে দক্ষিণ কোরিয়ায় সম্ভাব্য পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বা বিমান-বিধ্বংসী কৌশল হিসেবে ‘থার্ড অপারেশন সিস্টেম’ নামে একটি বিতর্কিত রণপ্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখা হয়েছে। দুই দিন আগেও যেটা মনে হচ্ছিল যেকোনো সময় আক্রমণ, সেটির প্রস্তুতি ঠিক থাকলেও সাম্প্রতিক কথাবার্তায় পরিস্থিতি আপাত শান্ত হওয়ার একটি আভাস মিলেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ক্ষমতায় শততম দিন পালন উপলক্ষে সিবিএসের ফেস দ্য নেশন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক জন ডিকারসনকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সেখানে পরোক্ষভাবে কিম জং উনকে প্রশংসা করেছেন এবং তাঁকে ‘স্মার্ট কুকি’ বা চালাক মাল বলে অভিহিত করেছেন। সেই সঙ্গে এটাও বলেছেন যে কিম উত্তর কোরিয়ার দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর ক্ষমতাকে কেড়ে নেওয়ার কিছু সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এ জন্য তাঁর চাচা কিংবা সেনাবাহিনীর জেনারেলদের দমন করে ক্ষমতায় টিকে থাকাটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল, সেগুলো তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। এমনকি পরের দিন ডোনাল্ড ট্রাম্প সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলেছেন, তিনি অবশ্যই কিম জং উনের সঙ্গে বৈঠক করতে চান।
এই একই সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প কথা বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার মদদদাতা হিসেবে পরিচিত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে। পুতিন এর আগে উত্তর কোরিয়া পরিস্থিতি ভয়ংকর ঝুঁকির দিকে এগোচ্ছে বলে সতর্ক করেছিলেন। এবং গরম-গরম কথাবার্তা পরিহার করার জন্য বলেছিলেন। গরম-গরম কথাবার্তা শুধু আমেরিকার পক্ষ থেকে আসেনি, এসেছে উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকেও। তাঁদের পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে আমেরিকার মূল ভূমি ছাই করে ছেড়ে দেবেন বলে হুংকার দিয়েছিলেন কিম জং উন। শুধু তাই নয়, বরং যেকোনো মূল্যে পারমাণবিক ওয়ার হেড বহনে সক্ষম আইসিবিএম বা ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালাস্টিক মিসাইল পরীক্ষা করা হবে বলে প্রতিজ্ঞা ছিল পিয়ং ইয়ংয়ের।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কোরিয়াকে থামাতে চীনের প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেছিলেন। এবং বারবার এটা বড় গলায় বলেছেন যে চীনের প্রেসিডেন্ট অনেক কষ্ট করছেন কোরিয়াকে থামাতে। এটা বড় চেষ্টা এবং এই চেষ্টা ব্যর্থ হলেই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন কোন পথ খোলা আছে। সেই চেষ্টার মধ্যেই কোরিয়া যে কিছুটা পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছে তার প্রমাণ হলো, তারা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার পরিবর্তে মানসম্মান রক্ষার মতো একটি বিষয় বোঝাতে একটি ২৫ মাইল দূরত্বের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে, সেটিও নাকি ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্পও বুঝতে পেরেছেন উত্তর কোরিয়ার সামরিক সামর্থ্য কতখানি। কিম জং উন বোঝাতে চেয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হুমকিতে ভীত হয়নি উত্তর কোরিয়া। তাই একটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে মান বাঁচাতে চেয়েছেন। এসব বিষয় বলছে পরিস্থিতির বরফ গলছে, এবং যুদ্ধের পথের বিপরীতে কোন পথ খোলা আছে সেদিকেই হাঁটতে চাইছে দুই পক্ষই।
তবে পথটা যে খুব সহজ, তেমনটা নয়। আমেরিকা আর তার মিত্র দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া চাইবে না ঘরে বিষফোড়াটা বাড়তে থাকুক। কী সেই বিষফোড়া? সেটি হলো, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক আক্রমণের সক্ষমতা অর্জন। সেই অর্জন এরই মধ্যে করে ফেলেছে উত্তর কোরিয়া। তাদের কয়েক হাজার করে স্বল্প আর মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আছে, যেটি দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা জাপান এমনকি প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়ামে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি আছে, সেটিতে আঘাত হানতে পারে। আরও বেশি হলে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ এমনকি আলাক্সার কোনো শহরে আঘাত হানার সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার আন্তমহাদেশীয় পারমাণবিক সক্ষমতা যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে ২০২৭ সাল নাগাদ তারা আমেরিকায় আঘাত হানতে সক্ষম হতে পারে বলে এরই মধ্যে সিনেট শুনানিতে সাক্ষ্য দিয়েছেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সামরিক কমান্ডার অ্যাডমিরাল হ্যারি হ্যারিস। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন তাই দেড় সপ্তাহ আগে স্পষ্ট করে বলেছেন, আগে উত্তর কোরিয়ার ধারণা ছিল যে আমেরিকা হয়তো তার সরকারকে উৎখাত করতে চাইছে। তাই টিকে থাকার প্রয়োজনে পারমাণবিক শক্তির মহড়া দেখানো ছাড়া আর কোনো পথ তাদের খোলা নেই। তবে আমেরিকার অবস্থান বেশ স্পষ্ট, তাদের ক্ষমতায় থাকতে হলে উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করতে হবে। সেটাই একমাত্র পথ বলে টিলারসন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, নিশ্চয়ই ডোনাল্ড ট্রাম্প তা নিয়েই কথা বলতে চাইছেন কিম জং উনের সঙ্গে।
তবে কিম জং উন তাঁর যে শত বছরের পারিবারিক শাসন, সেই শাসনের ভিত্তিই হচ্ছে উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ করা। দেশে মানুষ না খেয়ে মরলেও তাঁরা অস্ত্র কর্মসূচি থেকে বিরত হননি। লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, মিসরের সরকারপ্রধানকে ফেলে দিয়েছে আমেরিকা। শুধু ওই সব দেশের শাসকদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না বলে, এমন বিশ্বাস করেন অনেকেই। তাই কিম জং উন সহজে চাইবেন না, তাঁর পারমাণবিক নিরস্ত্রকরণের পথে হাঁটতে।
সেসব দিক বিবেচনায় কোনো সরল সমাধান নেই এখনই এই যুদ্ধাবস্থার। তবে বারাক ওবামা যেই স্ট্র্যাটেজিক পেশেনস দেখিয়েছিলেন, আপাতত উত্তর কোরিয়া কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে চুপচাপ তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে চালিয়ে নেওয়ার পথেই হাঁটতে চাইবে। অন্যদিকে আমেরিকা চাইবে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রহীন করতে। দেখা যাক, পথ কোন দিকে মোড় নেয়। তবে এসব আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান যে যুদ্ধটা সম্ভবত এখন থামিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। তেমনটি হলেই মানবতার শান্তি, না হলে কেউই যে রক্ষা পাবে না এই প্রাণঘাতী লড়াইয়ে।