কোরবানি
পবিত্র রোজার শেষে আসে খুশির ঈদ এবং ঠিক ২ মাস ১০ দিন পর প্রতিবছর কোরবানির ঈদ আসে। কোরবানির এই আসা–যাওয়ার মাঝে অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু শুনেছি, অনেক কিছু ভেবেছি, অনেক কিছু উপলব্ধি করেছি। শুধু প্রশ্ন করিনি ‘কেন’? কেন এই কোরবানি এবং কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে?
কেন বা কী কারণ এ বিশ্লেষণ, যদি সঠিকভাবে না জানা যায়, তবে তৃপ্তি বা আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে না, গড়ে ওঠে না বোধ। ভালোবাসার বোধ, ভ্রাতৃত্বের বোধ, ক্ষমার বোধ, ত্যাগের বোধ, বিবেকের বোধ, নৈতিকতার বোধ ইত্যাদি।
এতটা বছর পার হয়ে গেল অথচ তারে (বোধ) আমি চিনতে পারিনি আজও। আলো বা অন্ধকারে মাথার ভেতর হাজারবার যে জিনিস কাজ করে, সে স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, এমনকি ভালোবাসাও নয়। হৃদয়ের মাঝে জন্ম নিয়েছে বোধ, তারে এড়াতে পারা বড্ড কঠিন।
তাই তো প্রশ্ন জেগেছে মনে, কবে হবে বোধ? আমার প্রচুর আছে, কিন্তু তার কিছুই নেই, এটা আমার বোধে এসেছে। কিন্তু আমি কি ভাবছি যার কিছু নেই তার জন্য কিছু করতে? উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ হতে পারে। কিন্তু বোধগম্যতা যদি সেই ‘কী ভাবছি’ অনুভূতির মূল্যায়ন না দিতে পারে, তখন ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন।
সুইডেনের সমাজে যারা প্রচুর অর্থসম্পদের মালিক, তাদের অনেকেই নিজস্ব অর্থায়নে সমাজসেবামূলক কাজ করে। কিন্তু যাদের সম্পদ কম, তারা এলাকায় কোনো মসজিদ, মন্দির, ক্লাব বা পাঠাগার গড়ার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে।
এ ধরনের সমাজসেবা হলো নিজের খেয়ে সমাজের জন্য কাজ করা। তাদের প্রাপ্তি বলতে মানুষের জন্য কাজ করার আনন্দ বৈ আর কিছু নয়। এসব কাজ সুইডেনে সব সময় হয়ে থাকে। বাংলাদেশে পবিত্র রমজান মাসে আমরা অনেকেই এ ধরনের কাজ করে থাকি জাকাতের একটি অংশ হিসেবে।
সুইডিশদের মধ্যেও ভালো-মন্দ আছে, তা সত্ত্বেও কেন যেন মনে হয় সমাজব্যবস্থায় ইসলাম ধর্মের অনেক রীতিনীতির সঙ্গে বেশ মিল খুঁজে পাই। যেমন তারা বেতনের এক–তৃতীয়াংশ ট্যাক্স দেয়, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ইদানীং সুইডেনেও ইউরোপের অনেক দেশের মতো মসজিদ তৈরি এবং কমিটি নির্বাচনে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে।
ইসলাম ধর্মকে সুইডেন ও ইউরোপে আগের তুলনায় উদারভাবে দেখা হচ্ছে। যদিও মাঝেমধ্যে নানা সমস্যা দেখা যায়। ইউরোপ খ্রিষ্টানপ্রধান হলেও এখানে মুসলমানের সংখ্যা একেবারে কম নয়।
ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস রাশিয়ায়। দেশটিতে মুসলমানরা দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। বেসরকারি হিসাবে শুধু মস্কোতেই বাস করে ৪০ থেকে ৪৫ লাখ মুসলমান। ঈদের দিন রাশিয়ার মুসলিম–অধ্যুষিত প্রদেশগুলোয় এক দিনের বিশেষ ছুটি ঘোষণা করা হয়।
রাশিয়া একটি বড় দেশ। ইউরোপ ও এশিয়াজুড়ে এর অবস্থান। সে ক্ষেত্রে ইউরোপের মধ্যে যে শহরগুলো রয়েছে, সেখানেও ঈদ উদ্যাপন করা হয়ে থাকে। এরপর ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের ঈদ আকাশ-পাতাল ব্যবধান। কারণ, ইউরোপে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বাইরে একটি দিনও বন্ধ রাখা হয় না। আমরা যারা মুসলিম রয়েছি, পবিত্র রোজা ও কোরবানির ঈদের দিন কোনো ছুটি থাকে না। যার ফলে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য বিশেষভাবে ছুটির ব্যবস্থা করে নিতে হয়। যেমন ঈদ উপলক্ষে কর্মস্থলে আগেই ছুটির জন্য বলে রাখতে হয় নামাজ পড়ার বিষয়ে। নামাজ শেষে ফের কর্মস্থলে যেতে হয়। ঈদের যে আনন্দ বাংলাদেশে, সেই অনুভূতি শতভাগ কখনো হয় না ইউরোপে।
করোনাভাইরাসের কারণে গত দুই বছরের ঈদ উদ্যাপন প্রায় পুরোপুরি ঘরে বসেই করেছি সবাই। এবারের পবিত্র কোরবানি ঈদে কিছুটা ভিন্ন রকম উদ্যাপন করতে হবে সবার।
যদিও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার কোনো নির্দেশনা নেই, সে ক্ষেত্রে কোলাকুলি করা যাবে। আমরা যারা দূর পরবাসী, প্রিয়জনকে দূর থেকেই ঈদের শুভেচ্ছা জানাব। প্রতিবছর সবাই এই দিনে চেষ্টা করে আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হতে। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয় সবাই।
পরিবার–বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া এবং আত্মীয়-প্রতিবেশীদের নিয়ে ঈদ উদ্যাপন করা। ঈদের ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে পার্ক কিংবা সমুদ্রতটে ভ্রমণ করতে পছন্দ করে অধিকাংশ প্রবাসী।
শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ততা নয়, চারপাশে চোখ মেলে তাকাতে হবে আমাদের।
এতক্ষণ অনেক কথাই জানালাম। এখন বলি আমার অনুভূতি ‘ঈদ তখন আর ঈদ এখন’। প্রথমেই মনে পড়ে গেল সেই ‘ও মন ঈদের ওই দিনের শেষে খেতে হবে ঘরে ঘরে কোরবানির গোশত’।
ছোটবেলায় আমার কাছে ঈদের অনুভূতিটি আগের রাতেই বেশি মনে হতো। সে যে কী আনন্দ, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না! ঈদের আগের দিন রাতে শত চেষ্টা করে চোখের পাতা এক করতে পারিনি। কেন জানি ঘুমের ক্লান্তি শরীরে স্পর্শ করেনি। বিছানায় এদিক–সেদিক গড়াগড়ি করতে করতে হঠাৎ সকাল হয়েছে। ঈদের খুশিতে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যেত। তবু সবকিছুতে দ্বিগুণ আনন্দের অনুভূতি ঈদকে ঘিরে। বিশেষ করে বাসাবাড়ির চাকচিক্য করা এবং নতুন পোশাক সবার জন্য, যার ছিল ব্যাপক চাহিদা।
মনে পড়ে প্রায় ৪০ বছর আগের স্মৃতি ঈদের নামাজের আগে মিষ্টিমুখ, অর্থাৎ সেমাই খেয়ে নামাজে যাওয়া যেন একটা সামাজিক রেওয়াজ। না খেলেও জোরপূর্বক খাওয়াতেন মা। এরপর নতুন পোশাক পরে সালামি নিতে অপেক্ষায় থাকতাম। মা–বাবা, আত্মীয়, পরিবার–পরিজন বড় সবাইকে সম্মান করলে টাকা হাতে তুলে দিতেন। সেই টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম বন্ধুদের সঙ্গে।
পাড়ামহল্লা চষে বেড়াতাম। সবার বাসায় গিয়ে ক্ষীর, সেমাই খেতে খেতে একটা সময় আর খাওয়ার কোনো রুচি থাকত না। সবাই মিলে ছেলেবেলার ঈদ ছিল পরিপূর্ণ বিনোদনে ভরা, যা এখন শুধু স্মৃতি। সেই আগের মতো আনন্দ এখন আর হবে না, হবে কী করে? মা–বাবা নেই, কোথাও কেউ নেই সে ছোটবেলার মতো। তিন যুগেরও বেশি প্রবাসে ঈদ করছি। বিদেশে অর্থের পিছুটান না থাকলেও আনন্দ–উল্লাসের অনেক ঘাটতি রয়েছে, যা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়।
দেশের টানে, নাড়ির টানে মন ছুটে চলে সব সময় দেশের পানে। বিশেষ করে বিশেষ বিশেষ দিনগুলোয় দেশকে অনেক বেশি মনে পড়ে। কারণ, সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ফলে বোধগম্য হয় ঈদ হচ্ছে। তবু সবকিছু মেনেই চলতে হয়। দুঃখ আর বেদনার আরেক নাম প্রবাসীদের ঈদ উদ্যাপন।
পবিত্র কোরবানির ঈদের খুশি ধনী–গরিব সবার জীবনে নিয়ে আসুক সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। এবারের ঈদে আমাদের মধ্যে কি বোধগম্যতা আসতে পারে না? যে বোধগম্যতা দিতে পারে সমাধান, জীবনের সমাধান! যার প্রচুর আছে এবং যার কিছু নেই, তারা কি পারে না বন্ধু হতে? যার কিছু নেই এবং যার সব আছে, তাদের মধ্যে কি মিলন ঘটানো সম্ভব?
সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার বোধ যদি হৃদয়ে না আসে, তবে সে জীবনে সুখ আসবে বলে মনে হয় কি? আমি জানি না, আছে কি কেউ, যে জানে? বড় সাধ জাগে একবার তাকে দেখার।
ঈদ আমাদের জীবনের শূন্যতাকে পূর্ণ করুক। এবারের কোরবানির ঈদ উদ্যাপন বয়ে আনুক দেওয়া–নেওয়ার অঙ্গীকার। কোরবানির ঈদ পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানের হৃদয়ের মানবতার দ্বার খুলে দিক এবং কোরবানির বা ত্যাগের এ শিক্ষাকে আমরা যেন জীবনে প্রয়োগ করতে পারি, তেমনটি আশা করছি এবং শেষে তেমনটিই কামনা করছি। সেই সঙ্গে সবাইকে জানাই পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ঈদ মোবারক।