কোভিড, ফেস মাস্ক ও অন্যান্য
দু–তিন সপ্তাহ আগের ঘটনা। আফটার স্কুল প্রোগ্রামের স্ন্যাক-টাইম। সাধারণত লাঞ্চ টেবিলেই স্ন্যাকস সারে শিক্ষার্থীরা। ৩০টার মতো টেবিল নিয়ে বেশ বড় লাঞ্চ এরিয়া। বিশাল স্কুল চত্বরের মাঝামাঝি অংশে এর অবস্থান। এ লাঞ্চ এরিয়াকে ঘিরেই গড়ে উঠছে স্কুলঘর। মাথার ওপরে ছাদের পরিবর্তে রয়েছে পারগোলা। কাঠ বা মেটালের স্তম্ভের ওপর আড়াআড়ি কাঠের পাত দিয়ে জালির মতো করে তৈরি এ পারগোলা সৌন্দর্য এবং ছায়া দুটিই বৃদ্ধি করে। রৌদ্রোজ্জ্বল ক্যালিফোর্নিয়ার জন্য এ আচ্ছাদন এক আদর্শ স্থাপনা।
থার্ড থেকে সিক্সথ গ্রেড মিলিয়ে আমার ‘আফটার-স্কুল’ ক্লাস। মিস্টার হোজের ক্লাসে ছোটরা, মানে কিন্ডারগার্টেন থেকে সেকেন্ড গ্রেডের শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব তার। শুক্রবার সাধারণত হোমওয়ার্ক থাকে না। তাই শুক্রবারের আরেক নাম হলো ‘ফান ফ্রাইডে’। অনুপ্রেরণা জোগানোর লক্ষ্যে রোমাঞ্চকর শব্দ নিয়ে খেলা আরকি। শুক্রবার আমরা সাধারণত একসঙ্গে স্ন্যাক সারি। তাই লাঞ্চ এরিয়া বেশ সরব থাকে এ সময়। প্রয়োজনে মাঝেমধ্যেই ঝাড়ি মারতে হচ্ছে আমাকে। ‘কিপ ইট ডাউন’...‘ইটিস গেটিং টু লাউড গাইজ।’
মিস্টার হোজের দু–একজন শিক্ষার্থী আবার আমার দিনের ক্লাসের ছাত্র। দিনে সেকেন্ড গ্রেড কো-টিচিং করি আমি। সপ্তাহের তিন দিন আমি পড়াই, বাকি দুই দিন আমার সহকর্মী। পরের সপ্তাহে আমাদের নির্ধারিত সূচি যায় পাল্টে। আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে মার্চ, প্রায় সাত মাস হতে চলল সদাচঞ্চল ২৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আমার ডে-টাইম ক্লাস। শ্রেণিকক্ষের বাইরে কদাচিৎ যখন এদের মাস্কবিহীন অনাবৃত মুখ দেখি, তখন চমকে উঠি। শুধু চোখজোড়া দেখে মনের অজান্তে যে মুখ ছবি কল্পনা করেছিলাম, বাস্তবের মুখখানা কত ভিন্ন! মাস্কের ব্যাপারে আমাদের স্টেট (ক্যালিফর্নিয়া), স্কুল-বোর্ড, স্কুল, খুবই কড়া। আমি আরও বেশি! কোনো কারণে ব্যবহৃত মাস্ক ব্যবহারের অযোগ্য মনে হলে ওরা হাত দিয়ে মাস্কখানা মুখে সেঁটে ধরে রেখে, ট্র্যাশ বিনের কাছে গিয়ে তবেই পুরোনো মাস্ক পাল্টে নতুনটা পরে। আমার ক্লাসের এটাই নিয়ম।
আফটার স্কুল প্রোগ্রামে আমি নতুন এলেও এরই মধ্যে এ ক্লাসেও একই নিয়ম জারি করেছি আমি। সপ্তাহের শেষ দিন। দুই ক্লাস সামলে স্বভাবতই ক্লান্ত। কিন্তু দেহ–মনের ক্লান্তি মুহূর্তেই উবে যায়, যখন ভাবি আগামী দুদিন ছুটি। উইকএন্ডের প্ল্যান নিয়ে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎই চোখ পড়ল সামনে বসা জেইডেনের ওপর। পারগোলার কাঠ গলিয়ে পড়ন্ত বিকেলের ঝলমলে রোদ এসে পড়েছে ওর মুখে।
ওরা যখন খায়, তখন মাস্ক থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখে। কিন্ডারগার্টেনের, ছোট্ট জেইডেন মাস্ক খুলে রেখেছে টেবিলের ওপর। হঠাৎ হকচকিয়ে গেলাম আমি, হোজেকে ডেকে দেখাব নাকি? এমন অদ্ভুত ঠেকছে কেন ছোট্ট জেইডেনের মুখ? মনে হচ্ছে মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ থেকে স্বয়ং হনুমান তার বিকৃত চোয়াল নিয়ে বসে আছেন আমার সামনে।
আবার চুকচুক করে জুস ও পান করছেন পাউচ থেকে। জেইডেন মুখ উঁচিয়ে হাত নাড়ল আমার দিকে ‘হাই মিসেস সি’। সংবিৎ ফিরে পেলাম আমি, জেইডেনের সাদা ফকফকে কোমল ত্বকের যে জায়গা মাস্কের বাইরে থাকে তা, ‘সানি ক্যালিফোর্নিয়ার’ তীব্র রোদের কারণে কিছুটা বাদামি রং ধারণ করেছে। অথচ মাস্কের নিচের আবৃত অংশ রয়ে গেছে অবিকৃত। খুব হাসি পেল। মাস্ক আর রোদের খেলায় সাদা জেইডেনের মুখে ধরা পড়েছে হনুমানের মুখের আদল। পরম শক্তিধর কোভিডের কবলে পড়ে শুধু মানুষ কেন, মহাবীর হনুমানও ঘুরে বেড়াচ্ছেন মাস্কের আচ্ছাদন নিয়ে!
*লেখক: শবনম চৌধুরী, ক্যালিফোর্নিয়া