কোটা সংস্কার ও কিছু দূর-প্রাসঙ্গিক কথা

কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলোর একটি। আন্দোলনকারীরা মূলত শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী বেকার। আন্দোলনের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে, দেশে সরকারি চাকরিতে নানা ধরনের মোট ৫৬ শতাংশ প্রাধিকার কোটা বিদ্যমান। এতে সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্র মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছেন; কোটাধারী ‘অযোগ্যরা’ ঢুকে যাচ্ছেন। আরও মেধাবীরা যেন সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারেন, তার জন্য কোটার সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কারের দাবি নিয়েই আন্দোলন।
এই ৫৬ শতাংশ কোটার মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা। এ ছাড়া ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ উপজাতি কোটা ও ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা রয়েছে। যাঁরা কোটা সংস্কারের কথা বলছেন, তাঁদের ‍সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, তাঁরা মূলত ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার চাচ্ছেন। অন্য কোটার ক্ষেত্রে তাঁরা অস্পষ্ট কথা বলেন।
তাঁদের ভাষ্যমতে, দেশের ২-৩ শতাংশ লোকের জন্য ৫৬ শতাংশ কোটা। আর বাকি ৯৭-৯৮ শতাংশ লোকের জন্য রয়েছে ৪৪ শতাংশ। কথাটা পিলে চমকে দেওয়ার মতো। কিন্তু বিষয়টা কি আসলেই সে রকম কোনো কিছু? সত্যিই কি ২-৩ শতাংশ লোকের জন্য ৫৬ শতাংশ কোটা?
বিদ্যমান ৫৬ শতাংশ কোটার মধ্যে ১০ শতাংশ হচ্ছে নারী কোটা। সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্যমতে দেশে নারী ও পুরুষের অনুপাত হচ্ছে ১০০: ১০০.৩। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক অর্ধেক। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ লোকের জন্য ১০ শতাংশ কোটা রয়েছে।
আবার জেলা কোটা আছে ১০ শতাংশ, যার মধ্যে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বড় শহর ও অন্যান্য জেলা শহরও অন্তর্ভুক্ত। এই কোটা বলতে গেলে প্রায় সমগ্র দেশকেই কাভার করে ফেলে। এ ছাড়া ৫ শতাংশ উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা কোটা গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা কাভার করে। এভাবে দেখা যায়, দেশের প্রত্যেক নাগরিকই কোনো না কোনো কোটার অন্তর্ভুক্ত।
এই ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনের প্রধান স্লোগান হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’। এই স্লোগান আমাদের আশান্বিত করে। কিন্তু এত দেশপ্রেমিক হঠাৎ করে কোত্থেকে উদয় হলো? প্রশ্নটা নানা কারণে তোলা যায়। কারণ, আমরা দেখে এসেছি এই দেশের জন্মলগ্ন থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রকট বৈষম্য বিরাজ করছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশে লোকসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি। যুদ্ধের স্বীকৃত সব ফরমেটে মোট কতজন অংশগ্রহণ করেছিলেন? চার কোটি? উত্তর—না। ২ কোটি? না। ৫০ লাখ? না, তা-ও না। এর প্রকৃত সংখ্যাটা আমাদের মাথা নিচু করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বলেই মনে হয়!
তারপর দেখি যুদ্ধক্ষেত্রের কথা—একদিকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত সৈন্যদল; অন্যদিকে লাঠিসোঁটা, তির-ধনুক, দা, কুড়াল কিংবা বড়জোর থ্রিনটথ্রি রাইফেল, যার গুলি বের হতেও পারে, না-ও পারে; নিয়ে প্রায় প্রশিক্ষণহীন গৃহস্থালির দল।
এটা কি বৈষম্য ছিল না?
এই প্রকট বৈষম্য নিয়েই দেশ স্বাধীন হয়। অনেক স্বপ্ন, আশা নিয়ে ঘরে ফেরেন মুক্তিযোদ্ধারা। ভেবেছিলেন সব শহীদ পরিবারের দায়িত্ব নেবে তাঁদের জীবন দিয়ে আনা এই রাষ্ট্র। মুক্তিযোদ্ধারা বীরের সম্মান পাবেন দেশের সর্বত্র।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন, হাত দিলেন দেশের কাজে। কিছু করে ওঠার আগেই খুন হয়ে গেলেন সপরিবার! ক্ষমতায় চড়ে বসল ষড়যন্ত্রকারী রাষ্ট্রদ্রোহীরা। রাষ্ট্রে তখন পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়েছে রাজাকার, আলবদর, আল-শামসদের পুনর্বাসন-ক্ষমতায়ন। অন্যদিকে শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধাদের খুন, গুম, জখম, লাঞ্ছনা, নিপীড়ন। কারণ, যাঁর ডাকে তাঁরা জীবন বাজি রেখে দেশ আনলেন, তাঁর হত্যার বদলা শুধু তাঁরাই নিতে পারেন।
আদর্শের সঙ্গে আপস না করা, অস্ত্র জমা দেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, আত্মগোপন করছেন তখন। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয়টাই তখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁদের জন্য। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তো অলীক স্বপ্ন!
এসব বৈষম্য ছিল না?
তাঁরা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা এমন বৈষম্যের জন্য যুদ্ধ করেননি।’ কথাটা খুবই সত্যি। সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধেই তো ছিল তাঁদের যুদ্ধ!
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তো নিশ্চয়ই রাজাকারদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে চাননি, মন্ত্রিত্বে দেখতে চাননি। তাদের গাড়িতে রক্ত দিয়ে কেনা লাল-সবুজের পতাকাটা উড়তে দেখতে চাননি, দেশদ্রোহীদের পদাঘাত চাননি। রাজাকার, নব্য রাজাকারদের হাতে লাঞ্ছিত হতে চাননি। এই সবই দেখতে হয়েছে, পেতে হয়েছে আপনার জীবদ্দশাতেই!
কেন? এত এত বৈষম্যের সময় কোথায় ছিলেন আপনি বা আপনার পূর্বপুরুষগণ? কেন কোথাও এত সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে আপনাদের দেখা যায়নি? কারণ, এত সব বৈষম্যের কোথাও আপনার একটি পয়সাও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না। কিঞ্চিৎ স্বার্থও বিঘ্নিত হয়নি।
আপনারা এখন রাজপথে নেমেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধাদের চাওয়া’ পূরণ করতে। খুবই চমৎকার ব্যাপার! তা, আপনারা কোন চাওয়াটা পূরণ করতে নেমেছেন? যেটাতে আপনাদের স্বার্থ জড়িত! অতুলনীয়!
এতকাল বৈষম্যের পর রাষ্ট্র যখন স্বীকৃতিস্বরূপ, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু দিতে চেয়েছে, আপনারা তখন তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখলেন, এতে হয়তো আপনার স্বার্থও কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। অমনি রাস্তায় নেমে পড়লেন!
দেশপ্রেম, মুজিবপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধপ্রেমের কী অপূর্ব নিদর্শন!
আপনারা বলছেন, কোটার কারণে অযোগ্যরা সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই উদাহরণ হিসেবে দেখি। প্রতি নিয়োগে ক্যাডার নেওয়া হয় গড়ে দুই হাজার। আর এর জন্য পরীক্ষা দেন সাড়ে তিন থেকে চার লাখ চাকরিপ্রার্থী। তাঁদের মধ্য থেকে বাংলাদেশের রাজধানী কী, জাতীয় ফল কী, রাম-শ্যাম-যদু-মধু দিয়ে বাদ দেওয়া হয় ৯৪-৯৬ শতাংশ প্রার্থীকে। নেওয়া হয় ৪-৬ শতাংশ প্রার্থীকে, কোনো ধরনের কোটার প্রয়োগ ছাড়াই। যাঁরা আপাত-মেধাবী! তারপর আরেকবার এই আপাত-মেধাবীদের ছাঁকা হয় লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে, কোনো কোটা প্রয়োগ ছাড়া। এবারে মেধাবীদের সংখ্যাটা আরও কমে আসে। তারপর মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত নিয়োগ হয়। নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াতে শুধু এখানে এসে কোটার প্রয়োগ করা হয়। তাও লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর না পেলে কোটা তেমন কাজে আসে না।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধার উত্তরপ্রজন্ম