কেন এত কষ্ট করেছি সন্তানদের জন্য?

দেশের মতো প্রবাসেও বয়োবৃদ্ধ মা-বাবা অবহেলার শিকার হচ্ছেন ‘শিক্ষিত’ সন্তানদের হাতে। জীবন-যৌবন দিয়ে সন্তান লালন-পালন করে অবজ্ঞার শিকার হচ্ছেন মা বাবারা। চক্ষু লজ্জায় কেউ বলতে পারছেন না। সন্তানের অবমাননা হোক এমন কিছু বলতে চান না মা-বাবারা। আবার অনেকে নিজের জীবনের ব্যর্থতা তুলে ধরে নিজের কাছে অপমানিত হতে চান না।
দেশ থেকে সন্তান নিয়ে এসেছেন বা প্রবাসে এসে শান্তির স্বপ্ন দেখেছেন, অমন অনেক স্বদেশি মা-বাবার নীরব কান্নায় বাতাস ভারী হচ্ছে। ছেলে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে ভালো চাকরি করে। কেউ মেয়ে বন্ধু বা স্ত্রীকে নিয়ে নিজের সংসারে ব্যস্ত। উপেক্ষা আর অনাদরে কাটছে বয়সের ভারে ন্যুব্জ হওয়া এসব মা-বাবার জীবন।
অনেক স্বদেশির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বয়স্করা এখানে অনেকটা নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মা-বাবার কান্না এসব সন্তান নামধারীদের পাষান হৃদয়ে কোনো দাগ কাটছে না।
দেশে সরকারি চাকরি করতেন একজন। সংগত কারণে নাম না উল্লেখ করে জানালেন, জীবনের সব সঞ্চয় উজাড় করে ছেলেকে উচ্চ শিক্ষা দিয়েছেন। একসময় সন্তানের তাড়নায় নিজেও স্ত্রী নিয়ে আমেরিকায় আসেন। আমেরিকায় ছেলের কাছে এসে দেখেন চিত্রটা ভিন্ন। বেসমেন্টের আলো-আঁধারি ছোট এক কক্ষে তাদের স্থান হয়েছে। জানালাহীন স্যাঁতসেঁতে কক্ষে থাকতে গিয়ে অসুখে পড়েছেন। আমেরিকায় আসার পর প্রথম কাজ হয়েছে ছেলের কন্যা সন্তানকে স্কুলে আনা-নেওয়া করা। শীত ও গ্রীষ্মের বিরূপ আবহাওয়া উপেক্ষা করে বৃদ্ধ মা-বাবাকেই দেখতে হচ্ছে ছেলের সন্তানের দেখভাল। ছেলে, ছেলের বউ কাজে থাকেন। উইকেন্ড হলে থাকে নানা পার্টি, এসব পার্টি আর নিমন্ত্রণে মা-বাবাকে নিয়ে যাওয়ার কোনো কথাও ওঠে না।
অসুখ-বিসুখে ডাক্তারের কাছেও নিজে যেতে হয়। মেডিকেল আর ফুড স্ট্যাম্পের জন্য সরকারি অফিসে লাইন দেন দেশে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়া এ প্রবীণ প্রবাসী। মুখ ফসকে বেরিয়ে আসল, ‘বাবা মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটাই বৃথা। কেন এসব করলাম? কোনো উত্তর পাই না।’
জ্যামাইকার এক মসজিদে সব সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। জানালেন, দীর্ঘ ৩০ বছর দেশের বাইরে কাটিয়েছেন। নিজের কাজ ছাড়া একদিনের জন্যও কোথাও বেড়াতে যাননি। নিজের দুই ছেলের জন্য জীবনের সব সঞ্চয় উজাড় করে দিয়েছেন। ছেলে দুটি কলেজ পাশ করেই একজন বিয়ে করেছে ভিনদেশি নারীকে। একজন করেছে নিজের পছন্দের কাউকে। বিয়ে করেই তারা মা-বাবাকে ছেড়ে উঠেছে তাদের নিজেদের ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে। শূন্য ঘরে এখন এ প্রবাসী এবং তাঁর স্ত্রী জীবনের শেষ বেলায় দেয়ালে ঝোলানো সন্তানদের ছবির দিকে চেয়ে থাকেন। ভাবেন, জীবনে কি পেয়েছেন। পিঠ আর কোমরের ব্যথা নিয়ে ভুগছেন এ প্রবাসী। জানালেন, জীবনে কিছুই করিনি। মনে হয়েছিল সন্তান মানুষ হবে। সন্তান ঠিকই লেখাপড়া করেছে। নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বাবা-মায়ের কোনো খোঁজ রাখে না, আক্ষেপের সুরে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন জীবনের সঙ্গে লড়ে যাওয়া এ প্রবাসী।
আমাদের বহু প্রবাসী প্রবীণেরা এখানে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন। জ্যাকসন হাইটস, ব্রঙ্কস, জ্যামাইকা বা এস্টোরিয়া এলাকায় গেলেই দেখা যায়, বৃদ্ধরা হাঁটছেন একা একা। কারও মুখে হাসি নেই। এসব জীবন সংগ্রামী মানুষেরাই প্রবাসের কারও বাবা, কারও চাচা, কারও শ্বশুর। এদের দেখভাল করার কেউ নেই। কেউ তাদের খোঁজ রাখে না। প্রবাসের কোনো অনুষ্ঠানে তাদের ডাকা হয় না। যেসব নারীরা মেয়ের সঙ্গে, ছেলের সঙ্গে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছেন, তাদের সময় কাটে এসব পরিবারের গৃহকর্মী হিসেবে। অনেকে খেদ থেকে বলেন, দেশে সন্তানদের পড়ালেখা যারা করাননি তারাই ভালো আছে। অল্প শিক্ষিত সন্তানেরাই তাদের বাবা-মাকে দেখে রাখছে। আগলে রাখছে মায়ার বন্ধনে। অনেকে নিজেই প্রশ্ন করেন, তাহলে কেন এত কষ্ট করেছি সন্তানদের জন্য?