কেউ কাছে আসে, কেউ যায় দূরে
১১টা বেজে ছয় মিনিটে কাতারের বোয়িং বিমান আমাদের নিয়ে উড়ল। ফাগুনের আগুনঝরা চমৎকার দিন ছিল ঢাকায়। সূর্যের আলোয় চারপাশ ঝলমলে। দেশকে ভালোবাসি বলে কি না জানি না, এবার দেশকে আমার খুব বেশি ভালো লেগেছে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বেশ পরিষ্কার। যেকোনোভাবেই হোক, রাস্তাঘাটে কোনো যানজটে পড়তে হয়নি। এখনকার ছেলেমেয়েরা ভালোবাসা দিবস বললেও আমরা ১৪ ফেব্রুয়ারি শোক পালন করতাম; জয়নাল, জাফরদের মৃত্যুর দিন হিসেবে।
জীবনের এই আসা–যাওয়া, যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বালুতট ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া। নিউইয়র্ক থেকে দোহা, দোহা থেকে ঢাকা। ঢাকা থেকে সিলেট, সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ। আসার সময় যত কাছে আসি বুকের ভেতর আনন্দে শিহরণ জাগে। ঢাকা থেকে সিলেট আরেক ঢেউ। তারপর সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ। জীবন যেন এক ঢেউয়ের নাচন। ধাক্কায় ধাক্কায় পৌঁছে যাই প্রিয় শহরে। যেখানে প্রিয়তম মানুষেরা ঘুমিয়ে আছেন কবরে, দেশের নিঝুম নিরালায়। মা চলে গেলেন, বাবা তারও অনেক আগে। একে একে কবরবাসীর সংখ্যা বেড়েই চলছে।
করোনার প্রকোপ যখন প্রথম শুরু হলো তখন আমার মনে হয়েছিল, এ যাত্রা আর মনে হয় আমরা বাঁচব না। একে একে আমরা বহু জ্ঞানী–গুণী মানুষকে হারিয়ে বোবা কষ্ট বুকে নিয়ে বেঁচে গেলাম। আমার প্রতিদিন মনে হয়, আমার ভাইবোন–বন্ধুদের দেখতে যেতে হবে। আমার বুকের ভেতর দেশ যেন নিশির মতো ডাকে। ডিসেম্বরে যেতে চাই। সবাই বাধা দেয়। এবার আমার টিকিট কেটে প্লেনে চেপে বসি। সাদা আর পার্পল উড়ন্ত বকের বুকের ভেতর আমাদের নিয়ে উড়ে চলে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু শাকিলা আযম আমাকে নিতে আসে বিমানবন্দরে। আমি ইতস্তত করলেও সে আমায় জড়িয়ে ধরে। ওর বাসায় যাই। বিকেলে যাই গুলশানে জলির বাসায়। এই বাসায় আর কোনো দিন মইন ভাইকে দেখব না। মনটা বিষণ্ন হলো। আমরা এলে মইন ভাই প্রচুর আদরযত্নের ব্যবস্থা করতেন। হই হই করে আমরা মঞ্চনাটক দেখতাম। হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। একরকম শাড়ি কিনে দেন আমাদের। সুস্থ একজন মানুষ রক্তে হিমোগ্লোবিন কমতে কমতে কী যে হলো, একেবারেই চলে গেলেন। মইন ভাই না থাকার শূন্যতা রয়ে গেল। জলির মুখে বেদনার ছায়া।
পরদিন ঢাকা থেকে বিমান বাংলাদেশে সিলেট। সিলেটে ভাইয়ের বাসায় রাঈদ আর রাঈয়ার সঙ্গে দেখা করে এক কাপ কফি খেয়ে চলে যাই সুনামগঞ্জ। পরদিন শিমুল বাগান আর শহীদ সিরাজ লেক বা নীলাদ্রি দেখে আসলাম। দুই সপ্তাহে মোটামুটি সবই করলাম। শুধু দেখা হলো না বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ খসরু ভাইয়ের সঙ্গে। চলে গেলেন চিরতরে, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হলো।
আমার বাধা সময়সীমা শেষ। সিলেটে কোভিড-১৯–এর পিসিআর টেস্টর জন্য সকাল সাতটায় রওনা দিলাম। সিলেট–সুনামগঞ্জ রাস্তা এখন অনেক সুন্দর। ভাঙাচোরা নেই। মেন্দিবাগ আবুল মাল মোহিত কমপ্লেক্সে পৌঁছে দেখি, ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী। প্রথম নামটা আমার ডাকল। স্যাম্পল দিয়ে সোজা জেসমিনের বাসায়। আমার শৈশবের বন্ধু। এইচএসসি পর্যন্ত একসঙ্গে পড়াশোনা। বর্তমানে ডিডি পরিবার পরিকল্পনা। জীবন আমাদের দূরে ঠেলে দিলেও মনের গভীরে দুজনেই সেই আগের মতো কাছাকাছি আছি।
জাফলং নাজিমগড় রিসোর্টে ঘুরে বেড়ালাম। জাফলং স্থলবন্দরে ভারী ট্রাক আসা–যাওয়া করে। রাস্তা আগে খারাপ ছিল। এই রাস্তাও খুব ভালো মসৃণ এখন। রাতে ছোট বোন আর ওর বাচ্চারা চলে গেল।
পরদিন ১১টায় একসঙ্গে ডাক্তার শাখাওয়াত ও ডাক্তার জেসমিনসহ সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে আসলাম। এই বিমানবন্দর ঢাকা বিমানবন্দরের চেয়েও পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন। এবারও আমার বিমান বাংলাদেশ, ওদের নভো এয়ার। ৩০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম ঢাকা এয়ারপোর্টে। দশ মিনিটে উত্তরায় ছোট বোনের বাসায়।
আবার ঢাকা থেকে দোহা। দোহা থেকে নিউইয়র্ক। পেছনে ছেড়ে যেতে বুকের কোণে যে ব্যথা, তা দীর্ঘশ্বাস হয়ে যায়। প্লেনে প্রায় সবাই দোহায় ট্রানজিট নিয়ে বিভিন্ন স্টেটে যাবেন। আমার পাশের আসনে এক নবদম্পতি। তারা শিকাগো যাবেন। বাংলাদেশ থেকে বিয়ে করে বউকে এবার শিকাগো নিয়ে যাচ্ছেন। বিয়ের এক বছর পর মেয়েটি ভিসা পেলেও কোভিডের কারণে ১ বছর ১০ মাস পরে যাচ্ছে। এখন তাকে নিতে তার স্বামী যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়ে এসেছেন। খুব যত্ন করে নিয়ে যাচ্ছেন। মাস্কের ওপরে শিল্ড পরিয়ে দিয়েছেন স্ত্রীকে। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বারবার বলছেন—
-ওগু পিন্ধিয়া থাকো।
আমার খুব ভালো লাগছে। ছেলেটি মেয়েটিকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, কেন এই আসন নেওয়া হয়েছে। এটি ইকোনমি ক্লাস। বিজনেস ক্লাসে ডাবল ভাড়া। প্রতিটি অজানা বিষয় মেয়েটি জানতে চাইছে তার স্বামীর কাছে। আর তার স্বামীও পরম মমতায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কোন খাবার ভালো হবে, কোন জুস ভালো।
ডান পাশের আইল সিটে এক প্রৌঢ় দম্পতি। এই দম্পতি আমার সঙ্গে হেঁটেছেন বেশ কিছুটা পথ। প্রতিটি পদক্ষেপে স্ত্রীকে স্বামী হেয় করেছেন। শেষ পর্যায়ে আমি ভাবলাম, এই স্ত্রী বেশ ধৈর্যশীল। একটুও প্রতিবাদ করছে না, ঝগড়াও না। আচমকা ওয়েটিং এরিয়ায় এত এত মানুষের সামনে যেখানে স্ত্রী নিশ্চিত জানেন, অনেক বাঙালি যাত্রী রয়েছেন। তবু—শয়তানের বাচ্চা বলে চিৎকার করে উঠলেন।
লোকটির কপালে ভাঁজ, মহিলার কুচকে যাওয়া জীবনের কপাল দেখে আমি নিশ্চিত হই, দাম্পত্য জীবনের একত্রে পথচলায় এরা দুজনেই ক্লান্ত। বিরক্ত। ভালোবাসা, মায়া, বন্ধন সব মুছে গেছে। চরম বিরক্তিকর জীবনে পরস্পরের ভুল ধরাধরি করে কোনোমতে কাটছে। দোহায় নবদম্পতির জন্য শুভকামনা জানিয়ে বিদায় দিলাম। তবে এই প্রৌঢ় দম্পতির জন্য আর কোনো আগ্রহ রইল না।
দোহা ছেড়ে নিউইয়র্কের দিকে উড়াল দিল সাদা আর পার্পল পাখি ডানায় ভর দিয়ে। একদিকে যতই আগাচ্ছে, ততই ভালোবাসা প্রেম ওদের কাছে যাওয়ার আকুতি। আবার জন্মভূমিতে যাদের ছেড়ে আসলাম, ক্রমাগত তারা দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। একপক্ষ কাছে আসছে, আরেক পক্ষ ক্রমাগত দূরে যাচ্ছে।
পাইলটের ঘোষণা আসল, আর ৪৫ মিনিটের মধ্যে আমরা জন এফ কেনেডি বিমানবন্দর স্পর্শ করব। জানালা খুলে দেখি নিচে বিন্দু বিন্দু আলো। এত আলোকমালা আর কোনো শহরে দেখিনি। নিউইয়র্কে এখন রাত দশটার কাছাকাছি। সময়ের ৩০ মিনিট আগেই ল্যান্ড করবে। বিন্দু বিন্দু আলোগুলো হিরার দ্যুতি ছড়াতে ছড়াতে ঝলমল করে উঠল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। আমার সৌভাগ্য, আমি এমন ঝলমলে শহরের বাসিন্দা। খুবই মোলায়েমভাবে প্লেনের চাকা মাটি স্পর্শ করল। পাইলট ও তার ক্রুদের ধন্যবাদ, এমন চমৎকার ল্যান্ডিংয়ের জন্য।
ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা খুব আন্তরিকভাবে ‘ওয়েলকাম হোম’ বললেন। একঝলক বৃষ্টি ভেজা হাওয়া চেনা এই শহরে আমাকে স্বাগতম জানাল। বিমানবন্দরের বাইরের পিকআপ এলাকায় লাগেজ নিয়ে দাঁড়ানোর একটু পরে দেখি ছোট ছেলে স্নিগ্ধ হেসে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি প্রাণভরে সন্তানের মায়া নিই। মেয়ে পূর্ণতাও গাড়ি থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরে লাগেজ টেনে নিয়ে যায়। আমি তাদের অনুসরণ করি।